নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি।

Humaira Haroon , Suprateek Aroop Ghosh, Nauba Aloke Bangla

সম্পাদক

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

পাঠক পরিষদঃ চঞ্চল চৌধুরী, শুভলগ্না শোয়ারা

কৃতজ্ঞতাঃ শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য্য

 

 বিশ্বকবির সার্ধশত জন্মবর্ষ (২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ -১৪১৮ বঙ্গাব্দ)

উপলক্ষে এবারের প্রকাশনা

 

প্রণতি রবীন্দ্রনাথ

সম্পাদকীয় - ২৬
রবিকবি ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী

আজ থেকে একশ’ পঞ্চাশ বছর আগে মানুষের জীবনে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছিল। সেই বিপ্লব মানুষের অন্তঃকরণে ঝড় তোলে সদানিয়তঃ আবার মানুষকে প্রেমের জোয়ারে ভাষায় অবিরাম অন্তর্বারিধারায়! সেই বিপ্লব প্রকৃতির সঙ্গে নতুন করে মানুষকে সম্পৃক্ত করে। সেই বিপ্লব পরমেশ্বরের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করে, ভক্তিস্রোতাবহ করে তোলে মনকে, মানুষের অন্তরের ছেঁড়াতারে সুর বাঁধতে শেখায় সেই বিপ্লব! সেই বিপ্লবের নাম রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে বুঝতে ভাষার বা সাম্রাজ্যের বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়না। তিনি জন্মে ছিলেন পঁচিশে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে জোড়াসাঁক ঠাকুর বাড়িতে।
খুব জানতে ইচ্ছে করে বর্তমান প্রজন্মের কর্ণধার যারা বা যারা আগতদিনের সমাজকে চালাবেন তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় কি, কেমন, তারা রবীন্দ্রনাথকে কি ভাবে চিনলেন, জানলেন বা জানলেন কি আদৌ!!! খুব শঙ্কা হয় মনে! কেন? রবীন্দ্রনাথকে আজও সারা পৃথিবী জানার চেষ্টা করে চলেছে আর তাঁরই উঠোনে এখন এফ এম এ ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ রক গান শুনতে হয় ! কি আতঙ্কের দিনে বাস করে শ্বাস নিচ্ছি! সম্পাদকীয় ছন্দাবলী-৯ তে লিখেছিলাম আজ আবার সেখানেই ফিরে গেলাম কিছু নতুন আশা নিয়ে...


পঁচিশে বৈশাখ কি শুধুই একটা দিন
কালান্তরে সময়ের গর্ভে হয়ে যায় বিলীন!
রবীন্দ্র সদনের সিঁড়িতে বসে কপোত কপোতী
ভেতরে ব্যস্ত সব গুণীজন সব রবীন্দ্রচর্চার স্থপতি
মানুষ জন্মের সর্ববোধবিপ্লবের এই হাল কেন হল বুঝিনা
২৫শে এখন রবীন্দ্র সদনে বা শান্তিনিকেতনে কি হয় জানিনা
এখনও কি বাঙ্গালীরা রবীন্দ্রনাথ পড়ে
তাঁরা কি কবি পথে নড়া চড়া করে
নব আলোকে বাংলার রবি কবি নভো সংখ্যা বেরলো
অনেক আশা ও ক্ষেদের সুর নিয়েই এবার রবিকবি এলো
সেদিন এক এন-আর-আই বাঙ্গালির বাড়িতে আকাশ ভরা সূর্যতারা
কোনও বাংলা ব্যান্ডের গান তাই নিয়ে বচসা শুনতে হলো সন্ধ্যা সারা
আজ কি মা-বাবারা রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় করান না
একবারও কি তাদের বোধ-আয়নার সামনে দাঁড়ান না
তবুও আশা আমাদের রবিকবি আছেন
তিনি বিপ্লব হয়েই ছিলেন ও থাকবেন
সবার হৃদয়ে তুমি রবীন্দ্রনাথ আছ-ছিলে-থাকবে
তুমি সর্ববোধবিপ্লব হয়েই বিশ্বচিত্তে জাগ্রত থাকবে
সকাল,দিন বা রাতকে সবাই যে চোখেই দেখুক সূর্য কিন্তু একটাই
আমাদের সারা জীবনের পঁচিশে বৈশাখ হে গুরুশ্রেষ্ঠ তুমিও এক জনাই
রবীন্দ্রনাথ পড়ুন, তাঁকে জানুন বলে আর অনুরোধ করব না, ঠিক করেছি
অর্ন্তরবোধ বিপ্লবের অবমাননা থেকে দূরে থেকে আসুন, রবিকবিকে নিয়েই বাঁচি!

আপনাদের সুপ্রতীক

২৫ শে বৈশাখ ১৪১৮

প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মারজোরি কিনান রোলিং: চিন্তা-চেতনা ও অনুভবের এক অভিন্ন সমীকরণ

মোজাফফর হোসেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের ব্যাপ্তীকাল ছিল ১৮৬১-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান, ও প্রবন্ধে তাঁর মেধা ও গভীর জীবন দর্শনের যে পূর্ণতা ঘটেছিল তা তাঁর ছোট গল্পে এসে অনেকখানি উপচে পড়েছে। প্রায় ১১৯ টির মত ছোট গল্প লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে ‘পোস্টমাস্টার’ পাঠকদের মনে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
অন্যদিকে গভীর জীবন বোধ সম্পন্ন আমেরিকান আরেক গল্পকার মারজোরি কিনান রোলিং Marjorie Kinnan Rawlings, (১৮৯৬-১৯৫৩) সাহিত্যের সব শাখায় পদচারণা না করলেও গল্প ও উপন্যাস (The Yearling) লিখে বিশ্ব সাহিত্যে বেশ সম্মানের সাথে ঠাঁই পেয়েছেন। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ২৮ টি  যা রবীন্দ্রনাথের তুলনায় বেশ কম। বহুদিক থেকে অমিল থাকা সত্বেও মারজোরি কিনান রোলিং এর ছোটগল্প ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ (A Mother in Mannville) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ উভয়ের মধ্যে এনে দিয়েছে চিন্তা, চেতনা ও অনুভবের এক অসম্ভব ঐক্য।
 

রোলিং ইংরেজি সাহিত্যে ছোটগল্পের এক দক্ষ কারিগর হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর গল্পের বিশেষত্ব হচ্ছে : মানুষের সাথে পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের শৈল্পিক উপস্থিতি। তিনি প্রকৃতির মাঝে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন; তাইতো প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে ফ্লোরিডা থেকে ছুটে যেতেন দক্ষিণ ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের নিশ্চুপ-ছন্দময় প্রকৃতির মাঝে। অনেকে মনে করেন, লেখিকা এখানে জেরি নামক একটি অনাথ শিশুর সাক্ষাৎ পান এবং যার জন্য তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেন। ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে একজন শিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকেই লেখিকা জেরির আবেগ অনুভূতির স্বার্থক বহি:প্রকাশ ঘটান।

জমিদারি তদারকি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান, পরিচিত হন বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও মানুষের সাথে, যার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর প্রতিটি গল্পে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিছক মনগড়া কাহিনী নয়- বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পেয়েছেন এই গল্পের চরিত্রগুলোর পরিচয়। যে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি নিজে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, 'পোস্ট মাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।' অন্যত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখন ঘটে নি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।’ একই মনোভাব তাঁর আরও একটি উক্তিতে ফুটে ওঠে, ‘আমি একটা কথা বুঝতে পারি নে, আমার গল্পগুলোকে কেন গীতিধর্মী বলা হয়। এগুলো নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তা তো করি নে আমি।’ বাস্তবতার স্পর্শ থাকে বলেই ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র রতন ও জেরির আবেগ-অনুভূতি পাঠকদের বিশেষভাবে নাড়া দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি লেখেন ১৮৯১ সালে আর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটি লেখা হয় ১৯৩৬ সালে। দুটি গল্পে পরিবেশ, কাল ও পাত্র ভিন্ন হলেও পরিসীমা, প্রকাশভঙ্গি, ঘটনার প্রবাহ, চরিত্রের পারস্পরিক  দ্বন্দ্ব ও বোঝাপড়া, জীবনদর্শন এবং সর্বোপরি পাঠকের বেদনা ও আত্মপোলব্ধিতে আশ্চর্যরকমের ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পদুটি শুরু হয় দুটি চরিত্রের নতুন পরিবেশে আগমনের মধ্যে দিয়ে।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টার কলকাতার ছেলে, নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে এসে তাকে থাকতে হয়। এখানে তার সঙ্গী বলতে পিতৃ-মাতৃহীনা অনাথ বালিকা রতন ছাড়া আর বিশেষ কেউ হয়ে ওঠে না। ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখিকা ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে কয়েকটি লেখা শেষ করার উদ্দেশ্যে ছুটি কাটাতে যান; যেখানে জীবনের আনাগোনা খুবই কম, কান পাতলে শোনা যায় প্রকৃতির ফিসফাস। এখানে এসে লেখিকা জেরি নামক এক বালকের সাথে পরিচিত হন; জেরি হয়ে ওঠে লেখিকার খুব কাছের একজন।
 


দুটি গল্পে চারপাশের চিত্র ও চরিত্রকে স্বল্প পরিসরে স্পষ্ট ভাবে অংকন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে নিয়ামক হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে প্রকৃতির মাঝে ডুব দিয়ে অনুভব করতে হয় গল্পের প্রধান চরিত্র- পোস্টমাস্টার আর রতনের অনুভূতি। গল্পের কাহিনীর শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে। পোস্টমাস্টার শহরের ছেলে তাই নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে এখানে থাকতে হয়। অন্ধকার আটচালার মধ্যে তার অফিস; দূরে একটি পানা পুকুর আছে যার চারিধার জঙ্গলে ঘেরা। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব না ঘটলেও পোস্টমাস্টারের অবস্থা ডাঙায় তোলা মাছের মতন। গ্রামের মানুষজনের ভদ্রসমাজের আচার-রীতি জানা নেই, এছাড়াও নিকটে নীল কুঠি থাকায় অনুমান করা যেতে পারে, গ্রামে ইংরেজদের শাসন ও শোষণ দুটোই বিদ্যমান। তাইতো পোস্টমাস্টারের সাথে বাইরের জগতের কোন যোগসূত্র থাকে না। হাতে কাজ না থাকলে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন, তাতে প্রকৃতির স্তব গান রচিত হয় ঠিকই- 'কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস- গাছগুলো কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।'

সন্ধ্যায় যখন গ্রামের গোয়ালঘর থেকে ধূপের ধোঁয়া রাজ্যভ্রমণে বের হয়, ঝোপে ঝাড়ে ঝিল্লি ডাকে, নেশাখোর বাউলের দল উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠে; আবার যখন- বর্ষায় ‘মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস’ বইতে থাকে এবং ভেজা প্রকৃতির গন্ধে মাতাল হয়ে একটি পাখি তার ‘একটানা সুরের নালিশ ...করুন সুরে বার বার আবৃতি’ করে তখন পোস্টমাস্টারের মন প্রিয়জনদের জন্য আনচান করে ওঠে। এ যেন প্রকৃতির সাথে ব্যথার আত্মার আত্মীয়তা !

আবার পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে, ‘আর আসব না’। তখন তাদের গভীর নিরবতা ভেঙ্গে, ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করে একটি মাটির সরার উপর টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়তে থাকে। প্রকৃতি আর মানব হৃদয় যেন একই সুরে গাঁথা! তাইতো পোস্টমাস্টার যখন রতনকে রেখে নৌকায় ওঠে- বর্ষায় প্লাবিত জলরাশি পোস্টমাস্টারের চোখের অশ্রুর মতো ছলছল করতে থাকে, পোস্টমাস্টারকে জানিয়ে দেয় রতনকে সঙ্গে আনার কথা, একইসাথে পালের হাওয়া ও অনুকূল স্রোতধারা নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারের বেদনাহত হৃদয়কে জানান দেয়- বিচ্ছেদই জীবনের চিরন্তন সত্য।

দুটি গল্পেই, বিদায়ী যাত্রায় প্রকৃতি পোস্টমাস্টার ও লেখিকার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পোস্টমাস্টারের নৌকা অনুকূল স্রোত ও পালের হাওয়ায় দ্রুততার সাথে গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয়। এবং লেখিকা গাড়িতে চড়ে অনুধাবন করেন-“The sun was in the west and I should do well to be out of the mountains by nightfall”

‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে উপমা (Simile) ও রূপকের (Mataphor) মাধ্যমে। গল্পের শুরুতে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের চিত্র আঁকা হয়েছে এ ভাবে-
'fog hides the Mountain peaks, the snow swirls down the valleys, and wind blows so bitterly that the orphanage boys…reach the door with fingers stiff in an agony of mumbness..'
লেখিকা জেরির শৈল্পিকভাবে কাঠ কাটার শব্দকে তুলে ধরেছেন এভাবে-
'The sounds no more of an interruption than a consistence rain.'
এবং জেরি যখন কাঠ চেরাই শেষ করে লেখিকার কেবিনের দিকে উঠে আসে তখন প্রকৃতির অবস্থা তুলে আনা হয় এভাবে-
'The sun was dropping behind the farthest mountain and valleys were purple with something deeper than the asters.'
লেখিকা জেরির স্বরূপ বর্ণনাতেও রূপকের ও উপমার আশ্রয় নেন- ' His hair was the colour of the corn shocks, and his eyes, very direct, were like the mountain sky when rain is pending-gray…' এবং 'light came over him, as though the setting sun had touched him with the same suffused glory with which it touched the mountains.'
'A curtain lifted, so that I saw deep into the clean well of his eyes and gratitude was there, and affection, soft over the firm granite of his character.'
এছাড়াও লেখিকার চলে যাবার কথা শুনে জেরির নিরবে চলে যাবার দৃশ্যটি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
'... a new moon hung over the mountain, and I watched him go in silence up the hill.' এমনিভাবে লেখিকা রোলিং 'এ মাদার ইন ম্যানভিল' গল্পে দক্ষতার সাথে শৈল্পিক উপায়ে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
 

অনাথ শিশু রতন ও জেরি- এই দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পদুটি আবর্তিত হয়। রতন নিজের সম্পর্কে খুব বেশি বলে না, চাইলেও বাবার সন্ধ্যাবেলার ঘরে ফেরার দৃশ্য ও ছোটভাইয়ের সঙ্গে মিছামিছি মাছ ধরার খেলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে না তার; তাইতো পোস্টমাস্টারের পারিবারিক গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে এবং আলাপচারিতায় চিরপরিচিতের ন্যায় পোস্টমাস্টারের পরিবারের সকলকে ‘মা দিদি দাদা’ বলেই সম্বোধন করে। রতন আর পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক তখন আর প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক থাকে না; বয়সের পার্থক্য ও শ্রেণী বৈষম্য ঘুচে গড়ে ওঠে মানবিক সম্পর্ক।

লেখিকা ও জেরির মধ্যেও অভিন্ন সমীকরণ লক্ষ্য করা যায়।তবে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু মাত্র গল্প কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ (3rd person narrative)

হওয়ায় রতনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তেমন করে ফুটে ওঠে না যেমন করে 'এ মাদার ইন ম্যানভিল' গল্পে জেরির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। 'এ মাদার ইন ম্যানভিল' গল্পে মারজোরি কিনান নিজেই অন্যতম প্রধান চরিত্র (1st person narrative)। তাই জেরিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন- গল্পটি অনেকাংশে হয়ে ওঠে চরিত্র নির্ভর।

জেরির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে যখন জেরি লেখিকার confusion দূর করতে বলে-
' Size don’t matter chopping wood.' এবং জেরির সততা ও স্বাধীনচেতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন হাতল ভাঙ্গা কুড়াল দেখিয়ে লেখিকাকে বলে- I’ll pay for it, I broke it. I brought the axe down careless.' তখন লেখিকার ব্যবহৃত 'Integrity’ শব্দটি জেরির ক্ষেত্রে যথার্থই মনে হয়। এছাড়াও উপহার পেলে জেরি একবার উপহার, একবার লেখিকার দিকে তাকায়-ধন্যবাদ শব্দটির উপস্স্থিতি যেন তার অভিধানে নেই; লেখিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করেন তার কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতার এক মিশ্র অনুভূতি।

 

শিশুদের সাথে পরিবারের সম্পর্ক শক্তিশালী ও অবিচ্ছেদ্য। মা-বাবা ও ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাদের শিরা উপশিরায় বয়ে আনে অপার আনন্দ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এবং রোলিং তাঁদের গল্পের উপজীব্য হিসেবে তুলে নিয়েছেন অনাথ শিশু -রতন আর জেরিকে। গল্পে দুজনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে-
‘মেয়েটির নাম রতন বয়স বারো-তেরো।’(পোস্টমাস্টার ) এবং
‘his name was Jerry; he was about twelve years old and he had been at the orphanage since he was four.’ (এ মাদার ইন ম্যানভিল )।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভালোবাসার কাঙাল হওয়ার দরুন রতন ও জেরি খুব সহজে তাদের মনিব পোস্টমাস্টার ও লেখিকাকে আপন করে নিয়েছে।

রতন তার দাদাবাবু অর্থাৎ পোস্টমাস্টারের পরিবারের গল্প শুনে নিজেকে সেই পরিবারের একজন হিসেবে ভাবতে থাকে। পোস্টমাস্টারের সেবায় সে তার বালিকা হৃদয় উজাড় করে দেয়। রান্না করা, গোসলের পানি আনা, তামাক সাজার কাজগুলো এত মনোযোগ ও ভালোলাগার সাথে করে যে কাজগুলো করে এতটুকু ক্লান্তি বোধ করে না। পোস্টমাস্টার রতনকে পড়ালে রতন বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে; রতন পড়াশুনার মর্ম উপলব্ধি না করলেও দাদার আগ্রহে যাতে কমতি না ঘটে সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হলে রতন তার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেয়। বালিকা রতন আর তখন বালিকা থাকে না। ‘সেই মুহূর্তে সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল’। রতন ডাক্তার ডেকে আনে, যথাসময়ে ঔষধ খাওয়ায়, সারারাত শিয়রে জেগে থাকে আর থেকে থেকে জানতে চাই, ‘হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি?’ রতন দাদাবাবুর সান্নিধ্য পাবার জন্য ঘরের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সুযোগ পেলেই একজন যথার্থ শ্রোতার বেশে দাদাবাবুর হাটুর কাছে বসে পড়ে। এই সখ্যতার সূত্র ধরে গল্পের শেষের দিকে পোস্টমাস্টার চলে যেতে চাইলে রতন একবুক আশা নিয়ে পোস্টমাস্টারের সঙ্গী হবার আশা ব্যক্ত করে।

একইভাবে, জেরি এবং লেখিকার সম্পর্কও তথাকথিত মনিব ও ভৃত্যের সম্পর্ক ভেঙ্গে নতুন এক সম্পর্কের জন্ম দেয়। কাঠ চেরাই করার জন্য জেরিকে ঠিক করা হলেও সে সার্বিকভাবে লেখিকা ও তাঁর কুকুরটির খোঁজ খবর রাখে। লেখিকা যাতে বৃষ্টির মৌসুমে শুকনো কাঠ পায় সে জন্যে কিছু কাঠ গর্তে সরিয়ে রাখে, এছাড়াও লেখিকার হাঁটার পথে একটি পাথর পড়ে থাকলে জেরি গর্ত করে সেঁটে দেয়, যে কাজগুলোকে লেখিকা বলেছেন ‘..unnecessary things…done only by the great of heart.’ সময়ের পরিক্রমায় জেরি ও লেখিকা পরস্পরের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। জেরিও রতনের মতন লেখিকার সান্নিধ্য পাবার জন্য কেবিনের বাইরে ঘোরাফেরা করে এবং সুযোগ পেলেই লেখিকার পাশে বসে পড়ে। গল্পে বেশ কয়েকবার এই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে -
' He made simple excuses to come and sit with.'
' He sat by fire with me.'
' He came everyday…and stayed to talk.'
' He would lie on the floor…and wait quietly for me.'

একরাতে জেরি খুব আবেগপ্রবন হয়ে লেখিকাকে বলে - ‘you look a little bit like my mother', যে ম্যানভিলে বাস করে এবং প্রতি বড়দিন ও জন্মদিনে তাকে উপহার পাঠায়। জেরি গর্বের সাথে বলে, গত বড়দিনের আগেরবার তার মা তাকে একজোড়া জুতা উপহার দিয়েছে এবং আরো জানায়, লেখিকার দেওয়া এক ডলার টাকা দিয়ে সে তার মাকে একজোড়া হাত মোজা কিনে দেবে। গল্পের শেষে লেখিকার প্রতি জেরির ভালোবাসা আরো তীব্রভাবে ধরা দেয় যখন মিস ক্লার্ক বলেন, ‘He has no mother. He has no skates.'
জেরি লেখিকাকে তার ম্যানভিলে বসবাসরত মায়ের গল্প শোনায়, যে প্রকৃতপক্ষে তার স্বপ্নে বাস করে, কারণ সে লেখিকার মধ্যে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। জেরি লেখিকার ভেতরের মাতৃত্বকে ছুঁতে চায় সর্বাঙ্গে। জেরি লেখিকা ও তাঁর পোষা প্রাণীটিকে জীবনের একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়রূপে ভাবতে শুরু করে এবং লেখিকাকে তা অবগত করাতে সাধ্যমত চেষ্টা করে।
একইভাবে, পোস্টমাস্টার গল্পে রতন তার নারীসুলভ আচরন দিয়ে পোস্টমাস্টারের হৃদয়ে পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিতে চায়।
এখানে রতন ও জেরির প্রতি পোস্টমাস্টার ও লেখিকার ভালোবাসা দায়িত্ববোধ ও করুনা থেকে নিঃসৃত কিন্তু তাঁদের দুজনের প্রতি রতন আর জেরির যে ভালোবাসা তাতে কোন খাদ নেই; অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে এ ভালোবাসার স্রোতধারা প্রবাহিত - সমাজের চিরন্তন কোন নিয়মের ছাঁচে পিষ্ট হয়ে নয়।
 


 

‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের সমাপ্তির দিকে এসে পাঠকদের হৃদয়ে একই ব্যথার সুর অনুরণিত হয়। পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে, ‘রতন, কালই আমি যাচ্ছি।’ এবং লেখিকা জেরিকে, ‘I am leaving tomorrow’ রতন আর জেরি যেন বাক হারিয়ে প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নির্লিপ্ত ভাবে। নিজেদের ভেতর আর থাকেনা তারা, নিমিষে পৃথিবীর সবখানে কি যেন হাতড়ে আসে! রতন পোস্টমাস্টারের সাথে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে বলে, 'দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?' কিন্তু জেরি আর কোন কথাই বলেনা। সে হয়ত বুঝতে পেরেছিল পোস্টমাস্টারের মত লেখিকাও বলবে, 'সে কী করে হবে।'
পোস্টমাস্টার চলে যাবার সময় বলে, 'রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবে তাঁকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।' এবং 'রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।' তাঁর কথাগুলো রতনের গায়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতন বিঁধে। বালিকা রতন আর আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারে না; পোস্টমাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে বলে, 'দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।'
একইভাবে, লেখিকার অনুভূতি - ‘You have been my good friend, Jerry. I shall often miss you. Pat will miss you too.’ এবং 'but here’s some money I’d like to leave with you to buy things for him…' জেরির কাছে আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে। সে দুপুরের খাবার না খেয়ে সবার আড়াল হয়ে যায়।

বিদায়ী মুহূর্তে পোস্টমাস্টারের সাথে রতনের এবং লেখিকার সাথে জেরির আর দেখা হয় না। নৌকা ছাড়লে পোস্টমাস্টার রতনের জন্য গভীর ব্যথা অনুভব করে; ইচ্ছা করে - 'ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।' কিন্তু ততক্ষণে সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারকে আত্ম সান্ত্বনার গভীর দর্শন উপলব্ধি করান - ' জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।' সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। একইভাবে, ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখিকা জেরির শেষ দর্শন না পেয়ে আত্ম-সান্ত্বনার দর্শন আওড়ায়- 'I was almost relieved for I knew I should never see him again, and it would be easier not to say good-bye to him.' কিন্তু রতন আর জেরি আত্ম সান্ত্বনার কোন উপলক্ষ দাঁড় করাতে পারে না। আত্মসমর্পন করে মানব জীবনের সহজ ও সাধারণ মূর্খতার কাছে, আর তা হল আশা করা। রতন অফিস কক্ষের চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে তার 'দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে' এই আশাতে।
জেরি কতদিন লেখিকার কেবিনের এর চারপাশে আশা নিয়ে ছুটে গেছে কে জানে!
 


 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে কলকাতার উলাপুর গ্রামে ভরা বর্ষার আবহে যে বর্ষীয়াণ অনাথা বালিকার স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাস রচনা করেছেন তার-ই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মারজোরি কিনান রোলিং এর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে অসহনীয় শীতের মাঝে বসবাসরত বর্ষীয়ান অনাথ বালক জেরির মধ্য দিয়ে। দুটি গল্প ভিন্ন দুটি আবহ ও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠলেও বেশ কয়েকটি দিক থেকে অভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও রোলিং তাঁদের গল্পের উপজীব্য হিসেবে দুটি বার বছর বয়সের অনাথ শিশুকে বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ য়ুংয়ের (Jung) ‘ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স’(Electra Complex) ও রোলিং ফ্রয়েডের (Freud) ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ (Oedipus Complex) কে চরিত্র চয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের প্রধান চরিত্র পুরুষ হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ অন্য একটি প্রধান চরিত্র হিসাবে রতন নামের একটি বালিকাকে দাঁড় করিয়েছেন। একইভাবে, রোলিং তাঁর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে দুটি বিপরীত লিঙ্গের সহাবস্থান দেখান ঃ লেখিকা ও জেরি। ছেলেরা মাকে বেশি ভালোবাসে, মেয়েরা বাবাকে - প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম এটাই। তাইতো জেরি খুব সহজেই লেখিকাকে মায়ের সন্তানে ভাবতে পারে, রতন পোস্টমাস্টারকে দাদা ডেকে আপন করে নেয় নিমিষে। ভালোবাসার দুর্বোধ্য এই জালে জড়িয়ে পড়ে লেখিকা এবং পোস্টমাস্টারও।
 

***

রবীন্দ্রনাথ ও হেগেলঃ নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে ...

ইমন জুবায়ের


রবীন্দ্রনাথ-এর আরাধ্য জীবনদেবতা। এই জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের জীবনের কেন্দ্রে স্থিত । পক্ষান্তরে জার্মান দার্শনিক হেগেলএর কাছে বাস্তবতা হল পরম মন বা অ্যাবসালুট মাইন্ড ; রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ও হেগেল এর ‘পরম মন’ যেন একই মুদ্রা এপিঠ-ওপিঠ। তদুপরি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস এর সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) বলেছিলেন, Being and non-being are the same. বড় রহস্যময় এই উক্তি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর জীবদ্দশায় জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলন বিষয়ক বৈষ্ণবসাধনমার্গের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। নইলে রবীন্দ্রবাউল অভিধাটিই যে নিরর্থক হয় যায়।
 

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল খানে।।
আছে সে নয়নতারায় আলোক-ধারায়, তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে।।
 

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস কেন বলেছিলেন, Being and non-being are the same. সে যাই হোক। হেগেল এর দার্শনিক তত্ত্বসমূহ রবীন্দ্রকাব্যে কতদূর প্রতিপন্ন হয়েছে তা নিরুপন করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য এটুকুমাত্র বলা যে-রবীন্দ্রনাথ এবং হেগেল অজস্র দুঃখ যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবং হেগেল ভাবনার ঐক্য নির্ধারন করা সম্ভবও নয়। তাঁদের চিন্তাচেতনায় বিস্তর প্রভেদ। হেগেল ইতিহাসের ক্রমপরিবর্তন সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় কি একথা প্রযোজ্য? হেগেল মানুষের কিছু অন্ধকার প্রবণতা-যেমন প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে সম্পর্ক; এসবের প্রকট উদঘাটক; রবীন্দ্রনাথের বেলায় নির্মম বাস্তবতার প্রতি প্রাচ্যসুলভ প্রার্থনাবোধ লক্ষ্যণীয়। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ‘সত্য’ কে সুন্দর বলেছেন তা আমরা জানিঃ
 

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।

আর হেগেল এর উক্তি:

The Real is Rational and the Rational is Real .
 

কী এর মানে? যা বাস্তব তাই যৌক্তিক; আবার যা যৌক্তিক তাই বাস্তব। আশ্চর্য! কেমন রবীন্দ্রভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। তবুও বলা যায়; রবীন্দ্রনাথ ও হেগেল দুটি আপাত বিরোধী সভ্যতার জাতক বলেই তারা অভিন্ন সত্যের বিপরীতগামী পথের যাত্রী ছিলেন। তারপরেও এঁরা দু’জনই দুঃখকে জয় করে জীবনের জয়গান গেয়েছেন।

হেগেল সম্বন্ধে A History of Philosophy গ্রন্থে B.A.G Fuller লিখেছেন: ‘Man conquers nature by obeying her. But his essential victory is not the Baconian one of practical advancement. It has a deeper, spiritual sense. It is found in a triumph over his destiny, which consist in accepting with joyful resignation the renunciations his fate exacts from him . Not to rebel against life, but to love it as it is, with all its limitations and vicissitudes, is to overcome fate and to transmute it into freedom.’ (pp.303)


আর রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন গান।


আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পূণ্য করো দহন-দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো–
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊধর্ব-পানে।।
 

... Not to rebel against life, but to love it as it is, with all its limitations and vicissitudes, is to overcome fate and to transmute it into freedom...এই মুক্তিচেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহাত্মা হেগেল এর যুগান্তকারী ঘোষণা:
 

“The owl of Minerva spreads its wings and takes flight
only when the shades of night are falling.”

রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ কবিতাটিতে যেন একই সুর উত্থিত হয়েছে।

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্ -দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা-
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ,বন্ধ কোরো না পাখা।
 

এভাবে বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ও জার্মান দার্শনিক হেগেল একে অন্যের চেয়ে ভিন্নধর্মী ও সুদূর জগতে বসবাস করেও এক অভিন্ন সুরে সংগীত রচনা করে গেছেন: যে সংগীত জীবনের বিপুল জয় ঘোষনা করে। এবং সেই সঙ্গে আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে। আমরাও যেন গেয়ে উঠি-


আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।
 

***

রবীন্দ্রনাথ ও আমরা

ইমন জুবায়ের


রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত শিল্পকর্ম দিয়ে একটি কথাই যেন বলতে চেয়েছেন-জীবন সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি কি সত্য? কেননা, চোখ মেললেই চারপাশে অজস্র অ-সুন্দর চোখে পড়ে। ইতিহাসের উষালগ্ন থেকেই যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত রয়েছে মানুষ । আজও সেই রক্তঘোর কাটল না। আজও আফগান উপত্যকায় যুদ্ধবাজ দেশের বিমান হামলায় নিহত হয় শতাধিক বেসামরিক মানুষ। বিদেশ থেকে প্লেন ভর্তি করে আসে শ্রমিকের লাশ। পাটকলগুলি বন্ধ হয়ে গেলে খুলনার শ্রমিক পরিবারগুলো পতিত হয় নরকে। তা হলে জীবন কোথায় সুন্দর? অথচ, রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় বলেছেন,

জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।

এই দুঃখদুর্দশায় পরিপূর্ন জগতে জন্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ধন্য। আশ্চর্য! তা হলে জীবন সুন্দর-এই কথাটির মানে সম্ভবত জীবনকে সুন্দর করা যায়। হ্যাঁ, তাইই হবে। এবং জীবনকে সুন্দর করে তুলতেই রবীন্দ্রনাথের জীবনভর সাধনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা লক্ষ্য করেছি তাঁর উপার্জনের প্রায় সবটুকুই তিনি ব্যয় করেছেন বাংলার হতদরিদ্র মানুষের শিক্ষাবিস্তারের জন্য; কেননা, জীবনকে সুন্দর করা যায়। তিনি জানতেন বাংলার জীবন মূলত কৃষিজীবন। কাজেই, সেই আঠারোশো পচানব্বই সালেই রবীন্দ্রনাথের উদ্যেগেই স্থাপিত হয়েছিল কৃষিব্যাংক ।
জীবনকে সুন্দর করা যায়- এই রবীন্দ্রনাথের মূলশিক্ষা। তার আগে বিশ্বাস করতে হবে - শত দুঃখ কষ্ট গ্লানি সত্ত্বেও জীবন সুন্দর। জীবন সুন্দর-এই অনিবার্য মন্ত্রটিতে অবিচল বিশ্বাস ব্যতিরেকে জীবনকে কখনোই সুন্দর করা যাবে না।
আমাদের অনেক অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের অনেক অনেক পরিবর্তন সাধিত করতে হবে। আমরা যেন মনে না করি যে - জীবন সুন্দর নয়। সেরকম ভাবলেই আমাদের শীর্ষে পৌঁছবার পথ আরও দুর্গম হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথকে অগ্রাহ্য করবার কোনও অধিকার আমাদের নেই!
 


রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্ম আসলে অতীব সূক্ষ্ম অনুভূতির বিষয়। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো আপামর জনমানুষের বোধের অতীত। তারপরও রবীন্দ্রজগৎ থেকে বিচ্যুত হয়ে কেবলমাত্র প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজ নির্মাণ করে কী লাভ?
কেননা মানুষ তাকায় পূর্নিমার আকাশের দিকে। প্রতি মুহূর্তের আশঙ্কা ভুলে তার কন্ঠে তুলতে পারে,

আজ জোছনারাতে সবাই গেছে বনে।


ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলি সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা বাক্য ধার করে আমাদের বলতেই হবে,

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি ।
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধমুখে নরনারী ।।
না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোকপরিতাপ ।
হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি ।।
কেন এ হিংসাদ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ,
কেন এ মান-অভিমান ।
বিতর' বিতর' প্রেম পাষাণহৃদয়ে,
জয় জয় হোক তোমারি ।।

***

রবীন্দ্রনাথ ও আনা আখমাটোভা
ইমন জুবায়ের


বিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান রুশ কবি আনা আখমাটোভা (Anna Akhmatova).  রুশ ভাষায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। এটাই ওঁর প্রতি আমার আগ্রহের মূল কারণ। দ্বিতীয় একটি কারণও আছে: আনা আখমাটোভাকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ স্তালিনের নির্দেশে নানাভাবে মানসিক পীড়ন করেছিল। অথচ, স্তালিন আমৃত্যু যে আর্দশে বিশ্বাসী ছিলেন- আমিও সেই স্যোসিয়ালিষ্ট আদর্শের খুব একটা বিরোধী নই। বরং আমি শ্রমিক শ্রেণির ন্যায্য অধিকারের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল-এমন কী এই বাজার অর্থনীতির যুগে বেঁচেবর্তে থেকেও আমি স্রোতের বিপরীতে অবস্থান করে উৎপাদনযন্ত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী-যেটি সমাজতন্ত্রের অন্যতম মূলমন্ত্র। এ জন্যই আমি বুঝতে চেষ্টা করছি দু’ পক্ষকেই- কবি আনা আখমাটোভা কে এবং স্তালিন আমলের ব্যাক্তিপীড়নবাদী সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোটিকে । মাঝখানে অনিবার্যভাবেই রয়েছেন রবীন্দ্রনাথও ।
আনা আখমাটোভা রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। সেজন্যই মনে একটি প্রশ্ন জাগে: রবীন্দ্রবলয়ে দাঁড়িয়ে আখমাটোভা রবীন্দ্র প্রতিভায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন কি? যে রকম, আমরা হই। ১৯১৩ সালে লেখা আখমাটোভার In the Evening কবিতাটি পাঠ করা যাক।
 

The garden's music ranged to me
With dole that's beyond expression.
The frozen oysters smelled with freshness
And sharpness of the northern sea.

He told me, "I'm the best of friends!",
And gently touched my gown's laces.
Oh, how differs from embraces
The easy touching of these hands.

Like that they pet a cat, a bird...
Or watch the girls that run the horses....
And just a quiet laughter poses
Under his lashes' easy gold.

And the distressing fiddles' voice
Sings me from haze that's low flowed,
"Thank holly heaven and rejoice --
You are first time with your beloved."

দেখি কবিতাটির বাঙলা মানে করলে কি রকম দাঁড়ায়-

মনে হয়, উদ্যানসংগীত আমার কাছে আসে
অনির্বচনীয় এক বিষন্নতা নিয়ে ।
আর, উত্তর সমুদ্রের তীক্ষ্ণতাসহ
জমাট ঝিনুকের গন্ধ বড় সজীব।

সে আমায় বলেছিল,‘আমিই প্রকৃত বন্ধু।’
বলে সে ছুঁয়েছিল আমার আমার পোশাকের হেম।
ও হাতের সহজ স্পর্শ,
আলিঙ্গনের মতো সে তো নয়।

যেন তারা বেড়াল কি পাখি পোষে ...
কিংবা দেখে ঘোড়ায় চড়া মেয়েটিকে...
তার চাবুকের নিচের সহজ স্বর্ণ থেকে
শান্ত হাসির ভঙ্গিমায়।
(এ চারটে লাইন অনুবাদ সম্ভব হয়নি ...)

আর নৈরাশ্যময় বেহালাবাদকের সুর
নিচের আবছা বহমানতা থেকে আমার কাছে আসে।
‘ধন্যবাদ পবিত্র স্বর্গ এবং আনন্দ কর’
প্রথমবারের মত তুমি তোমার প্রিয়জনের সঙ্গে।’


এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেল কি? মনে হয় না। অথচ তখন আমি বলছিলাম যে- আনা আখমাটোভা রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ...আর আমি সেই চিহ্ন খুঁজছি-এতো বছর পর-যদিও ওপরের ‘ইন দ্য ইভিনিং’ কবিতায় রবীন্দ্রছাপ তেমন পাওয়া গেল না বোধহয়। আখমাটোভা এমন একটি সন্ধ্যার ছবি এঁকেছেন-যা আমাদের বোঝার বাইরে রয়ে গেল। আখমাটোভার এই কবিতাটি ১৯১৩ সালের দিকে লেখা ।  রবীন্দ্রনাথ এরপরও আরও গান/কবিতা লিখেছেন। আখমাটোভা সেসব গান/কবিতা পড়ে রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সেই সময়কার ছাপ কি আখমাটোভার মনের ওপর পড়েছিল? হতে পারে। কেননা, নিচের কবিতার শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথকে পাই। কবিতার শিরোনামঃ I came here, in idleness.
 

I came here, in idleness.
Where I am bored: all the same to me!
A sleepy hilltop mill, yes,
here years pass silently.

Over convolvulus gone dry
the bee swims past, ahead,
I call to that mermaid by
the pond: the mermaid νs dead.

Thick with mud, and rusted,
the wide pondνs shallows:
over the trembling aspen
a weightless moon glows.

I see everything freshly.
The poplars smell moist.
I’m silent. Silent, ready
to be yours again, earth.


এবার কবিতাটি বাংলা অনুবাদ করা যাক।
আমি এই নির্জনতায় আসি
এখানেও একঘেঁয়ে লাগছে!
পাহাড়ের ওপর ঘুম ঘুম মিল
এখানে বছরগুলি নিঃশব্দে বয়ে যায়।
ঘন কাদায় মোড়ানো পুকুরটি।
বড়। আর বড় অগভীর।
ওপরের ঝিরঝিরে গাছটি
ওজনশূন্য চাঁদটিও বাড়ছে।

আমি সবই সজীব দেখি।
গাছের শিশিরভেজা গন্ধ।
আমি নির্জন; নির্জন
তোমার জন্য-হে পৃথিবী।
 

 

আখমাটোভার জন্ম ইউক্রেইনের ওডেসায়। ইউক্রেইনের রাজধান কিয়েভ। কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কিছুকাল। তরুণী বয়সে আখমাটোভা সেন্ট পির্টাসবার্গএ গিয়েছেন। কেননা, ওটাই ছিল রাশিয়ার প্রাণকেন্দ্র। আর, মফস্বলের কবিদের কেন যেন বড় বড় শহরগুলি টানে। যে কারণে সেন্ট পির্টাসবার্গ শহরেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল আখমাটোভার। সেন্ট পির্টাসবার্গ-এ পৌঁছেই আখমাটোভা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কবিতার কারণেই। যে কারণে পরবর্তীতে এই সেন্ট পির্টাসবার্গ শহরেই আখমাটোভাকে স্তালিনের নির্দেশে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের পীড়ন করেছিল। করেছিল মানসিক নির্যাতন। কারণ,


সে আমায় বলেছিল,‘আমিই প্রকৃত বন্ধু।’
বলে সে ছুঁয়েছিল আমার আমার পোশাকের হেম।
ও হাতের সহজ স্পর্শ,
আলিঙ্গনের মতো সে তো নয়।

কিংবা-

আমি এই নির্জনতায় আসি
এখানেও একঘেঁয়ে লাগছে!
পাহাড়ের ওপর ঘুম ঘুম মিল
এখানে বছরগুলি নিঃশব্দে বয়ে যায়।

আখমাটোভার এই সমস্ত কবিতায় সমষ্টিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে কেবল ব্যাক্তিকে। অথচ, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের ভাবনাচিন্তা ছিল ব্যাক্তিকেন্দ্রিক নয়-সমষ্টিকেন্দ্রিক। অথচ, কবি একা হতে চাইতেন।
 

আমি সবই সজীব দেখি।
গাছের শিশিরভেজা গন্ধ।
আমি নির্জন; নির্জন
তোমার জন্য-হে পৃথিবী।
এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে যেন পাই। বিশেষ করে শেষ চারটি চরণে-

I see everything freshly.
The poplars smell moist.
I’m silent. Silent, ready
to be yours again, earth.
 

আবার সেরকম নাও হতে পারে। মিলে গেছে মাত্র-কবিদের স্বভাবই এই। তবে বেশ বোঝা যায়। আখমাটোভা গভীর এক বিষাদে আক্রান্ত হয়েই শহর থেকে দূরে নির্জন বনপথে যেতেন প্রায়ই। বললাম, গভীর এক বিষাদে আক্রান্ত হয়েই ...কেন? তখন আমি বলছিলাম। ...সে জন্যই আমি বুঝতে চেষ্টা করছি দু’ পক্ষকেই- কবি আনা আখমাটোভা কে এবং স্তালিনের আমলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজের ব্যাক্তিপীড়নকে।


রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া  ভ্রমণকালে সেখানকার স্তালিনপন্থি জীবনধারা দেখে এসে রচলেন অবিস্মরণীয় এক যুগমন্ত্র-

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো ক’রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
 

তত্ত্ব হিসেবে সমাজতন্ত্র কিন্তু ভারি সুন্দর। কে না সমর্থন করে এটিকে। হালের অক্সফোর্ড-পন্ডিত অমর্ত্য সেন অবধি। কমরেড মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে ১৯২০ সালের দিকে নজরুলও লাল খাতায় নাম লেখাতে গিয়েছিলেন কলকাতার এক গলিঘুঁজির ভিতরে। লিখেছিলেন: ‘গাহি সাম্যের গান ...’নজরুল কবি। কবিরা মানুষের দুঃখদারিদ্র সইতে পারেন না। আখমাটোভাও ...অনুমান করি। আখমাটোভাও সম্ভবত কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন প্লেটোর মতন -অবশ্য সে কল্যাণরাষ্ট্রে উপনীত হওয়ার পথটি সম্বন্ধে স্তালিনপন্থিদের সঙ্গে পোষণ করতেন দ্বিমত।
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। তখন নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আখমাটোভা দেখা করেছিলেন। যে রকম কলকাতা থেকে জয় গোস্বামীরা ঢাকায় এলে কিংবা আগরতলা থেকে দীপঙ্কর সেনগুপ্তরা এলে জুবেরিরা দেখা করে ...আমার সর্বশেষ প্রশ্ন এই। যদি ... যদি আখমাটোভার সঙ্গে কবিগুরুর দেখা হয়ে থাকেই-তা হলে রবীন্দ্রনাথ কি আখমাটোভার সেই দুচোখে যন্ত্রনার ছাপ টের পেয়েছিলেন?


***

যথারীতি প্রকাশনা

ধারাবাহিক গল্প

পৃথিবীলোক          একাধিক একা      সুখের লাগিয়

প্রবন্ধ

যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ

আর্কাইভ

 

*

*

*

*

*

*

*

*

*

 

 

 

 

Best view with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf