একি খেলা আপন সনে

কঙ্কাবতী রাজকন্যা

পর্ব -৭

বাবুটা একটু একটু হাঁটতে শিখছে। আমি যখন স্কুল হেকে ফিরি যেখানেই থাকুক ছুটে আসে সে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খায়। কত কি যে বলে। কি যে সুন্দর ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত পা, ভেজা ভেজা ঠোঁট। ও সবচেয়ে বেশী খুশী হয় ওর আঙ্গুলে নেইলপলিশ দিয়ে দিলে কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ ওকে এইসব দেওয়া যাবেনা। তাই আমি যখন ওকে লুকিয়ে নেইল পলিশ দিয়ে দেই সে তার কয়েকটা গজানো দাঁত বের করে এমন এক হাসি দেয় মনে হয় পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যাওয়া যায় সেই হাসিটা দেখেই। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আবার রিম্যুভার দিয়ে মুছে দিতে হয় আমাকে ওর নেইলপলিশের রঙ। নইলে মা ভীষণ রাগ করবেন। এই কাজটা করলেই তার মুখ থেকে সেই অনাবিল স্বর্গীয় হাসিটা মুছে গিয়ে এক মুহূর্তে তা চিল চিৎকারে পরিণত হয়। তাড়াতাড়ি তখন ওকে ভুলাতে হয় আমার পাখি দেখিয়ে, ফুল দেখিয়ে কিংবা টিকটিকি। ওর গায়ে এক অদ্ভুত গন্ধ! সবচেয়ে সুন্দর ওর চকচকে চোখজোড়া।  ওকে এক জোড়া জুতো কিনে দেওয়া হয়েছে। হাঁটলেই পিক পিক শব্দ করে আর লাইটও জ্বলে তার সাথে সাথে। ও সারাবাড়ি সেই জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। সারাবাড়ি মুখরিত করে তোলে ওর জুতোর পিক পিক শব্দে।

কাল বাবুর জমদিন হবে। কত যে আয়োজন। ঘর সাজানো হচ্ছে রঙ্গিন বেলুনে, ফিতেয় নানারকম সজ্জায়। সারাবাড়ি গমগম উৎসব মুখর আনন্দে। বিকেলের দিকে আসলো বিশাল তিনতলা কেক। সেই কেক গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে ধরে আনতেও লাগলো তিনজন মানুষ। কেক দেখে আমি মুগ্ধ। গোলাপী সাদা মিশেলের বিশাল গোলাকার কেকের ওপরটা। তার উপরে আবার কলাম করে করে আরোও দুটি গোলাকৃতি কেক বসানো। একদম উপরেরটায় এক ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছেন অচিন দেশের কোন অজানা প্রিন্সেস। আমি মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইওলাম সেই কেকটার সামনে। আমি যতদিন আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম প্রতি জন্মদিনেই দাদু কেক আনতেন। সাথে জামা এবং উপহারও থাকতো তবে এমন বিশাল কেক  আমি আমার জীবনে এই প্রথমই দেখলাম। আমার জন্মদিনগুলো নিয়ে সবচাইতে বেশী মেতে উঠতেন দাদু। এত আত্মীয় অভ্যাগতিওদের দাওয়াত করাটা তার পছন্দ ছিল না বটে তবে সবচেয়ে এক মজার ব্যাপার ছিল আআর জন্মদিনে দাদু আমাকে নিয়ে যেতেন এক আজব জায়গায়। সেখানে আমার থেকেও ছোট ছোট বাচ্চারা ছিল। ওদের বাবা মা কেউ নেই। কয়েকজন মহিলা যারা কিনা ওদের সাথে রক্তের বাঁধনে বাঁধা নয় তারাই দেখাশুনা করতেন তাদের। সেই বাড়িটাতে ঢোকার গেটের মুখে লেখা থাকতো করিমুন্নেসা এতিমখানা। আমি আর দাদু ওদের জন্য অয়ে যেতাম বিরিয়ানি আর মিষ্টি।

এই জন্মদিন উপলক্ষে বাবুর জন্য যে জামাটা বানানো হয়েছিল সেটাও ছিল ঐ কেকের প্রিন্সেসের জামা। বাবুটাকে যখন মুকুট পরিয়ে ঐ জামায় সাজিয়ে আনা হলো মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবশিশুই। কিন্তু এত লোকজন অতিথি অভ্যাগতদের দেখে শুরু হল তার কান্না! এমনই কান্না যে সকলের কান ফাটে আর একটু হলে। সে কিছুতেই কেক কাটবে না ছুরি ধরবে না।যতই মা কোলে নিয়ে ওকে দিয়ে কেক কাটাতে চায় সে ছুরি ফেলে উলটা দিকে মুখ ফিরিয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত কোনরকমে মায়ের হাত দিয়েই কেক কাটার পালা সাংগ করতে হলো।  কেক কাটা, ডিনার এসবের পরেও ছিল একজন বিশেষ অতিথি শিল্পীর সংগীতের আয়োজন। অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হলো। ড্রইংরুমের এক কোন ভরে উঠলো নানারকম উপহারে। অতিথিরা চলে যেতেই বাবা, মা এবং নতুন বাবার মা সবাই মিলে বসলো সে সব উপহার দেখতে। নানারকম ব্যাটারি চালিত হাতি ঘোড়া, বাঘ ভালুক ও নানারকম খেলনার মাঝে অবাক হয়ে দেখলাম আমি এক প্রমান সাইজ ডল পুতুল। পুতুলটি কি সুন্দর। সবুজ চোখের মনি ঢাকা পাপড়ি একটু নাড়া দিলেই বুজে ফেলে। হালকা গোলাপী রঙ তার ঠোঁট। আমি অবাক হয়ে সেটাই দেখছিলাম। হঠাৎ নতুন বাবার মা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন পুতুলটা। বললেন প্যাকেটে তুলে রাখ। নষ্ট হয়ে যাবে। হঠাৎ ভীষণ অপমান আর অভিমানে লাল হয়ে উঠলাম আমি। সেই অপমানটা মনে পড়লে আজও গা শির শির করে। বুকের ভেতর বয়ে যায় জ্বলে যাওয়া উষ্ণ প্রস্রবন!

এর দেড়মাস পরেই এলো আমার জন্মদিন। আশা করেছিলাম প্রতিবারের মত মা রাত ১২ টায় উইশ করবে কিন্তু মা মনে হয় সেবারে ভুলেই গেলেন আমার জন্মদিনের দিনটা। বাবা ফিরতে সেদিন মা বাবার অনেক রাত হলো। আমি অন্যান্য দিনের মতই মা বাবার ফেরর অপেক্ষায় জেগে ছিলাম তবে সেদিন বেরিয়ে আসলাম আমার নিজের শোবার ঘর থেকে। ওত রাতেও আমাকে জেগে থাকতে দেখে মা ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে তার টকটকে লাল রক্তচক্ষু নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, এত রাতেও ঘুমাও নি কেন? কাল সকালে স্কুল আছে না! যাও ঘুমাতে এখুনি। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালাম। সারারাত আমি সেদিন দু’চোখের পাতা এক করিনি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম।  স্কুল যাবার সময় পার হয়ে যেতেও উঠছিনা দেখে শিউলি আমাকে ডেকে উঠালো। মা বাবা এবং বাবু সকলেই মনে হয় তখনও ঘুমিয়ে। কোথাও তাদের কোনো সাড়া পেলাম না। যখন বের হবো ও বাড়ি থেকে দাদু ফোন করলেন। ফোন কানে দিতেই উনি বললে, শুভ জন্মদিন দাদুভাই। আজ বিকালে তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো। রেডি থেকে কিন্তু। আমি কোন কথার উত্তর দিতে পারলাম না। ফুঁপিয়ে উঠলাম। স্কুল যাবার পথে গাড়িতে আমার কান্না দেখে ড্রাইভার চাচু বললেন, কাইন্দো না মা  পৃথিবীতে চক্ষের জলের কুন দাম নাই। শক্ত হও। লোহার মত শক্ত। পাষানের মত কঠিন। আমার মনে পড়লো করিমুন্নেসা এতিমখানার শিশুদের কথা। দাদু বলেছিলেন ওদের বাবা মা নেই। আমার তো সবই আছে। বাবা, মা, দাদু, দীদা তবুও...

স্কুলে এসে জানতে পাই আন্তঃজেলা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতার কথা। আমাদের স্কুলের কিছু মেয়েদেরকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সিলেক্ট করেছেন মুনমুন আপা তার দলীয় নৃত্যের একজন অংশগ্রহনকারী হিসাবে আমাকেও। তিনমাস তালিম দেওয়া হবে। সেই প্রথম অমন নূপুর নিক্কনের ছমছম গা শিউরে ওঠা ধ্বনির সাথে পরিচয়। ভারী ছোট ছোট ধাতব পাতের মাঝে ছোট ছোট বলগুলো কি করে অমন মন কাড়া আওয়াজ তোলে ভেবেই পাইনা আমি। আমি মন দিয়ে মুনমুন আপার কথা শুনি। তার শিখিয়ে দেওয়া তাল মুখস্থ করি।

ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না, তেটে  ধিন ধিন ধা ।। সোম, ফাঁক, তবলা, বোল এসবের মাঝে আমি নতুন এক জগতের সন্ধান পাই। ঘুমের মাঝেও আমি বিড় বিড় করি, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না...

বেহালা পড়ে থাকে ঘরের কোনে আমি তখন নতুন নেশায় মত্ত। মাকে জানাই আমি পাকাপাকি ভাবেই নাচ শিখতে চাই। মা রাজী হন না। আমি হাল ছাড়ি না। একদিন ছুটির দিনে চুপি চুপি ফোনে যোগাযোগ করি ঝুমকি ফুপুর সাথে। ঝুমকি ফুপুর কথার অবাধ্য হবে এ বাড়ির কেউ? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা? এরপর আমি মুনমুন আপার বাসায় যেতে শুরু করি প্রতি সপ্তাহে দু’দিন নিয়ম করে। বাকী দিনগুলোতে নিজে নিজেই চলে চর্চা। মুগ্ধ হয়ে দেখি আমি উনাকে। কি কঠিন ছন্দে নেচে চলেন উনি। প্রতিটা মুদ্রা, তাল, লয় ছন্দের এক অদ্ভুত ধ্বনি ওঠে। আমার কিছুতেই অমন হয় না। কিন্তু নিরলস প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি রাখি না আমি। ১৩ বছর বয়সে মুনমুন আপার কাছে আমার যে হাতেখড়ি, তা চলে আরও প্রায় বছর তিনেক। আমার আগ্রহ আর অধ্যাবসায় দেখে উনি আমাকে বলেন বিশ্ব ভারতীতে অ্যাডমিশান নিতে। উনার কাছে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি বিশ্বভারতীর কথা। বিশ্বভারতীর পাঠ ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যা ভবন, আম্র কুঞ্জ, ছাতিম তলা আমার অদেখা চোখেও স্বপ্ন হয়ে ঘোরে আর আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই সেই অনাবিল শান্তির শান্তি নিকেতনে সবুজ ঘাসে ঘাসে। এই স্বপ্ন পূরণ হতে খুব বেশী কাঠ খড় পোড়াতে হল না। তবে আমার এই স্বপ্নের দেশে যে স্বপ্ন পূরণের আগেই আমার সাথে দেখা হলো হয়তো বা নিজের মনের অজান্তেই স্বপ্নে দেখা স্বপনকুমারের। সেই পরিচয়, সেই প্রথম দেখার ক্ষণ, সেই প্রথম ভাল লাগা, ভালোবাসা মনে পড়লেই আজও নিজের দু’গালে ছড়ানো আবীর দর্পন ছাড়াও দেখতে পাই আমি।  

পর্ব - ৮

bird
দোলন! দোলনের সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হলো, প্রথম দেখাতেই দোলন আমার হৃদয় দুলিয়ে দিল। তার অন্তর্ভেদী সুগভীর সমুদ্র নীল চোখের চাহনীতে ক্ষণিকের জন্য আমার হৃদস্পন্দনই বুঝি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানিনা বোকার মতন ঠিক কি করেছিলাম আমি সে সময়, মানে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম হা করে ওর দিকে। তবে হাতের কনুই এ প্রচন্ড এক চিমটিতে আমার সম্বিত ফিরেছিল। নায়লা আমার হাতে চিমটিটা দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, কানে কানে ফিসফিস করে বললো, অমন কেবলার মত হা করে তাকিয়ে দেখছিস কি? লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি সামনে পা বাড়ালাম।ফিরে এলাম আমার আপন কুটিরে।
কিন্তু আমার যে কি হল এরপর! সারা সন্ধ্যা আমি আনমনা হয়ে রইলাম। চোখে বিঁধে রইলো একটি বিকেল আর বকুল বিথীতে সবুজ ঘাসের গালিচায় একটি গাছের গোঁড়ায় বসে থাকে ঝাঁকড়া চুলের সেই বংশীওয়ালা। এমন তো কখনও হয় না। কত দিন কত মানুষকেই তো দেখেছি ঘরে বাইরে পথে ঘাটে! আজ আমার একি হলো! মনে হলো সে কত দিনের চেনা। তার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম আমি এই আঠারোটি বছর! আমি বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথায় যে। আমার অবস্থা দেখে নায়লা মজা শুরু করলো।
ওগো বাঁশিওয়ালা, বাজাও তোমার বাঁশি
শুনি আমার নতুন নাম,
এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখছি
বুঝলে তো?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে...
তোমার চরণে হবে কি একটু ঠায়?

হা হা হা ... উচ্ছ্বল হাসি আর দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো ও। নায়লা আমার সেই প্রবাসী জীবনের সাথী, হরিহর আত্মা নায়লা। আমরা একই রুমেই থাকতাম। একই খাবার ভাগ করে খেয়েছি। একই দুঃখ এবং শোকও ভাগ করে নিয়েছিলাম আমরা দুজনা। আমার সেই প্রথম প্রেম, উদাসী মন, উড়ু উড়ু হৃদয়, সকল আবেগ ও অনুভূতির সঙ্গীই ছিল সে। কত লুকানো বিকেল, কত আনন্দ সুখের স্মৃতি, কত বেদনা আর কত অভিমান যে আমি গচ্ছিত রেখেছিলাম ওর বুকের সিন্দুকে। সে সব আর কখনও কাউকেই বলা হয়নি আর হবেও না কোনদিন, সে বেশ জানি।
সে যাইহোক, সে রাতের খাবারের পর লাইট অফ করে শুয়ে ছিলাম আমরা। জানালা দিয়ে সেদিন আকাশ ভাঙ্গা জ্যোৎস্না। আমাদের গায়ে এসে পড়েছিল সেই স্নিগ্ধ মধুর তীব্র আলো। জানালার শিক গলে বাঁকা বাঁকা জ্যোৎস্না – নকশা আমার বুকের ’পরে শাড়ির আঁচলের কুঁচিরে ভাঁজে ভাঁজে সৃষ্টি করেছিল আরেক নকশা। আজও মাঝে মাঝেই পূর্ণ শশীকলায় খেলে যাওয়া জ্যোৎস্নায় তাকালেই আমার মনে পড়ে সেই জ্যোৎস্না আঁকা শাড়ির কুঁচির ভাঁজে খেলে যাওয়া স্মৃতিময় রাত। নায়লা একা একা বক বক করে চলেছিল। আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। এক সময় সে এই জ্যোৎস্নার ঢল দেখেই বুঝি গাইয়ে শুরু করলো,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
নায়লার গান আর চাঁদের আলোর হাসি একাকার হয়ে যাচ্ছিল সেই মায়াবী রাত। আমি অপলক চেয়ে রইলাম। জানালা গলে গাঢ় নীল আকাশের বুকে তখন ফাগুনের শ্বেত শুভ্র মেঘ। ভেসে যাচ্ছিল যেন অমল ধবল পালের কোন আকাশ খেয়াযান। নায়লা গাইছিল আর মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি ডুবে যাচ্ছিলাম সেই গানের বাণীতে বাণীতে, প্রতি চরণের অমৃতধারায়, ওর গানের সাতেহ সাথে পাখা মেলে দিয়েছিল রাত প্রহরের সেই উদাসী মেঘমালা।

নীল গগণের ললাটখানি, চন্দনে আজ মাখা
বাণী বনের হংস ইথুন মেলেছে আজ পাখা –
পারিজাতের কেশর নিয়ে, ধরায় শশী ছড়াও কি এ
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো

জানালা দিয়ে কোন রজনীগন্ধার গন্ধ ভেসে আসছিল না সেদিন। তবে কোন এক অজানা ফুলের গন্ধে তখন চারিধার মৌমিতাল। অনেক পরে জেনেছিলাম সে নাকি ছাতিম ফুলের গন্ধ ছিল। ছাতিম ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধটা দূর হতে ভেসে আসছিল বলেই বুঝি অজানা অচেনা এক মাদকতার সৃষ্টি করেছিল সেই রাতে। হঠাৎ আমার খুব কান্না পাচ্ছিল! আমার মনে হচ্ছিল এই বিশাল পৃথিবীতে আমার কোথাও কেউ নেই, যার বুকে মুখ গুঁজে আমি ঢেলে দিতে পারি আমার সকল দুঃখজল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্নার শব্দেই বুঝি নায়লা আমার পাশে উঠে এলো। আমরা দু’জন বহুরাত অবধি বসে রইলাম পাশাপাশি বারান্দার আলসে ঘেঁষে। কাঁধে কাঁধ রেখে বয়ে নিতে চাইলো বুঝি আমার সকল দুঃখ এই উচ্ছ্বল প্রনবন্ত বন্ধুটি আমার...
কয়েক দিনের মাঝেই নায়লা খবর নিয়ে এলো। তার হাড়ির খবর। নাম ধাম পরিচয় বংশ ও কূলের। আর সেদিন দুপুরেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার সাথে সংগীত ভবনের রিহার্সেল চত্বরে। নতুন এবং পুরোনোরা মিলে চলছিল আসন্ন বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠানের রিহার্সেল। আমরা যখন পৌছুলাম সেখানে, রিহার্সেল ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। গোল সার্কেলে বসে তখন গানের ছেলেমেয়েরা গাইছে বসন্ত সংগীত। তড়িঘড়ি এক কোনায় গিয়ে একটু জায়গা করে বসতেই উল্টোদিকে চোখ পড়লো। সেই অন্তর্ভেদী সমুদ্র নীল চোখ। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। বিশাল সে প্রাঙ্গনেরর সমবেত সংগীতে তখন গমগমে চারিধার – চারিদিকে আছড়ে পড়ছিল সেই সুর ও বাণী...
রাঙ্গা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল...

রাশি রাশি অশোক পলাশ শিমুলের রাঙ্গা আবির লাগলো বুঝি আমারর চোখে মুখে। রাঙ্গা হয়ে উঠলাম আমি। কি এক অজানা অচেনা নেশায় ডুবে যাচ্ছিলাম জানিনা। রাঙ্গা হিল্লোলে আলোড়িত তখন আমার হৃদয়। সে হৃদয় তার আপন হাতে দোলে। আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। চারিদিকে সঙ্গীতের মূর্ছনা আর আমার সারা দেহে এক অজানা কাঁপন। কি এক ঘোর আবেশে সম্মোহিত নিবদ্ধ আম্মার দুই চোখ ঐ আঁখির কোলে। আসন্ন বসন্তের আগমনে সকলে গাইছে গলা ছেড়ে আর আমি বিভোর কোন এক অজানা সম্মোহনের মায়াজালে।
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে
মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল...
আমার মনের অজানা সব অলিগলিতে উরে চললো লক্ষ প্রজাপতি। মৌমাছিদের গুন গুন গুঞ্জরনে বিভোরিত তনুমন। রিহার্সেল শেষ হতে সেদিন সন্ধ্যা হয়েছিল মাসব্যাপী এই রিহার্সেল আমাদেরকে কাছাকাছি এনে দিল খুব দ্রুত।
প্রেমে পড়লাম আমি। সে এক উথাল পাথাল প্রেম...
দোলন আমার স্বপ্নলোকের রাজকুমার, যার হাতে অবলীলায় তুলে দেওয়া যায় এ হৃদয়, পরম নিশ্চিন্ততায়, নির্ভরতায়। কোনদিন আমায় কেউ এই অভয় দেয়নি। কোনদিন আমার খুব কাছের কেউ হয়নি। কোনদিন আমার আপন কেউ ছিল না। কোনদিন আমাকে কেউ বাড়িয়ে দেয়নি কোন আশ্বাস বা সহযোগীতার হাত। কোনদিন কেউ আমাকে ভালোও বাসেনি খুব অবলীলায় নিঃসংকোচে। দোলন আমার সেই আশ্রয়, যার বুকে মুখ লুকিয়ে ঢেলে দেওয়া যায় গত জীবনের সকল দুঃখ তাপ। দোলনের সাথে পরিচয় বা এই প্রনয়ের পর অনেকটাই বদলে গেলাম আমি। আমি বলতে গেলে ভুলেই গেলাম আমার গত জীবনের সকল অপ্রাপ্তি। আমার মন সব সময় ভরে থাকতো অজানা এক ভালো লাগার আনন্দে। আমার ধ্যান, জ্ঞান, ভাল লাগা এবং ভালবাসার প্রতিটা তন্ত্রীতে মিশে গেল একটাই নাম – সে দোলন।
রোজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠেই যার মুখটা মনে পড়তো সে দোলন। তড়িঘড়ি স্নান সেরে কোনমতে শাড়ি পরে ক্লাসের অনেক আগেই আমি ছুটতাম বাড়তি সময়টুকু দোলনের পাশে থাকবো বলে। ও রোজ আমার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগে করে আনতো সকালের শিশির ভেজা ফুল। কখনো বেলী, কখনো জুঁই, কামিনী, শিউলী কিম্বা মাধবীলতা। ওদের বাগানের ফুল। ওর বৌদির হাতের লাগানো ফুলগাছের সেই স্নিগ্ধ সজীবতায় আমি খুঁজে ফিরতাম এক অজানা মমতার স্পর্শ, যে মমতার ছোঁয়া প্রোথিত থাকে কোন শতবর্ষী বটবৃক্ষের শিকড়ে শিকড়ে। কোনো স্বর্ণলতার সাধ্য কি সেই মমতার ঘ্রান পাবার?
দোলনের কাছে আমি অবাক হয়ে শুনতাম ওদের একান্নবর্তী সংসারের গল্প! কি অপরিসীম মমতায় ওর বড় বৌদি বড় করেছেন ১০ বছরের মা হারা এই দেবরটিকে। এই মাতৃসমা বড় বৌদি যে ওর কাছে মায়ের মতই ভালবাসার তা আমি খুব বুঝতাম ওর শ্রদ্ধা আর মমতায় মেশানো আলাপচারিতায়। মনে মনে আমিও দেখতাম বড় বৌদির মুখ, তার মাতৃস্নেহ কোন এক অজানা কল্পনায়, ওর ফ্যামিলি এলবামের ছবিগুলি দেখে দেখে আমার মনে হত সবাই আমার যেন শত জনমের পরিজন। ওর ছোট টিফিন বক্সে বৌদির হাতের বানানো পায়েস কিংবা চাপাতি সব্জীতে লেগে থাকতো এক অন্যরকম ভালবাসার ঘ্রান। আমরা দুজন ভাগাভাগি করে খেতাম সে সব খাবার কোন বকুল কিংবা কদম ছায়ায় বসে। প্রায় বিকেলেই আনরা হেঁটে যেতাম বহুদূর। দোলনের সাইকেলের পিছে চড়ে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম কোপাই নদী বা খোয়াই এর ঘাটে। ঘুরে বেড়াতাম নদী তীর ধরে। ঘুরে ঘুরে কিনতাম নানারকম শিল্পকর্ম বা অকারণ হাবিজাবি। একসাথে গান গাইতাম দুজনে গলা ছেড়ে। মোট কথা হাওয়ায় ভেসে উড়ে যাবার ছিল সেই দিনগুলো...

পর্ব ৯- ১০