|  | 
		নব আলোকে বাংলা 
		উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। 
		দূরদৃষ্টি। 
		  
		
		সম্পাদক 
		
		
		সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ 
		
		
		পাঠক পরিষদঃ শুভলগ্না শোয়ারা, চঞ্চল চৌধুরী 
		কৃতজ্ঞতাঃ ওস্তাদ 
		আমজাদ আলি খান, যার সরোদ ঝংকারে আবিষ্ট মেঘমল্লারের সুর মূর্ছনায় 
		  
		এবারের প্রকাশনা 
		  
		
		বরষা 
		  
		
		
		গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে
		 যখন বিশ্ব চরাচর অগ্নিস্নানে দগ্ধিভুত হয়, বর্ষা 
		নামে প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে।  
		
		
		তার শীতল জলধারা সকল তাপ-জ্বালা ধুয়ে মুছে শান্ত করে বিশ্ব চরাচর। 
		বর্ষার 
		শান্তির বারি সিঞ্চনে সিক্ত হয় প্রকৃতি, মানুষ এবং মানুষের চিত্ত। মেঘের 
		ছায়ায় আশ্রয় পায় তৃষিত ধরণী আর তৃষ্ণার্ত মানুষের প্রাণ। এত সুখ আর এত 
		শান্তি যেন কিছুতেই নেই। নবধারায় স্নাত মানুষের হৃদয় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। 
		কবিত্বে ভর করে তার তনু-মন।  
		
		ছন্দে, লয়ে আন্দোলিত হয় অন্তর। আনন্দে বিরহে সে 
		হয় উদ্বেলিত।  
		
		তার নম্রকন্ঠ বলে, 
		  
		
		
		‘এমন 
		দিনে তারে বলা যায় 
		
		
		এমন ঘনঘোর বরিষায় 
		
		এমন মেঘস্বরে-বাদল ঝরঝরে 
		
		
		তপনহীন ঘন তমসায়’ 
		  
		
		*** 
		  
		  
		  
		করতলে 
		দিগন্ত, দৃষ্টিতে তুমি 
		
		কালপুরুষ 
		  
		মেঘবতী,
 
		কালকের দিনটা ছিল বৃষ্টিমুখর। তুমুল বৃষ্টির কারণে জল থৈ থৈ অবস্থা। আহ্! 
		ছোট্ট একটা ডিঙি পেলে কিশোরবেলার মতো নাবিক হবার চেষ্টা করা যেত। তাতো আর 
		হবার নেই। কোন সুযোগও নেই। সময় এবং বয়স একে একে সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেল। 
		পুরোনো স্মৃতিটুকু এখন অবসর সময়ের সঙ্গী। আলসেমি কাটিয়ে সেদিনের অসমাপ্ত 
		মেইলটা শেষ করা যায় কিনা চেষ্টা করা যাক। তবে সুর কেটে গেলে মূর্ছনার 
		আমেজটা আর আগের মতো থাকেনা সেটা তুমিও জানো।
 
 “আমি কোনদিন কিছু ছিলাম না এবং আমার কোন অভিলাষ ছিলনা অথচ আমার ভেতরে 
		পৃথিবীর তাবৎ স্বপ্ন....”।
 
 আমাদের প্রতিদিনের স্বপ্নগুলো যদি অবারিত দিগন্ত ছুঁয়ে যেতে পারতো-- যদি 
		আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো রঙিন সূতোয় মোড়ানো রুমালের মতো ভালবাসার চিহ্ন 
		হয়ে যেত-- যদি আমাদের চেনা-জানা ভাললাগাগুলো ময়ূরী আকাশের নীচে সন্ধ্যা 
		প্রদীপ হয়ে জ্বলতো--এবং যদি আমাদের হৃদিক সম্পর্কগুলো বহতা নদীর মতো চিরদিন 
		স্রোতস্বিনী হতো-- আমরা কি তবে শ্রাবণের মেঘের মতো প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে 
		এমন ঝরে যেতাম? আমাদের হৃদপিন্ড কি তবে এরকম গলে পরা বরফের মতো ক্ষয়ে যেতো 
		দুঃখ ও বিনাশে?
 
 স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের মতো জীবনও ডুবে যায় মহাকালের অতলে। প্রজ্জ্বলিত 
		সূর্যের সাথে মিল রেখে আমরাও হারিয়ে যাই কোথাও-- কোন এক অজানা দিগন্তে। এই 
		যে বেঁচে থাকা, একগুচ্ছ সৌরভহীন রক্তজবার মতো কাউকে বেঁধে রাখা মনের 
		বাঁধনে, একা গাঙচিল হয়ে উপকূলে কান পেতে বসে থাকা ভালবাসার শিলাপাত শোনার 
		ব্যাকুল আশায়--সেখানেওতো ক্ষিপ্রগতির বিদ্যুৎ এসে ছিন্নভিন্ন করে দেয় 
		আমাদের কোমল অনুভূতি। কেঁপে ওঠা ল্যাম্পপোস্টের মতো দুলে ওঠে আমাদের মন। 
		আমরা আহত হই বিপর্যস্ত সময়ের কাছে। অগ্নিকোণের কোন তল্লাট থেকে ছুটে আসে 
		প্রবঞ্চক হাওয়া- এলোমেলো করে দেয় আমাদের নাক্ষত্রিক প্রেম। গাণিতিক অর্থে 
		দুজনেই শূন্য বসাই মনের ঘরে।
 
 তবুও ভালবাসি আমরা। পলিমাটির সৌরভ ছড়াই মৃত্তিকার প্রযত্নে। শুকনো পাতার 
		বনভূমিতে জমা করি সজল মেঘ- আকুল হাহাকারে প্রান্তর ভরিয়ে দেই বর্ণিল আবেগে- 
		বৃষ্টির মোহনীয় ছন্দে। শিশির এবং রৌদ্রের নমনীয়তায় আবার উচ্চারণ করি 
		মানুষের জন্য ভালবাসা। বেঁচে থাকা যদি জীবন হয় আর জীবনের মানে যদি হয় ফুল 
		ফোটানোর খেলা- তবে অজস্র প্রতিকূলতায় আমরা রোপণ করি কৃষ্ণচূড়া, বিষণ্ণতার 
		অর্গল ভেঙ্গে কাছে টানি শুভ্র গোলাপ।
 
 হে মেঘবতী, লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে ওঠেনা অনেকদিন। প্রবাহমান জীবন থেকে 
		কিছু হারিয়ে গেলে অথবা মনের কোমল অনুভূতির দীপ্ত আলোকছটা কিছুটা স্তিমিত 
		হলে জীবনের গতি ও পথ বদলে যায়। অনীহা কিংবা আড়ষ্টতা এসে জেঁকে বসে মগজে ও 
		মননে- তবুও কখনো কখনো ইচ্ছে করে কথার নকশিকাঁথায় ঢেকে দিই কারো চিরচেনা 
		অবয়ব- কতটুকু ঢাকা হয় জানিনা। আষাঢ়ের ঘনকালো মেঘের আড়ালে সূর্যের মতো কেউ 
		লুকিয়ে থাকে মনের দিগন্তে- তাই হয়তো এই অপলক চেয়ে থাকা। হয়তো আবারো দেখা 
		হবে- চেনা কোন পথে কিংবা অচেনা কোন বন্দরে।
 
 
		
		-প্রিয়তমেষু
 
		
		*** 
		অলৌকিক বৃষ্টি
 
		প্রতিধ্বনি, তুমিতো 
		  
		তোমার জন্য তেমন কবিতা লেখা হয়ে উঠলো না। অথচ তোমার পায়ের কাছে আমার থরে 
		থরে কবিতা থাকার কথা ছিল। না, আমার কবিতা এখনো তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে 
		পারেনি। এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তোমার যোগ্য উপমা খুঁজে পাইনা 
		বলেই। বরং আমার বিভিন্ন কবিতায় তুমিই উপমান হও। তোমাকে কোন কিছুর মতো মনে 
		হয় না। সব সৌন্দর্যকেই তোমার মতো মনে হয়। সেবার পাতা ঝরার শব্দের মধ্যে 
		বারবার তোমার চোখের পাপড়ির কথা মনে হচ্ছিল। আমি তোমাকে সর্বত্র দেখি। আমার 
		শ্রুতি সীমার মধ্যে সমস্ত শব্দেই তুমি ধ্বনিত হও। কী করে আমি তোমাকে 
		উপমায়িত করবো বলো? তাই তোমাকে নিয়ে তেমন কবিতা লেখা হয়ে ওঠে নি। যে দু'একটা 
		লিখেছি তাতে মন ভরেনি। তোমার যথাযোগ্য হয়নি।
 তাই দীর্ঘদিন পর আজ আবার তোমার জন্য কবিতা লিখতে যেয়ে কবিতা লেখার নামে একা 
		একা বিব্রত হচ্ছি। তোমার জন্য কবিতা লেখার অনভ্যস্থতা পেয়ে বসেছে। তাই 
		কবিতা নয়।
 আস কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় মগ্ন হই:
 
 কী করছো এখন?
 কিছুনা। অপেক্ষা করছি।
 কিসের?
 তোমার কবিতার
 কবিতার পাটতো আপাতত স্থগিত হলো
 সেতো চিরকালই থাকে
 তবে?
 তাও অপেক্ষা করি।
 কেন কর?
 তোমার কবিতার জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লাগে যে
 কিন্তু আমার কবিতা তো কোন দিন পাবেনা তুমি
 জানি
 তবে?
 পবোনা জেনেই তো অপেক্ষা করতে আরো বেশী ভালো লাগে। এ অপেক্ষা মৃত্যুর মতো 
		টানে।
 নাহ! আলাপটা জমছে না। আচ্ছা অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখি:
 আমি ভিজে চলছি। বৃষ্টির ধারায় ভিজে চলছে কবি।
 তোমাকে কবিতার অপেক্ষায় রাখা তোমার কবি।
 
 বিশ্বাস করো আজ কোন বৃষ্টি নামেনি। তবু আমি এক অলৌকিক বৃষ্টির ভেতর দিয়ে 
		যাচ্ছি। শুধু তোমার কথা যখন ভাবি, তখন এ বৃষ্টি নামে। আমি ভিজে যাই। শীতে 
		কাঁপন ধরে। হাত-পা অসার হয়ে আসে। নীল হয়ে উঠি। কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়ি 
		সৃষ্টিময় সড়কে। তবু ভিজি। এমন নয় যে আশেপাশে কোথাও আশ্রয় নেই। আছে। তবু 
		ভিজে চলি। যদি জিগ্গেস করো কেন? তবে বলবো, ঐ বৃষ্টি আমাকে মৃত্যুর মতো 
		ডাকে, উপেক্ষা করা যায় না। তোমার জন্য আমি তীব্র খরার মধ্যেও বৃষ্টির 
		ঝিরঝির শব্দ শুনতে পাই।
 
		
 
		  
		
		*** 
		কবিতা 
		* 
		* 
		  
		
		আষাঢ়ের দেয়াফিরোজা হারুন
 
		সারাদিন বৃষ্টি, কি যে অনাসৃষ্টি
 রোদ নেই আলো নেই, ঝাপসা যে দৃষ্টি।
 গাছপালা ঢেকে থাকে কুয়াশার পর্দায়
 জলভরা আকাশেতে মেঘগুলো গর্জায়।
 
		মেঘে মেঘে ঘর্ষণ, অম্বরে ডামাডোল
 দিগন্তের বুক চিরে, বেজে উঠে কলরোল।
 উন্মাদ কালো মেঘ ছাড়ে শুধু হুংকার
 সংকেত বয়ে আনে ঘনঘোর বরষার।
 
		পুরুবাসী ভয় পায়, আশ্রয় খোঁজে তায়
 দ্রুতপদ সঞ্চারে আকাশের পানে চায়।
 তীরবেগে জল পড়ে ধরণীর ললাটে
 ঝড়ো হাওয়া বেগে ধায় প্রচন্ড দাপটে।
 
		কড় কড় শব্দে ভেঙে পড়ে আসমান
 দৈত্যের পদাঘাতে হবে বুঝি খান খান!
 অবিরাম জলধারা প’ড়ে প’ড়ে দিনরাত
 অবশেষে ক্লান্তিতে কমে আসে ধারাপাত।
 
		নীলাম্বর উঁকি দেয় সুদূরের আকাশে
 বাদলের আনাগোনা ভেসে যায় বাতাসে।
 পথঘাট পিচ্ছিল, পংকেতে একাকার
 রসিক পথিকদল পথে নামে বারবার।
 
		বরষার ঘনঘটা বয়ে আনে দুর্দিন
 তবুও হৃদয় মাঝে বেজে উঠে সুখ বীণ।
 বরষা আসে বলে হয় নব সৃষ্টি
 প্রকৃতির বুকে জাগে সবুজের কৃষ্টি।
 শ্যামল ধরার আঁচল ঊড়ে চলে পবনে
 মেঘের কাজল লাগুক রূপসীর নয়নে।
 ***
 
		  
		  
		
		বৃষ্টির ছন্দেকালপুরুষ
 
 রিমঝিম বৃষ্টি
 অবনত দৃষ্টি
 এলো কেশে পাশে বসে
 শুনছো কী কান পেতে?
 রিমঝিম সারাদিন,
 কি মধুর বাজে বীণ
 অপরূপ ছন্দে- আহা কী যে মিষ্টি!
 
 মনের দুয়ার খুলে,
 ভালবাসা নাও তুলে;
 কি হবে একা একা,
 আনমনে চেয়ে থাকা;
 এসো আজ কাজ ভুলে
 জানালাটা রাখি খুলে;
 মেলে ধরি দুজনে- অবারিত দৃষ্টি!
 
 আকাশের গা ঘেঁষে,
 মেঘদল যায় ভেসে;
 দূরে ঐ ঘন নীলে,
 গাংচিল ডানা মেলে;
 অপলকে চেয়ে থাকা,
 ইশারায় কাছে ডাকা;
 ভাললাগে প্রকৃতির- অনুপম সৃস্টি।
 
 এলোমেলো বাতাসে
 মৌ মৌ সুবাসে,
 কোন ফুল ফোটে বনে
 আজ এই মধুক্ষণে;
 নেশা লাগে মনে তাই,
 আরো কাছে পেতে চাই;
 রিমঝিম সারাদিন- ঝরে যাক বৃষ্টি।
 
		
		*** 
		  
		  
		
		বৃষ্টি সিরিজসৈয়দ আফসার
 
 
 
			
				| 
				বৃষ্টির শুরু 
				যেন বৈশাখ শেষেমনমাঝি ডুবে মইলো স্বপ্নপুরীর দেশে
 *
 আশাহত চাতক চাহে মেঘ বৃষ্টিকে
 বৃষ্টিতে কলঙ্ক আমার ভাসে দিকে-দিকে
 বৃষ্টিকে বেসো-না ভালো ছলনায় ভরা মন
 আঘাত পেয়েছে যারা জানে সে দহন
 *
 বৃষ্টির টিপ্টাপ্ ধ্বনি ক্রমাগত রাতে
 তবুও পারেনি বৃষ্টি রঙ বদলাতে
 *
 বৃষ্টি ও চোখের পানি দুটি একই ধারা জল
 প্রেমের শুরু শেষ জানিনে অতল
 *
 বৃষ্টির দরজায় খাঁড়া ক্ষণ হতে ক্ষণে
 ফিরে কি আসবে কভু শঙ্কা এ মনে
 *
 বৃষ্টি মরে যাবে দেখো শরতে টানে
 সে কথা আমিও জানি প্রকৃতিও জানে
 বৃষ্টি আমার চোখের নেশা, বৃষ্টি চোখের জ্যোতি
 অতীতের যত ভাবনা ছিল আজ শুধু স্মৃতি
 বৃষ্টিকে আজো কামনা, এক নীল স্বপনে
 কালো মেঘ আটকে গেছে দুখের বাগানে
 বৃষ্টি তুমি চলে যাবে শ্রাবণ ধারা জলে
 আমাকে পাবে না তুমি বেলা চলে গেলে
 কখনো যদি ফিরে এসো বলবো ভালোবাসী
 ঠোঁটে তোমার চুম্বন দেবো অনেক বেশি বেশি
 | 
				
				আহ্ বৃষ্টিওই বৃষ্টি
 ইস্ বৃষ্টি
 ওহ্
 স্নানঘরে
 একাঘরে
 আছে মম
 রুহ
 *
 জানালায় সঙ্গ দিচ্ছে বৃষ্টি তব নাম
 জাগিয়ে মুষলধারে সম-মনস্কাম
 *
 বর্ষা-বৃষ্টির সায়াহ্নে আজ বলিল শাওন
 ফুলদার্ত্রী জানে নাকি রাতের কাহন
 *
 মুই গেনু রসাতলে, তুমি থাকো যুগ-যুগ জীয়ে
 সহসা রচিনু পদ বর্ষা ঘোরে সখা-সখি নিয়ে
 *
 দাঁড়িয়ে আছে যারা তাদের জন্য দুঃখ যত কিনি
 দু’ফোটা বৃষ্টির জলে ঋণী কেন নন্দিনী...
 না যদি ভালোবাসো, আমি তবে বাসি
 অপাত্রে ঝরিও কিছু নিরুপম হাসি
 বৃষ্টিকে আজো ডাকি কামনার সুরে
 সব কিছু শুষে নিয়ে এখন কেন দূরে
 বৃষ্টি তুমি চলে গেলে লাল বেনারসি পরে
 আজো তোমায় খুঁজে ফিরি নগর-বন্দরে
 বৃষ্টি তুমি ভালো থেকো থিতি দিনকাল
 সব দোষে দোষী স্বতদেহখানি স্বপ্নভাঙা কপাল
 
 |  
		* 
		**
 মুক্তগদ্য
 
 নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
 
 
 শোনো, এইখানে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়
 
 ০১.
 
 আমার জন্ম হয়েছিলো শ্রাবণ শেষে। হয়তো ঝিরিঝির ঝরছিলো বাদল। আর দূর থেকে 
		সাঁতরে আসছিলো শরতের শাদামেঘ।
 অনেক দিন ভেবেছি মাকে শুধাবো, মা, আমার জন্মের সময় বৃষ্টি হচ্ছিলো...? 
		কিন্তু মায়ের কাছে গেলে,
 অনেকদিন পর মায়ের কাছে গেলে এইসব জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই, মা আমাকে জড়িয়ে
 ধরে কাঁদেন; আমার মায়ের চোখেই তখন বর্ষা। আমার জন্ম ৯ ভাদর। শরৎকাল।
 কিন্তু বৃষ্টি ছিলো অবশ্যই। আমি জানি, আমি জানি...
 
 ০২.
 
 আমার কখনো কোনো ছাতা ছিলো না। যেনো আমি বাদল থেকেই এসেছি। সারা বর্ষা 
		বৃষ্টিতে ভিজেছি। প্রথমদিকে কেনো ছাতা নিতাম না, এখন আর মনে পড়ে না। হয়তো 
		ঘরে সবার জন্যে ছাতা ছিলো না। পরে অভ্যেস হয়ে গেছে।
 ছাতা পৃথিবীর অশ্লীলতম জিনিশের একটি।
 
 ০৩.
 
 একদিন বৃষ্টিতে কথা ছিলো সে কথাটি বলবে; প্রতীক্ষায় ভিজেছে নিয়মিত দুপুরের 
		আলো। মৃন্ময়ী বলেছিলো, চিঠি দিও।
 চিঠি লিখেছি কবে! পোস্ট অফিসে ডাকবাকশো ভর্তি আমার চিঠি। কখন খুলবে বাকশো? 
		কী জানি,
 তার বালিশের নিচে হয়তো কাঁদছে আমার পত্রাবলি। না, প্রত্যুত্তর পাই নি।
 সেও কি মরে গেছে বর্ষায়, নিবিড় বৃষ্টির ভিতর?
 
 ০৪.
 
 বৃষ্টিদগ্ধ গাছ ডাক দেয়। গিয়ে দেখি সে হাত পেতেছে আমার কাছে।
 কী চাই?
 আমার তৃষ্ণা।
 আমার হাসি পায়।
 সে বলে, জল দাও।
 অবশেষে আমি বলেই ফেলি, আমিই সেই বৃষ্টি, যে তোমাকে দগ্ধ করেছে...
 ততণে সে সরিয়ে ফেলে মুখোশ।
 বলে, আমার জল নয়, আগুনের তৃষ্ণা...
 
 ০৫.
 
 আমার ছোট্টো একটা বোন ছিলো। পাখির মতো। পাখির সাথে বিভেদ শুধু-- তার ডানা 
		ছিলো না দুপাটি। নাম ছিলো দোয়েল।
 বেঁচে থাকলে ১৩ জুলাই উনিশবছর হতো। এক বর্ষায় জন্ম হলো, অনেকদিন পর এই 
		বর্ষায় দুপাটি ডানা পেলো।
 এবং উড়ে চলে গেলো। সে চলে গেলো ১৭ জুন সকালবেলায়। এখন আষাঢ় চলছে।
 কিন্তু কত তারিখ দেখতে মন চাইছে না সেদিন।
 তার মৃতদেহ আমি দেখতে যাই নি।
 যাক, সে চলে গিয়ে ভালোই করেছে। সবসময় তার মৃত্যু কামনা করতাম।
 কেননা তার যন্ত্রণা সহ্য হতো না; কী যে যন্ত্রণায় থাকতো সে!
 তাকে দেখলেই কান্না পেতো। ভালো।
 এখন আর কান্না পাবেনা। সে প্রতিবন্ধি ছিলো।
 
 ০৬.
 
 যে চাইলে অনায়াসে বৃষ্টি হতে পারে-- সে যদি বৃষ্টিতে ভিজে... কার জন্যে এ 
		চাতকজন্ম রাতভর দিনভর?
 শেষবেলা মরা-জল নিভু নিভু; বৃষ্টিবাতি আর ভেজাতে পারে না নরোম আলোর দংশনে।
 যে রাতে বন্ধ্যা ক্ষেতে শস্যের বীজ ছড়িয়ে এসেছি,
 যে দিন সূর্যকে করে নি নমস্কার...
 আর কালগুচ্ছ হাতে ধরে বয়ে চলেছি খরাপ্রাণ...
 
 ০৭.
 
 সেদিন বিষ্যুদবার ছিলো। চিত্রাঙ্গদা এসে বললো, সে মারা গেছে।
 যাহ্! দুষ্টুমি করছো।
 না, সে মারা গেছে।
 আমি কেমন করে বিশ্বাস করি কথাটা? আমার নীল মারা গেছে।
 তার নাম ছিলো নীলা। আমি তাকে নীল নামে ডাকতাম। তার একটা বন্ধু ছিলো সুন্দর, 
		এখন বিষণ্ন-সুন্দর। সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। সে আমার কাছে যে বর্ষায় 
		এসেছিলো সে বর্ষাতেই চলে গেলো। তাকে আমি কখনো দেখি নি।
 তার একটা পায়ে সমস্যা ছিলো। সে আমার হাত ধরে পাহাড়ে উঠার স্বপ্ন দেখতো।
 নীল, তোমাকে কে নিয়ে গেলো?
 শেষবার আমার বন্ধু নীল আমাকে যে চিঠিটি পাঠিয়েছিলো, তার সাথে অনেক চকোলেট 
		ছিলো।
 তার চারটা চিঠি আমার কাছে আছে। প্রথম চিঠিটা সে ডাকে পাঠিয়েছিলো, তাই 
		পাইনি। ডাকঘর উঠে গেছে।
 তাই সুধা এসে অমলকে পায় নি। সেদিন ছিলো ৩১ আগস্ট ২০০৬.
 নীল, তুমি কি মাটি হয়ে গেছো?
 
 ০৮.
 
 তারা পলাশবন পার হয়ে বকুল বনে ঢুকছিলো। ঘোরসন্ধ্যা, আর ঝুমঝুম ঝুমঝুম 
		বৃষ্টি নামছে, একাকার। বকুলবনের দরজায় পা রেখেই একজন কবি তার প্রিয়তম নারীর 
		চোখের পাতায় এঁকে দিলো বর্ষাস্নাত চুম্বন... এবং
 বকুলবন আলোকিত হলো বাদলের রঙে।
 
 ০৯.
 
 পঞ্জিকার হিশেবে বাঙলাদেশে বর্ষাকাল দুইমাস, আষাঢ়-শ্রাবণ। কিন্তু বৃষ্টি 
		শুরু হয় বৈশাখ থেকে; আর সেটা থামতে থামতে ভাদ্রের শেষ। শিরোনামহীনের বর্ষা 
		গানটা মনে পড়ছে। কে যেনো শুনতে বলেছিলো, কে যেনো শুনতে বলেছিলো?
 সে হারিয়ে গেছে।
 
 ১০.
 
 জীবনানন্দ হয়তো ঠিক করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন তিনি তা লিখবেন না; 
		তিনি লিখেন নি। কিন্তু তারপরও বৃষ্টি নিয়ে তার দুইতিনটা কবিতা আছেই। 
		জীবনানন্দ দাশ বর্ষাকে উপলব্ধি করেছিলেন সকল ঋতু এবং অস্ফুট শূন্যতার ভিতর 
		দিয়ে।
 কোনো বাঙালির পক্ষে কি বর্ষাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
 
 ১১.
 
 হিজলের বনে বর্ষা নামলে তুমি আসো। আমরা পরস্পর হাত ধরে হাত ছেড়ে দিই। হয়ে 
		যাই হিজলের ফুল।
 বকুলবন সগন্ধ তাকিয়ে থাকে।
 
 ১২.
 
 অভিমান কখনো আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চায় নি। অথচ আমি কেবল তার সাথেই 
		বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছি চিরদিন।
 অভিমান ইদানীং বকুলের বনে বৃষ্টি হয়ে গেছে।
 
 ১৩.
 
 একটি কান্না ছড়িয়ে রেখেছি মেঘে। মেঘের ভিতর কী? একটি কান্না ভুলে গিয়ে 
		দিয়েছি বৃষ্টির কাছে।
 এই সব শুনে বললাম, তোর তবে নাম কী?
 শ্রাবণ।
 শ্রাবণ তো চলে গেছে।
 শ্রাবণ বারবার আসে। সিমেন্টক্রসিং এ রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজে যায়।
 শ্রাবণ! তুই কেমন আছিস রে?
 
 
		***
 
		গল্প
 
 বৃষ্টি নীল জল
 
		লিলির ঘুম ভেঙ্গেছে অনেকক্ষণ হলো। সে শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ 
		সকাল থেকেই আকাশের মন ভার হয়ে আছে। সারা আকাশ কাল মেঘে ঢেকে আছে। গুড়ি গুড়ি 
		বৃষ্টি পড়ছে তার ঘুম ভাঙ্গার কিছুক্ষণ পর থেকেই। তার মন আকাশের সাথে সাথে 
		রঙ পরিবর্তন করে।আকাশের রঙ নীল হলে তার মন অনেকটাই ভাল থাকে। সে অকারণেই 
		সেদিন হাসে।যেদিন আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় সেদিন তার অনেক ইচ্ছে করে 
		সবুজ কোন মাঠে হাঁটতে। সে শুনেছে ময়মনসিংহে নদীর পাড় জুড়ে অনেক সাদা কাশফুল 
		ফুটে শরতকালে। তার খুব ইচ্ছে করে সেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে।
 আজ আকাশ জুড়ে মেঘ। তার মনে হচ্ছে আকাশটা কাদঁছে। তারও কেন জানি কান্না পেয়ে 
		যাচ্ছে। সে বিছানা থেকে উঠছে না, তার একটা কারণ আছে। সে অপেক্ষা করে আছে 
		কখন তার আম্মু আসে। সে তার রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলেই চোখ বন্ধ করে 
		ফেলবে। তার আম্মু এসে তার মুখের উপর হাত বুলিয়ে আদর করবে। সে সেই আদরের 
		জন্য অপেক্ষা করে আছে.........
 
 
		  
		  
		  
		  
		
		
		পৃথিবীলোক 
 
		
		ভবিষ্যত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সহনশীলতার লেশ মাত্র নেই মানুষের। সীমানার 
		প্রান্তে তাদের এই উন্নত জীবন যাপনের কারণে এরই মধ্যে সমুদ্র গর্ভে চিরতরে 
		বিলীন হয়ে গেছে আমাদের দক্ষিণ তালপট্টি। অতলে হারিয়ে গেছে আন্দামান নিকোবর 
		দ্বীপ। ভারতের লোহাগড়া দ্বীপটি কদিন আগেও ঘোড়ামারা থেকে দেখা যেত এখন তা 
		ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে 
		আছে তবে দক্ষিণ তালপট্টি সেই ধারণা মিথ্যো করে দিল। সত্য হলো বিজ্ঞানী ও 
		বিশ্ববাসীর আশংকা। সাগরের উচ্চতা আর মাত্র এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের তিন 
		কোটি মানুষ জলবায়ু- উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে...
 
 
		* 
		* 
		*     
		বৃষ্টিভেজা গদ্যকলাপ
		 
		মুজিব 
		মেহদী   
		এ হমিজ টু দ্য রেইন 
		গডস 
		
		বর্ষা মাথায় নিয়ে পণ্ডিত 
		শিবকুমার শর্মার সঙ্গে লাইভ পারফর্মেন্সে ইউকের পাম্পরুমে থাকতে পারা, এক 
		অসাধারণ আবেগ জাগানিয়া ঘটনা। সাক্ষাতের শুরুতেই ত্রিশ মিনিট ধরে সনতুরে 
		তিনি বর্ষা আবাহন করেন, পরের বিশ মিনিট ধরে বর্ষাস্তুতি এবং সবশেষে 
		বর্ষানামা আরো বিশ মিনিট ব্যাপে। কল্পনায় হলেও এই শেয়ারযোগ্য অনুভূতিমালার 
		ভার সতত চালিত হতে থাকে সাঁইজির ওই জগৎজিজ্ঞাসার দিকে যে, 'কে গো জানতে পায় 
		রসের রসিক না হলে ?' যেকোনো নিষ্ঠ মেঘমল্লারেই আদপে গুঁড়িয়ে যেতে হয়। কেননা 
		তখন 'পররূপে কাতরতা জাগে মৃদু-মৃদু'। ফোঁটায় ফোঁটায় কোটিধা বিভক্ত হয়ে 
		যাওয়া নিজঅস্তিত্ব জানান দিতে তখন প্রিয়ার সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যায় মন ও 
		মানস। ওদিকে আকাশের সজলতা কী বাতাসের খ্যাপা প্রবণতা এসে ঘাঁই মারতে থাকে 
		উড্ডয়নরত 'খাঁচা'রূপী ইনফ্রাস্ট্রাকচারে। তখন মাসুদ খানের মতো অনুভূতি হয়। 
		মনে হয় 'বর্ষাই মূল পাঠ্যকৃতি, মূল আখ্যানপাত্র/ আর সব ঋতু পাঠসহায়িকা/ 
		টীকা-টিপ্পনীমাত্র।'
 
 পাম্পরুম থেকে বেরিয়ে ভিজতে ভিজতে আমরা লবণাক্ত ও বিস্বাদ সমুদ্রের দিকে 
		হাঁটতে থাকি। লোনাবৃষ্টিতে সঙ্গীর কৃষ্ণকুন্তলঝাড়ের দিকে এগিয়ে যাই। 
		চোখমুখকান ঢেকে যায় কৃষ্ণ আশীষে। এরপর চোখ বুজে মনের মাপে ভিতরদৃশ্য দেখতে 
		দেখতে এগিয়ে যাই টিলা-ট্যাঙ্গর, নদী-হ্রদ পেরিয়ে। ক্রমে আনুপূর্ব ঘেমে উঠি। 
		উবু হয়ে বসে পড়ি মোহনার কাছে, সমস্ত লবণ যেখান থেকে পরিবাহিত হয় বন্দরে 
		বন্দরে। ওই বৃষ্টিশীলতার ভিতরে যে উষ্ণ-নুনতা স্বাদ থাকে, কখনো কখনো তা 
		সুমিষ্ট ও সুপেয়ও বটে, আগে তা একদমই জানা ছিল না। নবজ্ঞানের ওই ভারে সৈকতের 
		ভেজা বালিতে আমরা পরস্পর লীন হতে থাকি। সূচনার বৈতালিক লীনগতি ক্রমশ একতাল 
		তিনতাল হয়ে খেমটায় এসে ঠেকে। উত্তরসমুদ্রের ঝাউগাছের ওপারে তখন ধ্বনিত হতে 
		থাকে পণ্ডিত যশোরাজের সুমিষ্ট স্বর 'বরষা ঋতু আয়...ঋতু আয়...'। আর 
		সিমুলটেনিয়াসলি পূর্বপ্রান্তের পাথরগুচ্ছের ধার ঘেঁষে সাজানো 
		হার্ডড্রিঙ্কসের দোকানিরা অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে কাউন্টার দিচ্ছিল 'মেঘমেদুর 
		বরিষায়...' বাজিয়ে। এককেন্দ্রীক অথচ দ্বিমুখী এহেন সুরে বুঁদ বজ্রধর ইন্দ্র 
		স্বীয় পুরীতে বসে তার সহস্রমুখী বজ্রাস্ত্র পৈথানে রেখে নেপথ্যে তখন অনবরত 
		তাল ঠুকে যেতে থাকেন। সুরতালের মহামূর্ছনাজনিত ওই দূষণমধ্যে আমরা তখন 
		লবণজলে পা ভিজানোকে গৌণ ঠাউরিয়ে আকাশঢালা জলের কাছে এমনকি গায়ের টুকরো 
		বস্ত্রতক সঁপে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাই।
 
 
		স্ফীতিহীন স্ফীতকার্য 
		  
		প্রথমে মেঘমালা 
		সঞ্চালিত হয় ও যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, পরে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, তারপর 
		তা একত্রিত ও পুঞ্জীভূত হলে আমরা দেখি বিজলিপ্রভা, শুনি বজ্রধ্বনি, যা ভয় ও 
		ভরসা সঞ্চার করে। পরে প্রকৃতির অনুগ্রহে পরাগ ও বারিবহনকারী বায়ুরাশি 
		প্রেরিত হয়। সুসংবাদবাহী বাতাস ছাড়া পেয়ে পর্বতশৃঙ্গে বিশ্রামরত পুষ্কর 
		মেঘকে চুলের মুঠি ধরে বয়ে নিয়ে আসে নিষ্প্রাণ ভূখণ্ডের দিকে এবং তারপর আকাশ 
		থেকে পরিমিতভাবে বিশুদ্ধ ও উপকারী বারিবর্ষিত হয়। এতে মৃত জমি পুনরায় জীবিত 
		হয় এবং অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়। তাতে সবরকম গাছের 
		চারা ওঠে। ওতে উদ্গত হয় ঘনসন্নিবিষ্ট উদ্যান ও সবুজ পাতা। সৃষ্টি হয় 
		শস্যদানা, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, অন্য সবরকম ফল ও গবাদিপশুর খাদ্য। 
		প্রাণী ও ভূমি জীবনের রোমাঞ্চ অনুভব করে ও স্ফীত হয়। আর তাতে জোড়া জোড়া 
		সবরকম সুন্দর জিনিস উৎপাদিত হয়। এই বাণীরূপ যাকে কেবলই স্ফীতিকার্য বলে, 
		কখনো কখনো তা অস্ফীতিঘটনও। যেমন বৃষ্টির দিকে আমার ওই বিকেলগমনটি ছিল 
		বস্তুত স্ফীতিলোপের জন্য। সেদিনের অপরাহ্ণিক সৈকতে সুন্দরী বিজলি ছিল, 
		বজ্রের হুঙ্কার ছিল, তবু একদম টলি নি। আমাদের ঝোঁক ছিল পুরোটাই 
		মেঘমল্লাররূপী শান্তিপূর্ণ বৃষ্টিপাতে, আগুনরূপী দীপক রাগে নয়। তবু বাজিয়ে 
		দেখতে বজ্রসম্ভাবী বাচাল মেঘকে আদর করে কাছে ডাকি, গল্পগুজব করি, বলি যে এ 
		যাত্রা যাহোক একজন অলরাউন্ডার চাই, যদি অন্তত সেরকমটি হও, তাহলে আগুন হলেও 
		চল আমরা খেলি। সে জানায় যে, আক্ষরিকভাবে যাকে অলরাউন্ডার বলে তা সে নয় 
		বস্তুত। প্রথম রাউন্ডে সে বরাবরই খুব নীরব ও চিৎপাত, আকাশ জুড়ে তার শুধু 
		শুয়ে থাকা ও চটুল যত হাকডাক এবং অতি অবশ্যই তা বৃষ্টিপাতহীন। যদি বাতাস 
		এরপরও প্রবাহিত হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে এবং তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে সমর্থ 
		হয়, তাহলেই সে কেবল হ্যারিকেনরূপিণী হয়ে ওঠে। তখন সে ক্ষুধার্ত ঝড়, শুষে 
		নিতে পারে আমূল সাগর এবং সুনামি হয়ে ভাসিয়ে দিতে পারে রাশি রাশি জনপদ। ভয় 
		যদিচ আমার ধাতে নেই, তবু ভয়-ভয় একটা অনুভূতি সহসাই কাঁটা দিয়ে ওঠে মনে। ওরে 
		ব্বাপ! সংলাপ পর্বে ক্ষান্ত দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখি বৃষ্টিসম্ভাবী 
		নরম কোমল বিচূর্ণ মেঘ। শ্বেতসর্পিণীর মতো তার অবয়ব। বলি, ওগো নুন তুমি 
		বর্ষিত হও! ওগো ধুন তুমি গীত হও! সে শুরু করে খুব নিচে থেকে, ফাল্গুনি 
		বাতাস বয়ে যাবার ঢঙে। কিন্তু তা ছিল ভেজা খুব। মন্ত্রপাঠের মতো নিচুস্বরে 
		বিড়বিড় করতে করতে সে ক্রমে ভিজিয়ে দিতে থাকে, যে অংশ কখনোই কোনো বৃষ্টিতে 
		ভিজে না সে অংশসহ। ক্রমশ সে ঊর্ধ্বমুখী হলে তাকে ত্রাণকর্ত্রীর মতো লাগে। 
		উলটেপালটে তৃপ্তি না মেটা পর্যন্ত ভিজি। মনে হয় বৃষ্টি নয়, শান্তিবর্ষিত 
		হচ্ছে। হঠাৎ লোভ হয় উৎসমূলে তাকাবার। কিন্তু ও বৃষ্টি এমনই গোলবৃষ্টি যে 
		কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তার মূল কিংবা চূঁড়া। এই যা, সবখানেই তার 
		আদি, সবখানে অন্ত। শেষ নেই প্রভু তার শেষ নেই, এই নামতা জপতে জপতে গর্ভে 
		শান্তির বীজ নিয়ে এরপর হেলেদুলে কেবলামুখী হই, যে কেবলা খুঁজে পেতে 
		প্রতিবারই আমাকে প্রাণান্ত হতে হয়। 
		  
		কদমতলায় বৃষ্টিতে 
		  
		যাত্রামুখে দেখি 
		চোখবড়ো করা কালোমেঘ গায়ে লালাভা মেখে ওঁত পেতে আছে, শিলাপাতের সম্ভাবনা 
		নিয়ে। 'আকাশের শিলাস্তূপ থেকে তিনি বর্ষণ করেন শিলা, আর এ দিয়ে তিনি যাকে 
		ইচ্ছা আঘাত করেন।' শঙ্কা জাগে মনে, আমার খেতের গর্ভিণী ধানের ছড়া, আমার 
		গাছের আমের যত বোল, আমার খড়ের প্রিয় চালাঘর, এ যাত্রা সর্বনাশের সামনে 
		দাঁড়িয়ে গেল তাহলে! হঠাৎ এ-ও মনে হয়ে যায় যে, '...আর যাকে ইচ্ছা তার উপর 
		থেকে এ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন'। সহসাই এরকম বিশ্বাস জেগে ওঠে মনে যে, আমার 
		ওপর থেকে তা ফিরে যাবে অন্যদিকে, হ্যাঁ যাবেই ফিরে ইচ্ছাশক্তির বলে। এ 
		বিশ্বাস আমাকে দেন ভারতবর্ষীয় কৃষি ও আবহাওয়াবিদ খনা, তাঁর 'ধলা মেঘে গলা 
		পানি/ কালা মেঘে ছাগল দৌড়ানি' আর্যাযোগে। ঝরঝরে লাগতে থাকে নিজেকে। মেঘের 
		দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং কনিষ্ঠাঙ্গুলি দু'টোই একযোগে তুলে ধরি। বলি যে, 
		দু'টোর যেকোনোটা খুশি ঢুকিয়ে বসে থাক, শান্তি পাবে। বেচারা মেঘের লালচোখ 
		মুহূর্তে নত হয়ে যায়। ব্রেভো। গর্বে আবারো সাঁইজির চরণ জাগে পোড়া মুখে। কেন 
		যে জাগে! 'মানুষে মানুষের বিহার/ মানুষ হলে সিদ্ধ হয় তার/ সে কি বেড়ায় 
		দেশ-দেশান্তর/ যেজন পিড়েয় পেরুর খবর পায় ?' বারকয় চরণটি ভাঁজতে ভাঁজতেই 
		আমার বোরাক এসে পৌঁছায় কদমতলে। এ কদম সেদিন যে সে কদম ছিল না। নিচে তার 
		ছিল যথেচ্ছ প্রশ্রয়, কামনার ইঙ্গিত।
 ছাগল দৌড়ানি বৃষ্টির ঝটকা ঝরঝর কদমপাতা চুঁইয়ে নিচ পর্যন্ত আসতে পারে না, 
		বরং কদমফুল বরাবর পতিত যে ফোঁটাগুলো, তারা ওই নির্গন্ধ ফুল থেকেই এক ধরনের 
		মৌতাত ঝেটিয়ে বাইরে বের করে দিতে থাকে। এই আচানক মৌতাতে আমাদের জটলার 
		ত্রিভুজঘরানা দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ হতে থাকে। ক্লান্ত বিকেল সন্ধ্যার দরজায় 
		এসে কড়া নাড়ছিল যখন, তখন কদমগাছের শাখাপ্রশাখা ছাড়িয়ে পুব আকাশে চোখ পড়তেই 
		দেখা গেল বিজলীর প্রাচীন সুমেরীয় দেবী জারপেনিভকে তাঁর করিৎকর্মা স্বামীকে 
		নিয়ে যুদ্ধে চলেছেন বায়ুরথে চড়ে, দু'হাতে তাঁর দু'গুচ্ছ বজ্রবাণ। ভয়ে আমরা 
		গাছতলা ছেড়ে আলিশান এক বিজলীদণ্ডের আশ্রয়ে আসি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে মনে 
		রেখে। খোদার ওপরে খোদকারী মানুষ হামেশাই করে দেখি, কিন্তু ভরসা পায় না বলে 
		বিজ্ঞানীর ওপরে একদম নয়। তাই আমরা বাজাই না গির্জার ঘণ্টা কিংবা দেই না 
		সুরেলা আজান, বরং একটা রঙধনু দেখবার ইচ্ছায় কুত্তাবিলাই ঝরঝরানির মধ্যেও 
		উত্তরচোখে আঁড় হয়ে থাকি। জানি যে পতন রহিত হলে এহেন ধারাজলের, ক্রমে 
		আকাশমাঠে খেলে উঠবে সপ্তচক্ষু রঙ। ডেকেপেতে ক্লান্ত মিলন শেষে আড়মোড়া ভেঙে 
		দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে উঠবে বেপরোয়া একটা হলুদ পুরুষব্যাঙ, যার নরোম 
		উরুদ্বয়ের রপ্তানি পণ্য হবার দিনকাল আপাতত ফুরিয়ে এসেছে।
 
 
		ব্যাঙের বিয়ের দিন 
		  
		আহা ব্যাঙ! ('হায় 
		ব্যা' নয়!) বর্ষার সাথে তার সম্পর্কসূত্র আমি ভুলতে পারি না। ঢাকার ভূমিজলে 
		কোনো ব্যাঙ নেই বলেই না আকাশে দেখি তার ছায়া! কী নিঠুর এই বেদনা! ভাবি কত 
		বদলে গেছে আমার নাগরিক বর্ষা, ব্যাঙহীন। স্যুয়ারেজ উপচানো পচা ও দুর্গন্ধ 
		জলের স্রোত টপকে ঘিনঘিনে পথঘাট পেরিয়ে তুমি যেদিকেই যাও বাল্য-কৈশোর-যৌবনের 
		বর্ষা তুমি কোথাও পাবে না। ব্যাঙের বিয়ের কথা বাদই দাও, সোনাব্যাঙের 
		পালটাপালটি কোরাসগীতি শুনতে শুনতে কাদাখেলের আনন্দ তুমি খুঁজবে কোথায়! 
		কোথায় পাবে ব্যাঙের ছাতা! কোথায় তোমার আষাঢ়ে গল্পের পাত্র ও ক্ষণ! তবু 
		রক্ষে যে সংসারসমরে লিপ্ত থেকেও কোনো এক চোরা ভ্যান্টিলেটর পথে সংসার থেকে 
		ছুটি নিয়ে ক্রমবর্ষণ শব্দের মাঝে নিজের সাথেই নিজে আড্ডা জমিয়ে তোলার অবকাশ 
		থেকে গেছে আজো। কিন্তু কতক্ষণ আর! নিজের মুখ, চোখ, অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর সব 
		খুব পরিচিত ও ক্লিশে বোধ হলে আশ্রয়ার্থে ঘুরে দাঁড়ানো লাগে অন্য কারো দিকে। 
		ধরা যাক সামনে রবীন্দ্রনাথ, ধরা যাক বাতাস এসে খুলে দিয়ে গেছে তাঁর 'বর্ষার 
		চিঠি'র পৃষ্ঠা। হায়, তাঁরও ঠিক অবিকল দশা দেখে ভিতরে কাত হয়ে পড়ে 
		কান্নাকলসি! তাঁরও দেখি একই হাহাকার, ব্যাঙ হারাবার। "কিন্তু আজকাল ব্যাঙ 
		ডাকে না কেন ? আমি কলকাতার কথা বলছি। ছেলেবেলায় মেঘের ঘটা হলেই ব্যাঙের ডাক 
		শুনতুম, কিন্তু আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতা এল, সার্বভৌমিকতা এবং 'ঊনবিংশ 
		শতাব্দী' এল, পোলিটিকল অ্যাজিটেশন, খোলা ভাঁটি এবং স্বায়ত্তশাসন এল, কিন্তু 
		ব্যাঙ গেল কোথায় ? হায় হায়, কোথায় ব্যাস বশিষ্ঠ, কোথায় গৌতম শাক্যসিংহ, 
		কোথায় ব্যাঙের ডাক!" শেষে ভাবি, জগৎসংসারের ঐতিহ্যবাহী হাহাকারসংস্কৃতি 
		বুঝি এতটাই চিরন্তন যে তার চর্চারিক্ত কোনো সভ্যতা নেই, অসভ্যতাও ; মানে 
		বন্যতা ও বর্বরতা। এর বিস্তার যৌনাঙ্গ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত প্রসারিত এবং 
		সেটা ক্রিয়মান আছে গন্ধম ফল সেবন থেকে টুইন টাওয়ার উড়িয়ে দেয়া অবধি। 
 একলা পঙক্তির সুখদুঃখ
 
		  
		ছন্দ লিখি না আমি 
		কবিতা করতে বসে, কবিতা করি না আমি বৃষ্টি আঁকতে এসে, কিছুই করি না আমি যখন 
		কবিতা আসে-- আসে মানে কোত্থেকে আসে আমারই ভিতর থেকে, আমারই ভিতর মানে আমারই 
		সঞ্চয় সে, আমারই সঞ্চয় মানে যতটা ছুঁয়েছে আশে। ছুঁয়েছে তো কেমন সে ছোঁয়া, 
		পাথর না হৃদয় সেটা, গোল না লম্বাটে আড় ? 
 আসলে কি হৃদয়পুরী গোল মহাগোল, পৃথিবীপ্রাচীন ঘন মহাতীর্থ বলে ? তাতেই তো 
		ছাট লাগে এসে বেয়াড়া বৃষ্টির, ভিজে যাচ্ছি ভিজে যাচ্ছি আমুণ্ডু আমূল, তেমন 
		কারো নিজস্ব তোয়ালে হলে সুগন্ধ সমাহৃত, গা-মাথা মুছে ফের কাজে যাওয়া যেত। 
		কাজ মানে কাজ, দোষগুণে ভরা, বিবেচিত হাওয়াই দ্বীপে, ওয়াইয়ালিয়েলে হিলে, 
		কিংবা কাছে মেঘালয় চেরাপুঞ্জি থেকে।
 
 আকাশের বিবেচনা পাতালের উলটোয় স্থির, নদীর গানের সুর মরুভূমি বোঝে না কখনো, 
		এটা সকলেই জানে।
 
 আইতান-কাইতান
 
		  
		প্রাথমিক বিদ্যালয় 
		ছাড়িয়ে মাত্র মাধ্যমিকে যাওয়া-আসা শুরু হয়েছে তখন, ক্ষুদ্র একটা জগৎ চোখের 
		সামনে দেখতে না-দেখতে হঠাৎ কেমন বিশাল হয়ে উঠল। বয়স তখনো শৈশবেই স্থিত হলেও 
		মানসিকভাবে আমরা তাড়িত-চালিত সব চুরমার করা এক কৈশোরবোধের দ্বারা। ততদিনে 
		ধূমপানে তালিম নেয়া হয়ে গেছে, যা আজো চলমান এবং ভবিষ্যতেও না-চলবার মতো 
		লক্ষণ স্পষ্ট নয় (ভাবলে এখন খারাপ লাগে। এতটা ইঁচড়ে পাকামো একদম ঠিক হয় 
		নি!)। সঙ্গত কারণে নানারকম ফাঁকিঝুকিও রপ্ত হয়ে গেছে ততদিনে। মেঘগর্জন হয়ত 
		তুঙ্গে কিন্তু বৃষ্টির একদম দেখা নেই, আবার বিনা মেঘেই বহু বহু বজ্রসম্পাত।
 স্কুলে আসতে হতো দুই কিলো কাঁচাপথ পায়ে হেঁটে। বনেবাদাড়ে বেড়ে ওঠা 
		গেঁয়োছেলের পক্ষে দুই কিলো পথ হাঁটবার নিমিত্তে কোনো পথই নয়। ওই বয়সে 
		রোদবৃষ্টিও খুব একটা আমলে নিতাম বলে স্মরণ করতে পারি না। যেকোনোভাবে স্কুলে 
		পৌঁছবার একটা মহাতৎপরতা ছিল। স্কুলে যে বান্ধবকুলকে বাগে পেয়েছিলাম, একদিন 
		না-এলে ওদের জন্য বিরহদগ্ধতা বোধ হতো। বৃষ্টির দিনে পিছল পথে বইপত্র নিয়ে 
		আছাড় খেয়ে ওঠবার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই ছিল। তবু ন-পরোয়া। ওরকম হলে বরং 
		বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফুটবলকে ঘিরে মাঠে মেতে থাকবার সুযোগ তৈরি হতো। তাই 
		বৃষ্টির কারণে স্কুলে না-এসে ঘরে বসে থাকা ছিল দারুণ এক ক্ষতিকেই স্বীকার 
		করে নেয়া। এরকম মানসদেশকাঠামোয় এক আশ্বিন শেষে দাদু জানান দিয়েছিলেন, 
		আইতান-কাইতানের কথা। নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এরকম দিনে স্কুলে যাবার দরকার 
		নেই। আইতান-কাইতান কী দাদু ? 'ওরা দু'জন অনাথ ছেলেমেয়ে, ভাইবোন। কাইতান 
		মেয়েটা নিরীহ, ধরে নিয়ে গেছে দস্যুরা। ওর কান্নাই তো ঝরছে পুরো আশ্বিন 
		জুড়ে। আর আইতান খুব রাগী ছেলে। বোনকে দিনের পর দিন খুঁজে ফিরছে পথেঘাটে। গত 
		ক'দিন থেকে যে ঝড়বাতাস দেখছিস ওটা ওরই যাতায়াতের ফল।' আমরা ওদের দেখি না তো 
		? 'আমরা কি ভূত-প্রেতও দেখি ? দেখি না। কিন্তু বাগে পেলে তো ওরা ঘাড়টা ঠিকই 
		ভেঙে দেয়।' অন্য কোনো কারণে নয়, ঠিক এই ঘাড়ভাঙার ভয়ে সেবার 
		আশ্বিনশেষ-কার্তিকশুরুতে বেশ কদিন স্কুলে অনুপস্থিত থেকে আইতান-কাইতানকে 
		অনেক ভেবে উঠেছিলাম। নিজের ছোট বোনকে কাইতান ভেবে কল্পিত অপহরণকারীদের 
		প্রতি এমন ক্ষ্যাপামো তৈরি হয়েছিল যে মনে হয়েছিল আইতানকে একবার সত্যি সত্যি 
		দেখতে পেলে ওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাইতানকে উদ্ধার করে আনবই এবং অপহরণকারীদের 
		দেব ভয়ানক এক শিক্ষা!
 
 আশ্বিন-কার্তিকের গ্রামপথগুলো অনাথ কাইতান বালিকার ক্রন্দনে আজো প্রতিবারই 
		সিক্ত হয়ে ওঠে, ক্ষ্যাপা বালক আইতানের ক্ষ্যাপামোতে চুরমার হয়ে যায় অনেক 
		ঘরবাড়ি, গাছপালা। অপহৃত বোনকে অন্বেষণ তার ফুরায় নি আজো। এই খোঁজাখুঁজি 
		তার কতদিন ধরে চলবে গো! বুড্ডিস্ট মঙ্কেরা কি জানেন, যারা গোটা 
		'ভাস্যা'জুড়ে বাড়ি বাড়ি দান আহরণ করে ফিরেন, প্রার্থনার অংশ হিসেবে ?
 
		ড্রিজলিং অ্যান্ড প্রেসিপিটেশন
 
		  
		বোর্ডিং পাস সংগ্রহ 
		করে লাগেজ লিভিং শেষে ডিজঅ্যাম্বারকেশনের জন্য ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান 
		বন্দরের মোবাইল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাবার পথে, প্যাসেজে, সহসাই দু'টো 
		সদাহাস্য একা চোখের সাথে দেখা হয়ে যায়, যে দু'টো লাগাতার কথা বলেই চলেছে 
		মনে হলো। জানতে চাই, হয়্যার আর ইউ ফ্রম ? 'বাংলাদেশ।' আর ইউ এলোন ? 'নো, আই 
		এম উইথ মাই ড্যাড অ্যান্ড মম।' ও, আই সি। হয়ার আর দে নাও ? 'ড্যাড ইজ ইন 
		বোর্ডিং পাস কালেক্টিং লাইন অ্যান্ড মম ইজ ইন মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টার।' 
		ওকে, নাইস টু মিট ইউ। 'ইটস মাই প্লিজার।' থ্যাঙ্কস। 'উই আর গয়িং টু এরাইভ 
		ইন দ্য সেইম ফাইট, সো, সি ইউ এগেইন।' ইট উইল বি ফাইন।
 কাউন্টার থেকে ছাড় পেতে পেতে লাইনে থাকতেই দোতলায় আবার দেখা। অসাধারণ এক 
		হাসিতে অভ্যর্থনা জানাল সে। ওয়েটিং রুমে বৃষ্টিদেবতা আমাদের পাশাপাশি বসবার 
		বন্দোবস্ত করে দিলেন। 'জানেন না তো, আমরা যেতে চেয়েছিলাম হিমালয়ে, কিন্তু 
		শেষপর্যন্ত পোখরা থেকেই ফিরতে হয়েছে। এত বৃষ্টি বাপের জন্মে দেখি নি। সবাই 
		খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, তাই হেলিকপ্টার ওড়ে নি। অতৃপ্ত হয়ে ফিরছি।' 
		আমিও কম যাই না। বলি, আমার অতৃপ্তি বিস্তৃত হয়ে আছে রামগিরি থেকে অলকা 
		অবধি। রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, কালিদাসের মহাভারত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, 
		বৈষ্ণব কবিতার একটা বড়ো অংশ কিংবা রবীন্দ্রনাথের অজস্রাজস্র কবিতা হাতড়েও 
		তুমি এত হাহাকার পাবে না। যেমনটি বুকে নিয়ে আমি ফিরছি। এমনকি আমার বৃষ্টিও 
		হয় নি দেখা। এ দেশের রাজতন্ত্র ফুরাল, কিন্তু বিরহভাব, কই ফুরায় নি 
		মানুষের। রাজাহীন রাজকীয় হোটেলের ছাদের নিচের দ্বিদিবসিক সেমিনারের 
		হাহাকারই ছিল মূল স্তোত্র। এরকম বাজে ভ্রমণ আর হয় না জানেন। সম্পূর্ণ বাজে 
		অবশ্য বলা যাবে না এখন, আপনার সাথে দেখা হবার পরে। 'আমাকে তুমি বলুন, 
		প্লিজ! মাত্র ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছি।' ও-কে, মনে হচ্ছে যেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় ঠেস 
		লেগে গুঁড়িয়ে যাওয়া মেঘের থেকে আসা বৃষ্টিদলের ছোঁয়াটা এই এখন মাত্র বাগে 
		পাচ্ছি তোমার মারফতে। এই যে এখন বন্দর জুড়ে ড্রিজলিং হচ্ছে, ধারণা করি 
		সেটাও ওই তোমারই কল্যাণে। নইলে কাঠমান্ডুতে চারদিনেও বৃষ্টি দেখব না ময়ুরের 
		মৈথুনঋতুতে, এটা কেমন করে হয়! দেখ, তোমার সম্মানে নামা ড্রিজলিং থাই 
		এয়ারওয়েজের সদ্য ল্যান্ড করা বিমানটির আজদাহা শরীরে আদুরে পরশ বুলিয়ে 
		দিচ্ছে। 'জানেন, ওই যে বন্দরের চারপাশের পাহাড়গুলো, এই মিষ্টি ড্রিজলিংয়ের 
		ভিতর কেউ একজনের হাত ধরে ওইদিকে হাঁটা দেয়া গেলে দারুণ হতো।' সে তো বটেই, 
		আমার দিক থেকেও দারুণ হতো না কি! গিয়ে হয়ত দেখতাম ঘাসের ওপরে রক্তবর্ণ সব 
		মখমল পোকার উৎসব। কিন্তু সে তবু হবার নয়! বরং চলো ঢাকাতেই কোনো ঘোল খুঁজে 
		নেব খন, এহেন দুধের বদলে। স্প্রাইটের জামা পরা ভ্যালেন্টাইনস স্কচ গলায় 
		ঢেলে মনে মনে ঢাকার ঘোলঘরগুলোই তখন ভাবতে থাকি কেবল। যেন হয়ে উঠি বর্ষার 
		দূত, চাতকপাখি, যার এটা প্রজননঋতু।
 
		কথোপকথনকে ছাড়িয়ে
 
		  
		'আপনি কি লেখক-শিল্পী 
		গোছের কেউ ?' ড্রিজলের মমের প্রশ্নে যাহোক একটা কুল খুঁজে পাওয়া যায় 
		ভাবনাসমুদ্রে, নইলে কোথায় যে তলাতাম গিয়ে। বললাম, হ্যাঁ একাধটু লিখতে 
		চেষ্টা করি। গোটাকয় বই আছে আমার। সব শেষেরটি বিনীথ দ্য রেইনট্রি, 
		সদ্যপ্রসূত। ব্যাগ হাতড়ে দেখি, আছে একটি কপি। লিখে দেই ড্রিজলের নামে। মম 
		উচ্ছ্বসিত হয়ে ডেডের দিকে ফিরে বলেন, 'জানো, লোকটা-না একজন কবি!' ড্যাড 
		কার্ড বাড়িয়ে দেন। আমারটাও দিই তাঁকে। 'আসবেন আমাদের বাসায়, ভালো লাগবে।' 
		জি আচ্ছা। মম গলা বাড়িয়ে বলতে লাগেন, 'আমাদের ফ্যামিলি খুবই সংস্কৃতিমনা। 
		জানেন, ছোটবেলায় আমি খুব অভিনয় পাগল ছিলাম। বাবা যদিও কখনো অভিনয় করতে দেন 
		নি। কিশোরগঞ্জের মতো মফঃস্বলে ভদ্রলোকের মেয়ে নাটক করবে, লোকজন বলবেটা কী! 
		এসব বলেকয়ে বাবা আমাকে নিরস্ত করতেন। এখন দিন অনেক বদলে গেছে। তাছাড়া 
		মফঃস্বল ছেড়ে আমরা এখন স্থায়ী হয়েছি রাজধানীতেই। আমাদের মেয়ে লিখতে, গান 
		গাইতে বা অভিনয় করতে চাইলে আমরা মোটেই বাধ সাধব না।' বাধ সাধাটা উচিত নয় 
		ওকে, এই বয়সে। কেন তা করতে যাবেন। ওর যা ইচ্ছে হবে তাই করবে। 'আপনি অভিনয়ও 
		করেন বুঝি ?' মাঝে মাঝে। 'আপনাদের কোনো নাটক হলে আমাদের জানাবেন, আসবো।' 
		আমি তো কোনো দলে কাজ করি না। বন্ধুদের নাট্যদল আছে, নিজেকে ওদের দলের একজন 
		ভাবি, ওরাও ভাবে আমাকে। এই দল মাঝে মাঝে প্রোডাকশনে যায়। তখন খবর দিতে 
		পারি। 'হ্যাঁ দেবেন, আমরা দেখতে যাব।' জি আচ্ছা।
 বিমান যখনই মেঘের ভিতরে সেধে গেল ঘোষিকা জানান দিল যে, 'ক্যাপ্টেন ইজ ফেসিং 
		সাম প্রব্লেম ফর রাফ ওয়েদার, প্লিজ টাইট ইউর সিট বেল্ট।' চোখ ছিল তখন দূরে 
		হিমালয়ের দিকে। শুনে গা হিম হয়ে গেল। ভুলে গেলাম ড্রিজল এবং তার মম-ডেডকে। 
		ভুলে থাকতে থাকতেই ল্যান্ড করি জিয়ায়। নেমে ড্রিজলের মুখের স্থায়ী হাসিটা 
		না-দেখে খুব দমে যাই। ভাবতে থাকি, এটা বুঝি ওই ভুলে থাকারই খেসারত। লাগেজের 
		জন্যে অপেক্ষার সময় পাশে এসে দাঁড়ায় সে। একা। 'বাসায় এলে খুব খুশি হব।' আগে 
		তো ফোন করি, পরে না-হয় কখনো যাওয়া যাবে। 'আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখবেন 
		না!' ও হ্যাঁ, রাখা হয় নি তো। আমি আগ্রহী, কিন্তু আমার মোবাইলে চার্জ নেই 
		যে, সেভ করি কীভাবে। 'কাগজেই লিখে নিন না।' হ্যাঁ বল। '০১৭১৭......'। 
		থ্যাঙ্কস। 'মাই প্লিজার!'
 
 এরপর আমরা অজস্রবার ড্রিজলিং ও প্রেসিপিটেশন মাথায় নিয়ে হাতে হাত ধরে 
		হেঁটেছি, স্বর্গ থেকে নরক অবধি। পিচের রাস্তা থেকে মাটির রাস্তা, ঘাসের 
		রাস্তা সব দিয়ে চিত্রকূট পর্বত অবধি। বাস্তবে ও স্বপ্নে। কিন্তু ত্রিভুবন 
		বিমান বন্দর ঘিরে থাকা গাছময় পাহাড়গুলোর ভেজা হাতছানি এখনো মনের মধ্যে রয়েই 
		গেছে। আমরা কি আবার ল্যান্ড করব কখনো, ওই বন্দরে, মাত্র দু'জন! এরই মধ্যে 
		একদিন রাত সোয়া এগারোটা থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল ড্রিজলের সঙ্গপ্রণোদনা, 
		ছিঁড়ে গেল ভিতরগত যোগসূত্র। আমরা চিরকাল যেরকম একা ছিলাম, আবারো হয়ে গেলাম 
		তেমনি নিঃসঙ্গ বেদনাবৃক্ষ।
 
		নিজের কাছে নিজে
 
		  
		পৃথিবীর 
		সর্বপশ্চিমপ্রান্তের অন্যতম পর্বতচূড়া ওয়াইয়ালিয়েলেকে চেরাপুঞ্জিরও আগে 
		স্থান দিতে যাদের মন উশখুশ করে বৃষ্টিসংক্রান্ত অ্যাজেন্ডায়, তাদের জন্য 
		চেরাপুঞ্জির ১১,৪৩০ মিলিমিটারের পাশে বছরে (৩২ বছরের গড় ধরে) ১১,৬৮৫ 
		মিলিমিটার বা ৪৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের তথ্য তুলে ধরা চমকে দেবার নামান্তর, 
		যেখানে এই পর্বতচূড়ার মাত্র কয়েক মাইল দূরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড 
		মাত্র ২৫০ মিলিমিটারে নেমে আসে। এটুকু তথ্যসম্পদ নিয়ে আমি ভেজা একটি পত্র 
		রচনার যে উদ্যোগ নিয়েছি গোপনে গোপনে, তাতে অ্যাসিডবৃষ্টি কিংবা বিপরীতপক্ষে 
		ঘোর খরার সম্ভাবনাই একঅর্থে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। আনাড়ির অস্বাভাবিক এই 
		বৃষ্টিবন্দনা কি শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাবে না বিদ্যমান সব ফ্লোরা ও ফিউনার 
		বিরুদ্ধে ? এ যদি সত্য হয় তবে জোছনারাতে পিচের আদর বুলানো ছাদে ঘন 
		প্রেসিপিটেশনের মধ্যেও যে আমি কোটি কোটি বেলীফুল ছড়িয়ে পড়ার আনন্দ খুঁজে 
		পাই, সেই মিথ্যার লেজ ধরে এরকম একটি নামতা জপে যাওয়া ছাড়া বস্তুতপক্ষে 
		উদ্ধারের আর কোনো জানালাই আমার সামনে খোলা নেই। 'মেঘের মধ্যে মাগো যারা 
		থাকে/ তারা আমায় ডাকে আমায় ডাকে।' 
		* 
		* 
		* 
		  
		
		প্রবন্ধযাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ
 
 *
 
		* 
		
		আর্কাইভ
 
 Best view with 
		Microsoft Internet Explorer
 font download link
 
		
		
		http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf |