Humaira Haroon Aroop Ghosh Nauba Aloke Bangla

নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি।

সম্পাদক

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

পাঠক পরিষদঃ চঞ্চল চৌধুরী, শুভলগ্না শোয়ারা

কৃতজ্ঞতাঃ শিল্পী রুনা লায়লা

এবারের প্রকাশনা - একুশ চিরকালের

 

বিবর্ণ একুশ

 এরা কারা?
এরা কি মূর্খের বাড়া?
বরকত রফিক জব্বার মাণিক এরা কারা
এঁদের জন্য কিছু সময় আছে? কিম্বা কিছু চেতনার পারা
প্রয়োজন কি? এ বিশ্বায়নের যুগে শুধু নিজের কোলে ঝোল
টেনে টেনে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে যশের দোলনায় দোল
এই না হলে এক জাতি যার ঐতিহ্য যার ইতিহাস সারা দুনিয়ায়
প্রসিদ্ধ, শিক্ষায় সংস্কৃতিতে যাকে ছোঁয়া যায় না কোনও তুলনায়!
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন এই জাতির নাম হলো বাঙ্গালী
এরা ব্রিটিশ রাজের সম্মান পেয়ে হয়েছিল রায় বাহাদুর
এরাই সবার আগে লালমুখোদের দেশছাড়া করেছিল – দুর দুর
এককালে বলা হত ‘আজ বাঙালী যা ভাবে তা নিয়ে বাকি দেশ ভাবে কাল’
এক সময় ছিল যখন বাংলার মুখ দেখে সূর্য দেব উঠতেন আকাশে মিঠে লাল
এক সময় ছিল যখন সারা দেশের মানুষ চেয়ে থাকত এই জাতির দিকে
সে এক সময় ছিল যখন বাংলা মায়েরর সন্তানেরা তাঁর শেখানো ভাষার জন্য
প্রাণ দিয়ে রক্তে রাঙিয়েছে সেই মায়ের মাটি – ভাষাকে ভালেবেসে হয়েছে ধন্য
সেই তাদেরই কিছু নাম হল বরকত রফিক জব্বার মাণিক
এরা আজ অচল তাই না? বৈষয়িক বাঙ্গালী আজ আপনি ঠিক
আজ ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন হয়না প্রতি ফেব্রুয়ারির আধঘন্টার বেশী
পতাকা তুলে ঐ আধ ঘন্টায়ই বুঝিয়ে দেওয়া যায় আমরা কত পালটেছি
আমরা কি কোনও দিন মাকে ভালবেসেছিলাম কিম্বা তাঁর শেখানো ভাষাকে
আমরা কি কখনোও বুঝেছি বরকত রফিক জব্বার মাণিকের স্বপ্নিল আশাকে
আমরা কি বাঙ্গালী? আমরা কি মানুষ? আমরা কি কোনও দিন ভালবেসেছি
অনাদৃতা ভাষা-মাকে? সত্যিই কি কোনওদিন মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছি?
কেন বাঙ্গালীর মনের গভীরে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আর কোনও সাড়া জাগায় না
কেন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা ভাষা দিবস আজ আর মানুষকে রাগায়না?
কেন কেন কেন কেন – উত্তর নেই – এ প্রশ্ন কোন মঙ্গল গ্রহের প্রাচীরে গিয়ে
ধাক্কা খেয়ে অচেতন হলো এই ক্ষোভ, মানুষ কি কেমন করে গেল এভাবে মিইয়ে!
একুশে ফেব্রুয়ারি কি এতই দূরের পাখি যার ডানার আলো আজ আর পথ দেখায়না,
বিবর্ণ সেই একুশের চোখে আজ আলো নেই পড়েছে চালশে তবু সে হারিয়েও হারায়না
বাংলা ভাষাকে ভালবাসলে – বাংলা মায়ের কষ্ট কি বুঝলে আসুন এই ভাষাদিবসে
সবাই মিলেমিশে – গেয়ে উঠি আমরি বাংলাভাষা মোদের গরব মোদের আশা..

 

 আপনাদের সুপ্রতীক

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১

***
 

আমি দেখতে দেখতে বলে যাই
মুবতাসিম শাবাব

( চতুর্থ শ্রেণী )

আমি দেখতে দেখতে বলে যাই,
বিজয়ের কথা।
আমি দেখতে দেখতে বলে যাই,
মাতৃভাষার কথা।
আমি দেখতে দেখতে বলে যাই,
বাংলার কথা।
আমি বলতে বলতে শুনে যাই,
ভাষা আন্দোলনের কথা।
আমি শুনতে শুনতে শুনে যাই,
বিজয়ের গাথা।

***

 

বাঙলা বর্ণমালা
প্রণব আচার্য্য

এখনো রাজপথে কৃষ্ণচূড়ায় হাওয়া দোল খায়
পলাশের ডাল থেকে বিনম্র বেদনায়
লাল লাল শ্লোগা ফোটে ফাল্গুনে, একুশ শতকের রৌদ্রে
এখনো মিছিল হয় প্রতিবাদের অবিনাশী আগ্রহে
এখনো বর্ণমালা সালামের কথা বলে
এখনো বর্ণমালা জব্বারের রক্তধারায় সিনান করে
এখনো বর্ণমালা চর্যায় শেকড় রেখে ভাষার আকাশে বিস্তারিত হয়
প্রতিটি ভাষার বিস্ময়বোধ হয়ে, প্রতিটি মানুষের শোষণ মুক্তির আনন্দে
এই দেখ রাজপথ, পথে পথে এসেছে ফাল্গু আবার,
হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খায় পলাশের আগুন
পলাশের মিছিলে যে লাল রঙ ফুটে আছে
তার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাল্গুনের অশেষ রোদে
প্রতিটি বর্ণমালা পাঠ করে সালামের নাম
প্রতিটি বর্ণমালা স্ফুলিঙ্গ হয় রফিক বরকতের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের উচ্চতায়

 

***

 

শহীদদের কণ্ঠস্বর
রাতিফ আহমেদ রিজভী

মা, মাগো আমরা তোমার সন্তান,
ওপাড়ের জগৎ থেকে বলছি-
আমরা তোমার কোল ছেড়েছিলাম
বহুকাল আগে,
যখন তোমার বুক জুড়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছিল হিংস্র হায়নার দল,
কুৎসিত শকুনের দৃষ্টি ছিল জ্বলজ্বল,
তোমার প্রতি,
আমরা গর্জে উঠেছিলাম,
তোমার কোল ছেড়েছিলাম
ওদের তাড়িয়ে দিতে,
তোমার কোলে আবার ফিরব বলে।
মা, মাগো আমরা তোমার সন্তান,
আবার তোমায় অভয় দিচ্ছি-
যদিও হিংস্র হায়নার দল
আবার কড়া নাড়ছে তোমার দ্বারে,
শকুনের অশুভ ছায়া
এসে পড়েছে তোমার ঘরে,
আমরা আবার ফিরে আসব মা
তোমার কোলে,ফিরে আসব
রফিক, জব্বার কিংবা
মতিউরের রূপে,
আবার আমরা গর্জে উঠব,
হায়না, শকুনের দলকে
লুটায়ে দিব,
তোমার পদতলে।
 

***

 

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফিরোজা হারুন

২১ শে ফেব্রুয়ারি
৮ ই ফাল্গুনে এসেছিলে তুমি
পলাশের মালা পরি’।

সেই কবে
’৫২–র পড়ন্ত বিকেলে
রমনার মাঠে জড়ো হয়েছিলে
বাংলার দামাল ছেলে।

দস্যু করে ধন লুন্ঠন, তস্কর করে
সামান চুরি
ভাষা লুন্ঠন?
শুনিনি কখনো
এ জগতে নেই জুড়ি!

ভাষার জন্য প্রাণ দিল যারা
অকৃপণ অকাতরে
সাহসের বীজ বুনে দিল তারা
শহীদ মিনারে।

বাংলার ছেলে প্রাণ দিয়ে গেল
মায়ের ভাষার তরে
সোনার আঁখরে লেখা রবে নাম
বাংলার ঘরে ঘরে।

সালাম বরকত রফিক জব্বার
শফিক আরো কতজনা
দিনে দিনে কত রক্ত দিয়েছে
নাম তার নাই জানা।

ত্যাগের শীর্ষে উচ্চে উঠিল
বাঙ্গালী বীর সেনা
(আজ) শুধিতে হচ্ছে রক্তের ঋণ
আরো ছিল যত দেনা।

মায়ের মুখের ভাষার জন্য
দিয়ে গেল যারা প্রাণ,
গাইবো তাঁদের গৌরব গাথা
রাখবো ভাষার মান।
 

***

 

ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা

কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি
মাহবুব উল আলম চৌধুরী

যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে
তাদের জন্য আমি ফাঁসি দাবী করছি।
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য
ফাঁসি দাবী করছি।
ফাঁসি দাবী করছি যারা এই মৃতদেহের ওপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তি প্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে, রসনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য, বাংলার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য, রমেশ শীলের গাথার জন্য
জসীমউদ্দীনের সোজন বাঁধিয়ার ঘাটের জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি বাউল কীর্তন গজল
নজরুলের 'খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি'
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেইদিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
 

 সন্ধ্যা সাতটা, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২

চট্টগ্রাম


***

 

প্রবন্ধ

রক্ত মোছা রুমাল

একুশ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।
বিকেল বেলা। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সরকারি আদেশ উপেক্ষা করে ছাত্ররা চতুর্দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে রশিদ বিল্ডিং এর কাছ দিয়ে, খন্ড খন্ড মিসিল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। পোগোজ হস্টেল থেকে আমরা ক’জন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখ দিয়ে এসে বর্তমান মেডিক্যাল কলেজের সামনে মিসিলে অংশ নিলাম। বর্তমানে যেখানে শহিদ মিনার, সেখানে ছিল ব্যারাক। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা সেখানে থাকতো। খন্ড খন্ড মিসিল একত্রে এসে, একটি বড়ো মিসিলের রূপ নিল। স্লোগান ছিল, ' রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই '।

এরই মধ্যে পুলিস-এর গাড়ি এসে মিসিলের উপর টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করলো। আমি চোখে রুমাল (সবুজ রং-এর) ধরে ব্যারাকের দিকে যেতে চেষ্টা করলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম। তখন দেখি একজনের মাথা ও শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। বোধহয় ছাত্র হবে। গুলি খেয়ে পড়ে গিয়ে ছটফট করছে। আমার হাতের সবুজ রুমাল দিয়ে ছাত্রটির গায়ের রক্ত মুছে দেবার চেষ্টা করলাম। রক্ত বন্ধ হয়না। তার গায়ের রক্ত এসে আমার জামা কাপড়ে লাগলো। তারপরই ক’জন লোক এসে মৃতপ্রায় ছাত্রটিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

সবুজ ঘাসের উপর দেখলাম ছোপ ছোপ রক্তের বৃত্তাকার ছাপ। আজকে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার যে রঙ, ঠিক তাই। তখন কে জানতো, এই ভাষা আন্দোলনই একদিন স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেবে? কে জানতো, সবুজ ঘাসের উপর শহিদের রক্তের লাল দাগ একদিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় স্থান পাবে? সেদিনের রক্ত মোছা সবুজ রুমাল, হারিয়ে গেছে আজ কতকাল! কিন্তু সবুজের বুকে লাল, সে তো উড়বেই চিরকাল!
 

লে. কর্নেল অব. ডা. হাফিজ আহমেদ
ময়মনসিংহ, ২২২০
১  ফেব্রুয়ারি, ২০১১

***

 

ভাষার সাধু, চলিত
আবু জার মোঃ আককাস



সাধু আর চলিত,বা চলতি, বাংলা ভাষার প্রধান দুই মান্য রীতি। শান্তিপুর আর নদিয়ার হলেও, চলিত ভাষা এখন কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। বরং সর্বগ্রাহ্য মান্য ভাষা। আর সাধু ভাষার ব্যবহার এখন বেশ পড়ে গেছে, প্রায় লেখাই হয় না, দুয়েকটি দৈনিকের সম্পাদকীয় ছাড়া। আগে ছিল লেখায় সাধু, আর বচনে চলিত। ভাষাতত্ত্বে একেই বলে দ্বিবাচনভঙ্গি বা দ্বিবিধ ভাষারীতি। এই অবস্থাটা অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে আর নেই। সাধু ভাষা নতুন করে আর ব্যবহৃত হয় না। সাধু ভাষা এখন পুরনো সাহিত্যের অঙ্গ। তাই এই দ্বিবাচনভঙ্গির ব্যাপারটা এখন আর আছে বলা বোধ করি চলে না। গ্রিসেও বোধ হয় ব্যাপারটা একই রকম। ১৮২০-এর পর থেকে লেখার ভাষাকে বলা হত কাথারেভুসা বা পরিশীলিত অর্থাৎ সংস্কৃত গ্রিক, আর মুখের বুলি ছিল দিমোতিকি বা দেহাতি অর্থাৎ চলতি গ্রিক। গেল শতাব্দীর সাতের দশকের খানিক পরে মান্য ভাষার তকমা দেওয়াতে দিমোতিকি-ই গ্রিসে এখন মান্য প্রচলিত বুলি।

এখন চলিত বাংলার সময়। ভবিষ্যতে হয়ত নতুন কিছু আসবে। এখনই আঞ্চলিকতা ছাড়াও শহর-নগরে যা বলা হয় এবং যা লেখা হয় তার মধ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। ভাষাতত্ত্বের বুকনিতে এগুলো
অ্যাক্রোলেক্ট, মেসোলেক্ট, ব্যাসিলেক্ট
(acrolect, mesolect এবং basilect)-এর পর্যায়ে পড়বে। অ্যাক্রোলেক্ট হল শীর্ষভাষা, মান্য চলিত রূপ যা আমরা লিখে থাকি এবং দপ্তর বা আদালতে এবং গণমাধ্যমে ব্যবহারের চেষ্টা করি। শিক্ষিত দুই অঞ্চলের লোকের মাঝেও এর ব্যবহার দেখা যায়, বোঝার সুবিধার জন্য, বিলেতে যেমন একসময় গৃহীত উচ্চারণ (received pronunciation) ব্যবহৃত হত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খাইয়াছি (সাধু), খেয়েছি (মান্য চলিত, অ্যাক্রোলেক্ট), এবং খাইছি বা খাইসি (মেসো- বা ব্যাসিলেক্ট)। এক্ষেত্রে খাইছু বা খাইসু কিংবা খাউসু হবে আঞ্চলিকতা (ডায়ালেক্ট, dialect)।

 

মধ্য যুগে আলাওলদের ভাষাই ছিল আদর্শ। পরে ষোলশ' খ্রিস্টাব্দের দিকে ভাষা পালটে সাধু ভাষার রূপ নেয়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের ভাষা, শিক্ষিতের ভাষা, অনুষ্ঠানের ভাষা। সাধু কথাটির অর্থ সাধারণভাবে এখন পরিশীলিত, মার্জিত বা ভদ্র ধরা হলেও, সেসময় এর অর্থ ছিল বণিক। সমাজভাষা বিশেষজ্ঞ মনসুর মুসার এই মত। অর্থটির দ্যোতনা এখনও ‘সাধু সাবধান’ কথাটির মধ্যে বিদ্যমান। অর্থাৎ সাধু ভাষা ছিল আমির-সাধুদের ভাষা। পরে ইংরেজদের হাতে পরে প্রাকৃত প্রভাব মুক্ত হয়; এবং সংস্কৃত প্রভাব যুক্ত হয়ে তৈরি মান্য সাধু ভাষা, খানিকটা যেন সংস্কৃতের ব্যাসিলেক্ট।

 

১৮০১ সালে মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের লেখা থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে – ‘এতদরূপে প্রবর্তমান সকল ভাষা হইতে সংস্কৃত ভাষা উত্তমা বহু বর্ণময়ত্ব প্রযুক্ত এক দ্ব্যক্ষর পশুপক্ষি ভাষা হইতে বহুতরাক্ষর মনুষ্য ভাষার মত ইত্যনুমানে সংস্কৃত ভাষা সর্বোত্তমা এই নিশ্চয়।’ সেসময় দ্বিভাষারীতির ব্যাপারটা আমলে নেওয়া যেত। এরও প্রায় একশ বছরের বেশ কিছু সময় পরে, ১৯১৩ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরী সাধু ভাষার জায়গায় সাহিত্যে চলিত ভাষা চালানোর চেষ্টা করে। তাই পরে মান্য ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। একই লেখায় সাধু আর চলিতের মিশ্রণকে গুরুচণ্ডালী বলে অভিহিত করা হত, পরীক্ষার খাতায় তো বটেই।
 

***

 

 

ছন্দঃ

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

 

মানুষ সহজভাবে যে ভাষায় কথাবার্তা বলে, সেই ভাষার গতির একটা ভঙ্গী আছে। অর্থ অনুসারে, বাক্যে আগত পদের ক্রম স্থির হয়; এতদ্ভিন্ন সাধারণ কথোপকথনের ভাষায় বাক্যকে তুল্য-গুণ-যুক্ত অংশে ভাগ করিবার , অথবা কোনও প্রকার অলংকার মন্ডিত করিবার প্রয়াস করা হয় না।  কথোপকথনের ভাষার বাক্য রচনা রীতি ও সহজ গতি ভঙ্গীর উপরে গদ্য সাহিত্যের ভাষা প্রতিষ্ঠিত। সহজ ও সরলভাবে কিছু বলিয়া যাইতে হইলে, সাধারণ ভাবে কোনও কিছু আলোচনা করিতে হইলে, বা চিন্তার আদান প্রদান করিতে হইলে, এই গদ্য ভাষা প্রযুক্ত হইয়া থাকে। উপযোগী, সার্থক ও সুন্দর শব্দ চয়নের উপরে এবং অন্তর্নিহিত ভঙ্গীটিকে মনোহর করার উপরে গদ্য ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য্য নির্ভর করে।

 

কিন্তু কবিত্বশক্তি-প্রভাবে  মানুষ যখন কল্পনা ও সৌন্দর্য্য বোধ  এবং অপার্থিব বস্তুর অনুভূতির অধিকারী হইয়া চিন্তা করে, বা দেখে অথবা কিছু দেখিবার চেষ্টা করে এবং যাহা সে চিন্তা করিয়াছে বা দেখিয়াছে সেই সম্বন্ধে কিছু বলিতে চাহে তখন সাধারণ কথোপকথনের বা গদ্যের ভাষায় তাহার কুলায় না; তাহার ভাষায় প্রায়ই রস বস্তুর প্রকাশের  সঙ্গে সঙ্গে একটি সুষমা মন্ডিত স্পন্দনে, একটি শ্রুতি মধুর নৃত্য বা তাল ভঙ্গীতে নিয়ন্ত্রিত হইয়া যায়। ভাষার এই সুষমাময় স্পন্দন বা গতি মাধুর্য্যকে ছন্দঃ (বা ছন্দ) বলা হয়।

 

বাক্যকে সমান গুণ যুক্ত, পরস্পরের সহিত সমতুল, কতকগুলি বাক্যাংশে বিভক্ত করায় বহুস্থলে ছন্দবোধ জন্মে। ধ্বনি ও অর্থ ঘটিত নানা প্রকার অলঙ্কার অনেক সময়ে এই ছন্দকে অলঙ্কৃত করিয়া থাকে এবং ছন্দের সহিত অনেক সময়ে একাঙ্গীভূত হইয়া যায়; কিন্তু ভাষার এই স্পন্দনময় ভঙ্গীর নিজের একটি বিশেষ শক্তি বা ব্যঞ্জনা থাকে। Rhythm  বা ছন্দোগতি মানবের অন্তঃপ্রকৃতির বা বাহ্য বিশ্বপ্রকৃতির  তাবত ব্যাপারের মধ্যে অন্তর্নিহিত বলিয়াই মানবের ভাষাতেও ছন্দ আসিয়া গিয়েছে।

 

কোনও ভাষার ছন্দ সেই ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণ পদ্ধতির সহিত বিশেষভাবে জড়িত; ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণ রীতির বিরুদ্ধে গমন করিলে বা উহাকে বিকৃত বা পরিবর্তিত করিলে ছন্দঃ সৃষ্টি হইতে পারেনা। উচ্চারণ রীতি যেখানে সম্পূর্ণ রূপে পৃথক এরূপ অপর কোনও ভাষার ছন্দোবিধি যথাযথ রূপের একটি বিশেষ ভাষায় গৃহীত হইতে পারেনা; এরূপ ক্ষেত্রে বিদেশী ছন্দোবিধিকেই পরিবর্তিত করিয়া লওয়া হইয়া থাকে।   

***

 

 

বাংলা ভাষা ও বানান

হাফিজ আহমেদ

অনেকেই মনে করেন, যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত বানানবিধি অনুসরণ না করা এক প্রকার ধৃষ্টতা। তিরিশের দশকের বাঙালিদের ধারণা তাই ছিল। কারণ তখন আসাম ও বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ভাষা নিয়ন্ত্রিত হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে। সেই অবস্থা এখন আর নাই। সেই ধারণাও আর নাই। সেইখানেও ভাষার উপর কলকাতার প্রভাব দিনদিনই হালকা হয়ে আসছে। দেশ বিভক্তির পর  হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হবার পর সেখানকার বাঙালিদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিধি সংকুচিত না হলেও প্রসারিত হয় নাই। দূরদর্শন-এ নাটকাভিনয়ে, সংবাদ পাঠে ও বিজ্ঞাপন প্রচারে এই বাস্তবতার প্রমাণ পাওয়া যায়। উচ্চারণ আর আগের মত মধুর নয়। সাজসজ্জা উচ্চমানের নয় আর বানান ভুল আছেই। সুতরাং সত্তর বৎসর আগে প্রচলিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ভাষারীতি ও বানাননীতি এই দেশে অনুসৃত হবার কথা বার বার সুপারিশ করা হলেও আমরা তেমন অনুপ্রাণিত হতে পারছি না। আমরা আমাদের স্বদেশের লেখক ও সম্পাদকদের লেখা হতে জ্ঞাতসারে নিত্যই অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমরা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছি। ফলে আবির্ভাব হয়েছে এক নতুন জাতির। রক্তাক্ত সংগ্রাম ও জাতীয় সত্তার নূতন উপলব্ধি দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে ভাষা, বানান ও গোটা সাহিত্যের উপর। তাই আমাদের লেখকদের সৃষ্ট সাহিত্যে দেশের কথা আছে, আছে আধুনিক জীবনযাত্রার কথা। আর আছে সংগ্রামের কথা, আছে গ্রামের কথা। তাই হুমায়ুন আহমেদ-এর নাটক সীমা ছাড়িয়ে ঐপারের বাঙালিদের চিত্তকে আকর্ষণ করে। অনুমান করতে পারি যে, তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। আধুনিক বাংলাভাষা এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঢাকা হতে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, সাহিত্যে সমৃদ্ধ আমাদের মাতৃভাষা ক্রমপরিবর্জন ও ক্রমপরিবর্ধনের পথ ধরে দিন দিনই সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এইসব ভেবে আমরা যদি নিজেদের সাহিত্যের জন্য নিজেরা গর্বিত হই, তা কোনমতেই দোষের হতে পারে না। সেই সময় বর্ণমালায় ’ (লি) বর্ণ ছিল। আজ আর তা নাই। বর্গীয় ও অন্তস্থ ’- এর আকৃতি ও উচ্চারণে কোন পার্থক্য নাই বলে, শিশুদের বর্ণ বইতে এখন একটি ই মুদ্রিত হচ্ছে। তখনকার অনেক রীতিই আজকাল ধীরে ধীরে অচল হতে চলেছে। ভাষার গতি সময়ের গতিকে দ্রুত অতিক্রম করে যে নীতিগত পরিবর্তন এনেছে তা আমাদের চেতনাকে শাণিত করছে। বুঝতে পারছি যে, এই পরিবর্জন ও পরিবর্ধনের গতিতে আর যতি আসবে না, চলতে থাকবে।

আজকে ভাষার আরও সংস্কার প্রয়োজন, বিজ্ঞানসম্মত বানান ব্যাকরণভুক্ত  হওয়া প্রয়োজন। আমাদের একটা অভ্যাস আছে যে, একটি শব্দ লেখা শেষ হলেই একটি  ী-কার কলমের টানেই শব্দশেষে লাগিয়ে দেয়া। চেতনার তাড়নায় মানুষ এখন  বুঝতে পেরেছে যে, সকল শব্দ শেষে  ী-কার দেওয়া একটি ভুল অভ্যাস। সেইজন্য শব্দশেষে অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণসম্মত নয়, এমন ী-কারকে বিদায় দেওয়া প্রয়োজন। 

বাংলাবাসি ও বাংলাভাষি যারাই মনযোগ দিয়ে সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের প্রায় সকলেই এই পরিবর্ধিত বানানরীতি অনুসরণ করে আসছেন। এই ব্যাপারে পুস্তক প্রণেতাদের হতে পত্র-পত্রিকার সম্পাদকগণই অগ্রণি ভূমিকা রেখে আসছেন। তারাই আজ অগ্রসর। আজ প্রায় লেখকই সাগ্রহে সানন্দে শব্দশেষে  ি -কার ব্যবহার করছেন। তাদের আগ্রহ আমাদেরকে আকৃষ্ট করছে।

একসময় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ তুলে ধরতাম। আর আজ বাংলাদেশের আধুনিক লেখকদের লেখা তুলে  ধরবার মত দৃষ্টান্তের অভাব নাই। কলকাতায় বলা হয়, আকাদেমি। আর আমরা বলি অ্যাকাডেমি। আমাদেরটাই ব্যাকরণ সম্মত। কারণ আমরা শব্দের মূল উচ্চারণের বিকৃতি হতে দেই নাই। ভাষার উৎকর্ষ সাধনে এখন আমরা কলকাতা হতে অগ্রগামি। এর কারণ বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার আন্দোলনে, অমর একুশেতে বাঙালি যুবকদের অকাতরে প্রাণদান আর ভাষা ও স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধে শেখ মুজিবের অকালে আত্মদান।

পশ্চিম বংগে বাংলাভাষা বাঙালিদের মাতৃভাষা এবং ভারতে তা প্রাদেশিক ভাষা। এইখানে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। পশ্চিম বংগে বানানে শব্দের রূপান্তর ঘটেছে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশে শব্দের শ্রী এসেছে দ্রুত গতিতে। আধুনিক সাহিত্যে এসেছে আধুনিক বানান। অর্থাৎ শব্দের স্বর ও সুর ক্রমশ সরল হয়ে এসেছে। তা আসতে থাকবে আগামি দিনেও। শ্রেণী কর্মসূচী’-তে আধুনিকতার স্রোতে আজকাল  ি - কার এসেছে। এতে আমরা খুশি। তবে শত লেখালেখিতেও পুলিস বানানে কেউই ব্যবহার করছেন না।  সেই দুঃখে আমরা মুহ্যমান। আমাদের বিশ্বাস, ‘পুলিসবানানটি অদূর ভবিষ্যতে সকলেই দিয়া লিখতে উৎসাহিত হবেন। কারণ বানানটি অভিধানে আছে এবং তা অবশ্যই ব্যাকরণের বিধান মত।

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের প্রথিতযশা লেখকদের নিবন্ধে আধুনিক বানানের প্রতি আমরা গভীর মনযোগের সাথে দৃষ্টি দেই। কোথায় কোথায় ী-কারের পরিবর্তে  ি-কারের আর্বিভাব ঘটেছে তা লক্ষ্য করি। সেই দেখার খানিকটা এইখানে তুলে ধরতে চাই।

১। স্ত্রীবাচক শব্দের অন্তে ী-কার হয়। এইসব শব্দে লিঙ্গ পার্থক্য বুঝবার কারণেই শব্দশেষে ী-কার দিতে হয়। মনে এরূপ ভাবনা আসে যে, হয়তবা পঁচিশ বৎসর পর স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে এই  ী-কার নাও থাকতে পারে। নদিি-কার দিয়ে লিখলে, যদি শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গই বুঝায় তা হলে এই ী-কারের ব্যবহার এইখানে নাও থাকতে পারে। কিছু কিছু শব্দ আজকাল ি-কার দিয়ে লেখা হয়। শব্দগুলি যে স্ত্রীলিঙ্গ তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। যেমন গিন্নি, বৌদি, দিদি, বিবি, রানি, দাদি, নানি, মামি, মাসি, পিসি, মুরগি ইত্যাদি।

২। জাতি বাচক শব্দের অন্তে আজকাল কেবলই  ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা হতে প্রকাশিত অগ্রসর দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন পাকিস্তানি, জাপানি, মাদ্রাজি, সৌদি, কুয়েতি, বিহারি, বাঙালি ইত্যাদি। 

৩। ব্যক্তিবাচক অনেক শব্দের অন্তে  ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন বন্দি, বাদি, কেরানি, সামি, ফেরারি, সিপাই, কৌসুলি ইত্যাদি

৪। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে আসে নাই এমন সকল বংশগত শব্দের অন্তে আজকাল ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন কাজি, গাজি, ফরাজি, নিয়াজি, জিলানি, কোরেশি, রিজভি, আলভি, গিরি, রেড্ডি, চৌধুরি ইত্যাদি।

৫। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে আসে নাই এমন সকল নামবাচক শব্দের সকল জায়গায় কেবল ি- কার ব্যবহৃত হয়। যেমন চার্চিল, ক্লিনটন, কেনিডি, ইয়েলতসিন, রহিম, রশিদ, শহিদ, শফিক, মুসলিম, কামালউদ্দিন ইত্যাদি। তবে অর্ধ শতাব্দি পূর্বে রাখা নামগুলিতে ী-কার ও  ূ-কার ছিল। তা আজও আছে। যেমন কাজী, সাহাবউদ্দীন, নূরউদ্দীন, আয়ূব, হুমায়ূন, ওয়াদূদ ইত্যাদি। এইসব নামে ি- কার ও  ু-কার থাকলে ভাল হত।

৬। অর্জিত খেতাবেও ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন ক্বারি, কবি, মৌলভি, হাজি, বয়াতি ইত্যাদি।

৭। সংস্কৃত বা প্রাকৃত হতে এসেছে এমন সকল নামের অন্তে ী-কার ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। তা অর্ধশত বৎসর আগের কথা। আজকাল অনেকেই ঐ সকল শব্দে ি-কার ব্যবহার করছেন। যেমন চক্রবর্তি, পূজারি, সন্ন্যাসি ইত্যাদি। আরও লক্ষ্য করা যায় যে, কতিপয় উচ্চবর্ণ হিন্দু নামের ন্তে  ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন চ্যাটার্জি,ব্যানার্জি, গাংগুলি, ব্রহ্মচারি ইত্যাদি।

৮। ভাষাবাচক শব্দের অন্তে নির্দ্বিধায় ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, হিন্দি, মারাঠি, সিংহলি, পালি, নেপালি ইত্যাদি।

৯। প্রাণিবাচক কতিপয় শব্দের অন্তে  ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন পাখি, হাতি ইত্যাদি।

১০। বস্তুবাচক শব্দের অন্তে  ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন বাড়ি, গাড়ি, শাড়ি, কড়ি, ঢেঁকি, কাঁচি ইত্যাদি।

১১। স্থানবাচক সকল শব্দের অন্তে আজকাল সানন্দে  ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন করাচি, কান্ডি, রাওয়ালপিন্ডি, দিল্লি, চিলি, মালি, নাগাসাকি, পিকিং, হেলসিংকি ইত্যাদি। আমাদের দেশেও এইসব শব্দের অন্তে সাগ্রহে ি-কার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন মহাখালি, নোয়াখালি, ধানমন্ডি, ফেনি, রাজবাড়ি, ঝালকাঠি, নলসিটি ইত্যাদি। এটা শুভ লক্ষণ। স্থানবাচক শব্দের শুধু অন্তে নয়, আদিতে ও মধ্যে সর্বত্রই ি-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন সান্তিয়াগো, হো চিমিন সিটি, চিন, ব্রিস্টল, মতিঝিল, গচিহাটা ইত্যাদি। এইসব স্থানে ি-কার ব্যবহার করলে ধ্বনি কোমল থাকবে, শুনতে ভাল লাগবে, দেখতে সুন্দর ও লিখতে সহজ হবে।

১২। বিশেষণবাচক শব্দের অন্তে আজকাল ী-কার ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে গেছে। ি-কার ব্যবহারের হিড়িক পড়ে গিয়েছে। আধুনিক লেখকদের নিবন্ধে, প্রায় সকল সংবাদপত্রের সংবাদের শিরোনামের দিকে লক্ষ্য করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যেমন দেশি, বিদেশি, বেশি, খুশি, সরকারি, কারিগরি, কর্মচারি, বহুমুখি ইত্যাদি। তবে ব্যাংকগুলির নামের অন্তে পূর্ব হতেই সরকারিভাবে ী-কার আছে বলেই সোনালী’, ‘রূপালী’, শব্দগুলিতে ি- কার ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সোনালি, রূপালি, ও পূবালি লিখতে পারলে সুন্দর হত।

১৩। কতিপয় বাংলা শব্দের অন্তে ী-কার হয়। আবার ঐ সকল শব্দ পরিবর্তিত অবস্থানে ী-কার বর্জন করে ি-কার অর্জন করে। যেমন  প্রতিযোগী, সহযোগী, স্থায়ী, প্রাণী, মন্ত্রী ইত্যাদি শব্দগুলি ী-কার হারিয়ে হয় প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা, স্থায়িত্ব, প্রাণিবিদ্যা বা প্রাণিবাচক, মন্ত্রিসভা। মূল শব্দে ী-কারের পরিবর্তে ি-কার আনা যায় কিনা তা এখনই ভেবে দেখা দরকার। জাতিকি করে জাতীয়হয় তার ব্যাখ্যা কোথাও পাই না।

১৪। শব্দটি কিন্তু কম্পানি। আমরা লিখি কোম্পানী। আর একটি শব্দ ফটোগ্রাফী। এটিও ভুল, হবে ফটোগ্রাফি ফোনযেইভাবে উচ্চারিত হয় সেইভাবে। একটি মজার নিয়ম আছে যা সকলেই অনুসরণ করেন। কিন্তু এটাই যে নিয়ম তা হয়ত অনেকেই জানেন না।

বাংলায় ব্যবহৃত সকল বিদেশি শব্দের আদিতে, মধ্যে ও অন্তে কখনও ী-কার হয় না। বিদেশি হলেই শব্দটিতে কেবল ি-কার হবে। ছাত্র ছাত্রীদের এই নিয়মটি সহজ বলে সহজেই মনে থাকবে। যেমন মিলিটারি, আর্টিলারি, ইস্টার্ন, স্ট্রিট, লিমিটেড, কম্পানি, জিওগ্রাফি, ফোটোগ্রাফি, প্যাথলজি (শব্দশেষে যত-জি আছে) ডিকশনারি , জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, প্রাইমারি, লাইব্রেরি, ব্যাটারি, নোটারি, নার্সারি, গ্যালারি, জুয়েলারিকনফেকশনারি, সার্জারি, লটারি, ল্যাবরেটরি (শব্দের শেষে যত রি আছে) এজেনসি, ফার্মাসি, কোতোয়ালি, অ্যাভিনিউ, অ্যাকাডেমি ইত্যাদি।

১৫। ইংরেজী অনেক শব্দের বাংলায় অ্যাহয়। যেমন অ্যাসিড, অ্যাপোলো, অ্যাপেক্স, অ্যারোম্যাটিক, অ্যান্ড, অ্যানজেলিক, অ্যানাটমি, অ্যাস্ট্রলজি, অ্যাডভোকেট, অ্যাকাউন্টস, অ্যাকাডেমি, অ্যাভিনিউ ইত্যাদি।

১৬। বাংলায় বিদেশি শব্দ লিখতে ৃ-কার কখনও ব্যবহৃত হবে না। যেমন ব্রিষ্টল, ব্রিসবেন, ব্রিটিশ, ব্রিটেন, খ্রিস্টাব্দ, ফ্রি, প্রিটোরিয়া, গ্রিনল্যান্ড ইত্যাদি।

১৭। ইংরেজি ‘S’ বা ‘SS’ র  স্থলে বাংলায় কেবলই হয়। যেমন স্টেশন, মাস্টার, স্টোর, স্টোন, ক্লাস, গ্লাস ইত্যাদি। দুইটি শব্দ ব্যতিক্রম আছে। শুগার ও ইশ্যু লিখতে হবে।

১৮। যে সকল ইংরেজি শব্দের শেষে ‘CE’ আছে সেই সকল শব্দ শেষে বাংলায় অবশ্যই হবে । এটি  ব্যাকরণের বিধান। যেমন পুলিস, নোটিস, অফিস, জাষ্টিস ইত্যাদি ।

১৯। বিদেশী শব্দ লিখতে বর্ণ দুইটি ব্যবহার করা যায় না। যেমন  পোষ্ট হবে পোস্ট, ইষ্টার্ণ হবে ইস্টার্ন, হর্ণ হবে হর্ন, মডার্ণ হবে মডার্ন, কর্ণার হবে কর্নার, কর্ণেল হবে কর্নেল ইত্যাদি।

২০। ইংরেজি ST-র স্থলে বাংলায় কেবলই স্টহয়। যেমন স্টাফ, স্টার, অগাস্ট, স্টুডিও ফোটোস্ট্যাট ইত্যাদি।

২১। শহরের প্রায় সাইনবোর্ডগুলিতে ভুল বানানে অনেক শব্দ দেখতে পাওয়া যায়। শব্দগুলির শুদ্ধ বানান হবে স্টুডিও, স্টোর, স্টেশন, হর্ন, কর্নার, কর্নেল, অগাস্ট, ফোটোস্ট্যাট, অ্যাডভোকেট, অ্যাভিনিউ, অ্যাকাডেমি, কোতোয়ালি, পুলিস ইত্যাদি। শুদ্ধ বানানে এই সকল শব্দ লিখলে ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসাই প্রকাশ পাবে।

বাংলা ভাষাকে আরবি এবং পরে ইংরেজী বর্ণমালায় লিখবার এমনকি মাতৃভাষার উপর গুলি চালাবার নির্মম আদেশ এসেছিল বর্ধমান হাউজ হতে। পশ্চিমা শাসকবর্গের সেই চেষ্টা সফল হয় নাই। পরবর্তিতে বাঙালি সংস্কৃতির ও ভাষার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যেই জন্ম হয়েছিল  'বাংলা একাডেমী'র। সেই বর্ধমান হাউজই হচ্ছে আজকের বাংলা অ্যাকাডেমির সকল কর্মকান্ডের পাদপীঠ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, তাদের প্রকাশিত অভিধানগুলিতে অনেক বানান ভুল দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের সাথে মিল রেখে ভাষাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাকরণ-নির্ভরশীল করে তুলবার কোন পদক্ষেপ এখনও নেয়া হয় নাই। আমাদের বিরাট ভলিউমের ব্যাকরণ বই ও অভিধানগুলি বহু বৎসর পর পর কেবল পুনর্মুদ্রিত হয়, কখনও সম্পাদিত হয় না। রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে ট্রাম চলে, মন চলে না। সেই কথাগুলি এখন আমাদের বেলায় খাটছে। আমরা সুন্দর টাই পরে, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উদীয়মান রক্তিম সূর্যখচিত সবুজ পতাকা লাগিয়ে বাংলা একাডেমী’-তে অনুপ্রবেশ করি, বাংলা অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ করতে আমাদের মন চায় না। দুই তিন বৎসর পরপর বাংলা অ্যাকাডেমির প্রশাসনে পরিবর্তন আসে। এইবারও এসেছে। ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, স্বদেশের বিশিষ্ট লেখক এবং পত্রিকা সম্পাদকের সাথে পরামর্শ করে বাংলাভাষা উন্নয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বাংলা অ্যাকাডেমির বর্তমান কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে জাতি একটি যুক্তিসংগত বাংলা ব্যাকরণ এবং একটি ব্যাকরণসম্মত আধুনিক অভিধান উপহার পেতে পারে। তখন এই কথা কেউ বলতে পারবে না যে, ভাষার প্রতি আমাদের আদর নাই। ভাষার প্রতি ভালবাসা দেখালে কে না খুশি হবে?

***

 

ভাষার নিয়ন্ত্রণ, ভাষার পুরস্কার
ফকির ইলিয়াস

এক.

একটি ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে প্রকাশ করে। ভাষাকে বদলেও দেয় মানুষ। নিজের মতো করে কাজে লাগায়। ভাষা নিজে প্রকাশিত হতে পারে না। যুগে যুগে প্রজন্মের বুননের মধ্য দিয়েই একটি ভাষা ক্রমশ তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। ভাঙে আবার গড়ে। ক্ষ্য করলে দেখবো তিরিশের দশকে যে আঙ্গিকে, যে অবকাঠামোতে বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে, এই শূন্য দশকে বা এখনো তেমনটি হচ্ছে না। তার কারণ, বদলে গেছে বিশ্বের চারপাশ। বেড়েছে নিসর্গের নানা নির্মিতি। যোগাত্মক এবং বিয়োগাত্মক দুটি দিকেই পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তন মেনে নিয়েই এগুচ্ছে জীবন-সমাজ-সংসার। এর সমন্বয় সাধন করেই যাচ্ছে মানুষ। নিজেকে তৈরি করছে নিজস্ব আঙ্গিকে।

একটি ভাষাকে যারা নতুন নান্দনিকতায় রূপ দেন তারা হচ্ছেন সে ভাষার লেখক। লেখকরা প্রতিনিয়ত তাদের মননশীল চিন্তাটুকু ভাষার জন্য, ভাষার পাঠক-পাঠিকার জন্য রেখে যান। কিন্তু একটি ভাষার কাছে একজন লেখকের কি কিছুই চাওয়ার থাকে না? অবশ্যই থাকে।
এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান কবি মি. জেমস টেট-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, 'সব সৃজনশীল লেখকই চান মহাকালের মানুষ তার লেখাগুলো গ্রহণ করুক।' প্রকৃতপক্ষে যে ভাষার মানুষ, যে জাতি তার সৃজনশীল লেখকদেরকে বেশি মূল্যায়ন করে সে প্রজন্ম ততো বেশিই উপকৃত হয় এবং এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। এসব কথা বাঙালি জাতিও জানে নানাভাবে। জানেন রাষ্ট্রকর্তারাও। তারপরও কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনমন্যতা। চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা! কেন এমন করা হয়? এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির গৌরবের মাস। এ গৌরব রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। মাসব্যাপী বইমেলার সংবাদটি এখন জানেন প্রায় গোটা বিশ্বের মানুষ। জানেন বিভিন্ন ভাষার লেখকরাও। তারপরও আমরা হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি বইমেলার মতো জ্ঞানার্জনের প্ল্যাটফর্মটিও দখল করে রাখেন রাষ্ট্র শাসকরা। বইমেলার উদ্বোধন, সম্মানিত লেখকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না? প্রকৃত লেখক কখনোই রাজনীতি দ্বারা প্ররোচিত হন না। হতে পারেন না। সত্যের স্বপক্ষে, মানুষের স্বপক্ষে, মানবতার স্বপক্ষে কর্মই তার বড় পরিচয়। আর কোনো পরিচয় তার থাকার কথা নয়। তারপরও লেখকদেরকে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করি।
আমরা সংবাদ মাধ্যমে, বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান দেখি। তাতে দেখা যায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়েছেন কোনো মন্ত্রী, আমলা, শীর্ষ ব্যবসায়ী (নব্য মিডিয়া ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছেন), কিংবা সমাজের অন্য কোনো ক্ষেত্রের ক্ষমতাবান। আমরা দেখি রাষ্ট্রের শীর্ষ কবি, লেখক, কথা সাহিত্যিকরা বসে আছেন দর্শক সারিতে। কেন এই জবরদখল?
এই মানসিকতা থেকে লেখক-পাঠকসহ সর্ব শ্রেণীর সচেতন মানুষের বেরিয়ে আসা দরকার। মনে রাখতে হবে একটি প্রকাশনা উৎসব, কোনো জনসভা নয়। তাই তাতে কয়েক হাজার লোক সমাগমও আশা করা উচিত নয়। বিশ্বের শীর্ষ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকাশনা উৎসবগুলো, কয়েকশত মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর এই কয়েকশত মানুষই মূলত একটি সমাজের, একটি ভাষা বিনির্মাণের শীর্ষ নেতৃত্ব দিয়ে যান।

দুই.

একটি ভাষাভাষি মানুষ যখন একজন লেখককে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে পুরস্কৃত করে তখন তাই হয়ে উঠে লেখকের জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য আর তার নিয়ন্ত্রকরা এ বিষয়ে বড় কৃপণ বলেই আমার কাছে মনে হয়। বাংলাদেশে একটি মর্যাদাশীল পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমী পুরস্কার। ১৯৬০ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বাংলা একাডেমীর  ওয়েব সাইটে  দেয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায় এর মধ্যে ১৯৮৫, ১৯৯৭, ২০০০ সালে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দেশে কোনো যোগ্য লেখক ছিলেন না সময়ে? নাকি রাজনৈতিক কারণে বছরগুলোতে একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয়নি? কেন দেওয়া হয়নি এর সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যা সংবলিত কোনো কারণ একাডেমীর ওয়েব সাইটে নেই।

ক্ষ্য করলে আরো দেখা যাবে যারা পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের মাঝে বেশকিছু লেখক-লেখিকা ইতিমধ্যেই পাঠক বিস্মৃত প্রায়। এ প্রজন্মের অনেকেই এদের নামটি পর্যন্ত জানেন না। তাদের লেখালেখি পড়াতো দূরের কথা। মহাকাল এভাবেই একজন লেখকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
কেউ হয়তো বলতে পারেন, বিশ্বখ্যাত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর পর্যন্ত, আজ অবধি যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবার নাম কি আমরা মনে রেখেছি? এর উত্তর 'হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দুটোই হতে পারে। নোবেল যারা পেয়েছেন, তারা বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিভিন্ন ভাষাভাষি লেখক-কবি। আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন মনে রেখেছি, সে সব ভাষার কবি-লেখকরাও নিজ নিজ ভাষাভাষির কাছে সমানভাবে সমাদৃত। গোটা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের সে খোঁজ নয়।

বাংলা ভাষার লেখক কবি যারা মেধার মূল্যায়নে (অবশ্যই রাজনৈতিক কোটাভিত্তিক পুরস্কার বিবেচ্য নয়) একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের লেখাগুলো, গ্রন্থগুলো, নিয়মিত পুনঃপ্রকাশ করেনি বাংলা একাডেমী। যার ফলে তারা কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছেন। এটা খুবই যৌক্তিক কথা, শুধু একজন লেখককে কিছু অর্থ সম্মানী আর ক্রেস্ট-সনদ দিয়ে দিলেই জাতীয় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ঐ লেখকের লেখাগুলো সংরক্ষণ, পুনর্মুদ্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও পালন করতে পারে বাংলা একাডেমী, কৃতিত্বের সঙ্গে। এ ছাড়া বর্তমান তরুণ লেখকদেরকেও বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমী’।

ভাবতে অবাক লাগে অনেক সাহিত্যিকও এখনো একাডেমী পুরস্কার পাননি। এমন কবি-লেখকদের তালিকা বেশ দীর্ঘই হবে যারা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিন্তু এ যাবৎ পাননি। মেধাবৃত্তির বিবেচনায় একাডেমী পুরস্কার প্রদানে উদ্যোগী হবে বলেই জাতি আশা করে। মনে রাখতে হবে ভাষার প্রহরী লেখক-পাঠক-জনমানুষেরাই। রাষ্ট্র নায়করা এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক নন।

***

 

 

“ আ ’মরি বাংলা ভাষা ”
মধুবন্তী


আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী...২০১১ সালে একবিংশ শতকের প্রজন্মের মনে এই দিনটি খুব একটা প্রভাব সৃষ্টি করে কি? ২১শে ফেব্রুয়ারী বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে নাড়াঘাঁটা স্কুলের পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ থাকে বর্তমানে। বাংলা ভাষাটা আমাদের ঘরোয়া ভাষা হয়েই কেমন একটা গণ্ডীবদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হয় না? এখন তো ইংরেজী শিক্ষার যুগ! যদিও আমি এই শিক্ষার বিপক্ষে নই। এই বিশ্বায়নের যুগে জাতি-ধর্ম-দেশ-মহাদেশ নির্বিশেষে একটিই সাধারণ ভাষা থাকলে সুবিধে হয় তা আজ দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপলব্ধি করাই যায়। আজ বাঙালী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা শীর্ষস্হানও লাভ করেছে এবং করছে। কিন্তু যে ভাষার নামে তাদের পরিচয় সেই ভাষা তাদের রোজকার জীবনে কোন স্হানে রয়েছে? বিশ্বের দরবারে সে কতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে? ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ বা তাদের স্বপ্ন আজ কতটা সফল? একুশের চেতনা আজ আমাদের মন কতটা ধরে রাখতে পেরেছে?---এই প্রশ্নগুলো আজও এই দিনটিতে সামনে এসে পড়ে!

 

বাংলা ভাষা পূর্বীয় ইন্দো-আর্য ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে (বর্তমানের বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরা ও আসামের কিছু অঞ্চল) সংস্কৃতের অপভ্রংশ মাগধী-প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উতপত্তি হয় ১০০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দে। জন্মের প্রথম লগ্ন থেকেই এই বাংলাভাষা এতটাই উন্নত এবং সমৃদ্ধ যে সাংষ্কৃতিক বৈষম্যের উর্ধ্বে গিয়ে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অগণিত মানুষকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিল। গড়ে তুলেছিল বাংলা সংষ্কৃতি ও জাতি। কিন্তু মাতৃদুগ্ধসম এমনই এক ভাষাকে যখন বর্জন করার আদেশ এলো তখন সন্তানদের বুকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেজে উঠেছিল বিদ্রোহের দামামা যার আগুন জ্বলেছিলো ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে।
 

একুশের ভোরে আজও অধুনা বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য হয় শহীদ মিনার। বাংলাদেশই হোক বা ভারতবর্ষের পশ্চিমবাংলা — দুই দেশেই এই বিশেষ দিনটিতে মানুষের ঢল নামে পথে। বাংলাভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে শুধু নয় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে বিসর্জিত প্রাণগুলোর জন্য অন্তর থেকে বর্ষিত হয় শ্রদ্ধা। ফুলের স্তবকে, গানে প্রকাশ পায় আবেগ। হৃদয় উদ্বেলিত হয় বাঙালী হওয়ার গৌরবে। কিন্তু সত্যিই কি আজ সেই রক্তে রাঙানো প্রেক্ষাপট আত্মস্হ করা সম্ভব হচ্ছে?


বাঙালীদের একটি বদনাম দেওয়া হয় এই বলে যে
, তারা নাকি নিজস্বতাকে ধরে রাখতে পারেনা, তারা নকলনবীশ। কিন্তু বাংলার বাইরে পরবাসের আঙিনায় দাঁড়ালে আজ সে কথার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা যেতে পারে। আমরা বাইরে নিজেদেরকে পালটে নিই যুগের সঙ্গে পা মেলাতে, কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালীয়ানা একশোভাগ বজায় থাকে। বাইরের প্রত্যেকটি দেশে বাঙালীদের নিজস্ব সংগঠন রয়েছে অন্ততঃ পাঁচজন বাঙালীও যদি একসাথে হয় তারা চেষ্টা করে যৌথভাবে থাকবার, বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে দিয়ে দেশের মাটির গন্ধ পাওয়ার...এমনকি এই ভাষা দিবসও পালিত হয় দেশে দেশে। সেই ভাষা দিবস পালনের চেষ্টা সবটুকুই আন্তরিক ... কোনো কৃত্রিমতা থাকেনা তাদের মননে।


এই তো গেল প্রবাসী বাঙালীদের কথা। নিজ দেশে নবীনতম বাঙালী প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন বা বাংলা ভাষা কি মূল্য রাখে? এই প্রজন্ম আজ অতি দ্রুতগতি যুগের অত্যাধুনিক মানুষ সব, যে
খানে তাদের যেকোনো অনুভূতির স্হায়িত্ব  কয়েক মিনিটের, সেখানে একটি ভাষা কিংবা তার জাতীয়তাকরণের জন্য আন্দোলন আজ কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাদের মনে? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বাঙালী চলচ্চিত্রকার বলে গেছেন যে, বাংলা ভাষা চাইলে তিনদিনেই ভোলা যায় আর না চাইলে তিরিশ বছরেও ভোলা সম্ভব নয়। আধুনিক প্রজন্ম বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আজ ইংরেজী ছাড়া কথা বলেনা, তাদের পড়াশুনোর মাধ্যমও ইংরেজী হলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে... কিন্তু আমরা সংষ্কৃতিকে বিসর্জন দিতে পারিনি বা বলা ভালো, সংষ্কৃতিকে বিসর্জন দিতে পারা যায় না।
 

এই প্রবাসে বসে দেশের লোকজনদের সাথে যোগাযোগ রাখি ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিন্তু কথা বলি বাংলায়। কোনো একজনের সাথে পাঁচ মিনিট বাংলায় কথা বললেও মনে হয় নতুন করে আর একটা দিন বাঁচলাম! দেশে বা বিদেশে বাঙালীর বারোয়ারী কোনো অনুষ্ঠানে যেমন দুর্গাপূজোয় নব প্রজন্মের উসাহ উদ্দীপনা উন্মাদনা থাকে সবথেকে বেশী---যতই সারা বছর ইংরেজী বুলি কপচাই, এই বিশেষ দিনগুলিতে ষোলো আনা বাঙালীয়ানাতেই তো ডুবে থাকি। আধুনিক প্রজন্মের ব্যান্ড গান আজ দেশে বিদেশে বাংলা ভাষাকে পৌঁছে দিয়েছে এক নতুন আঙিনায়। নিজের মনের ভাব, ছন্দ-অছন্ধ মিলিয়ে সর্বসমক্ষে যখন প্রকাশ করি সেও তো বাংলাতেই! প্রবাসে থাকা পথ চলতি বাংলাভাষী মানুষের মন উন্মুখ হয়ে থাকে একটাই প্রশ্ন করার জন্য বা শোনার জন্য, ‘আপনি বাঙালী’? বাংলা ভাষা-সংষ্কৃতির উপর হয়তো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার হয়েছে বেশী মাত্রায়। তবুও তো আজ কোনো শিশু প্রথমবার তার মাকে বাংলাতেই সম্বোধন করে! ইংরেজী শিক্ষার পাশপাশি বাংলা সাহিত্য জগতের সাথে তার পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই যাঁকে ছাড়া এখনো পর্যন্ত বাংলাভাষা জৌলুসহীন।

 

বাংলাভাষার মিষ্টতা এবং তার সমৃদ্ধি মন ছুঁয়েছে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের এমনকি বিদেশীদেরও। সেই জন্যেই দুনিয়া কাঁপানো গায়কসম্রাট মৃত্যুশয্যায় সঙ্গী করেন কবিগুরুর গান অথবা কাব্য, কিংবা অবাঙালী চিত্রপরিচালক ডুবে থাকেন বাংলা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে একের পর এক নতুন সৃষ্টিতে। প্রবীণেরা প্রশ্ন করতে পারেন যে একুশের সেই ক্রন্দন কি আজকের প্রজন্মের কানে বাজে? ধারণ করা সম্ভব একুশের সেই হিংসা-ক্রোধকে? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ কি আজও বুকের গভীরে রক্তক্ষরণ ঘটায়? কিন্তু এই বিশেষ দিনটিকে শুধু রক্ত ঝরানোর দিন হিসেবে মনে রাখতে হবে কেন? একুশের মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ বাংলা অ-মুসলমানদের ভাষা, উর্দু মুসলমানদের ভাষা---এমন কথা প্রত্যাখ্যান করা। বাংলাদেশে এটি আজ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের স্বতন্ত্রতায় এই ভাষা আজ ষষ্ঠ স্হান অধিকার করে রয়েছে সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে। ৩০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন আজ সমগ্র পৃথিবীতে!


আজ দেশে-বিদেশে ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বাংলাভাষী মানুষেরা একটিই জাতি, তাদের একটিই পরিচয় -তারা বাঙালী।
এই ভাষা আন্দোলনকে সন্মান জানাতে
UNESCO ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে স্বীকৃতি দেয়। অন্য কোনো জাতির বা দেশের ভাষা কিন্তু এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। একটি কালের বৃত্তে থেকেও অন্য একটি কালকে ধারণ করা যেতে পারে কারণ যে ভাষা একটি সংষ্কৃতিকে, একটি জাতিকে জন্ম দিয়েছে সেই সংষ্কৃতি, কালের গহ্বরে তলিয়ে যায় না, সেই জাতি শিকড়সহ সমূলে উতপাটিত হয়না। তারা ভুলে যায়না পূর্বজদের রক্তে লেখা ইতিহাস। সে জাতির উত্তরসূরীরা তাদের নিশান বয়ে নিয়ে চলে উজ্জ্বল এক ভোরের দিকে! তাই একুশে ফেব্রুয়ারীকে রক্তঝরা অশ্রুসজল একটি দিন হিসেবে শুধু পালন না করে এর মূল্যবোধ ও চেতনা যাতে সারা বছর পরিব্যাপ্তি লাভ করে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে যাতে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা হয় সেই চেষ্টা করতে হবে।
 

***

 

অনাম্নী স্বাক্ষরের ক্ষেদোক্তি
একুশে ফেব্রুয়ারির মিনতি



আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
বাংলা মায়ের সন্তান হয়ে, তা’ কখনও ভুলতে পারি?

এই অনুভূতি আমাকে আপনাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখার সাহস জাগিয়ে দিল।

তাহলে বলি! কোথা থেকে শুরু করবো জানিনা...

কলকাতার বাঙালী বাবা মায়েরা আজ বহুকাল হল তাদের সন্তানেরা বাঙ্গলা বলতে না পারলে বা আধ আধ ভাঙা ভাঙা বাঙ্গলা বললে কেমন যেন প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করেন! ' আমার মেয়ে বাংলা পড়তে পারে না কারণ ও থ্রু-এন-থ্রু লরেটোতে পড়েছে কিন্তু ও ঐ সেই নজরুল গীতিটা কি ভাল যে গায়...' এইরকম পুলটিশের আস্তরণের নিচে কত যে বাঙ্গলী মায়েরা অশিক্ষার যৌবন ধরে রেখেছেন তা নব্য কিটী পার্টি কালচারের অনুষ্ঠানের দেওয়ালে কান পাতলেই জানা যাবে। কিম্বা সপ্তাহান্তে স্কটিশ সোমরসে জারিয়ে নিতে নিতে কত নির্বোধ পিতার দুর্বোধ উক্তি শোনা যায় কোনও বন্ধুর উদ্দেশ্যে – “আমার সানি তো হ্যারি পটার প্রায় মুখস্থ বলতে পারে সব কটাই কিন্তু ও যখন বাংলা বলে তখন আমরা খুব এনজয় করি -ডনবস্কোতে পড়ে সেই প্লে স্কুলের পর থেকেই !’’ এর থেকেও বড় অবক্ষয়ের নিদর্শন আর কোথাও পাওয়া যাবে কি?

পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া বা মেদেনিপুরের ভাষাকে বাংলা বলে মেনে নিতে দক্ষিণবঙ্গের অনেকের বুক জ্বালা করে!সেটা প্রকাশ না পেলেও অনুভূত ও সর্বজনবিদীত! নবজাগরণ ঘটেছে বাঙ্গালীর – তারা আজকাল বাংলায় শুধু বাস করেন আর কথা বলেন খিচুড়ি ভাষায় – স্বপ্ন দেখেন ইংরেজীতে - সংস্কৃতি চর্চা করেন বলিউড বা হলিউডের প্রবাহে। আর নিজেকে কসমোপলিটন হিসেবে পরিচিত করার সে কি অদম্য বাসনা – কামনাও বলতে পারেন! হায়রে বাঙ্গালী মা আর তার অভাগা সন্তানের দল!

উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে আজ বহুকাল হলো নেপালী মুখ্য ভাষা। সেখানে রাজনৈতিক সহবস্থান অনেক বেশী মূল্যবান ভাষার মূল্যের থেকে।

পূর্ব্ববঙ্গে ঢুকব কিনা ভাবছি। ঢাকার পথে বাঙ্গলা তো শোনা যায় কিন্তু চলন বলনে বাংলা কোথায় – এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই কি ভাষা আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল! আজকাল ঢাকার বাঙ্গালী ছেলে মেয়েরা বাংলা ইন্টারনেট সাইটে চ্যাট করেন আমেরিকান ইংলিশে – হেই না হলে আমাগ মাতৃভাষা – কি কও মিঁয়া!

আমেরিকায় দশ লক্ষ বাঙ্গালী আছেন শুনেছি। তাদের প্রথম প্রজন্মও আজ (আহ)ম্যারিকান বাংলা বলেন আর তাদের সন্তানেরা? তারা বর্ণপরিচয়ের নামও শোনেননি। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের নাম যেন কোনও দূরের গ্রহের বাসিন্দার নাম! হায়রে বাঙ্গালী! ব্যাতিক্রমের কথা এখানে না বলাই ভাল কারণ তা’তে নিয়মের অস্তিত্বকে আরও জোরালো করে দেওয়া হবে আর কষ্টটা আরও বাড়বে!

পৃথিবীতে এর থেকে নির্লজ্জ আর কোন জাত আছে নাকি যারা নিজের ভাষায় কোন পত্রিকা পড়ার আগে দেখে নেয় চারপাশে কোন স্বজাতি আছেন নাকি! শঙ্করের – মানে মনিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি সেই সত্তর দশকে -আমেরিকার কোনও বিমানবন্দরের লাউঞ্জে এক রাত কাটাবার পর তার সহযাত্রীনী যে একজন বাঙালী এটা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন – তাও কি ভাবে? কারণ তার সহঅপেক্ষিতা যাত্রীনীর এক অরক্ষনীয়া কন্যার বিবাহার্থে তিনি বাঙ্গলায় ফিরেছিলেন। অবশ্য এর মাঝে মাঝেই চিউইংগাম চিবোনো ইংরেজী এসেছিল সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে। কি করবেন তিনি? আমেরিকায় থাকেন কি না!

আমাদের কি কোনও চেতনা হবে না? না বোধ হয়। মুম্বাই বা দিল্লি শহরে কত বাঙ্গালী আছেন? কেউ জানেন? এরা দুর্গা পূজা করেন – উত্তেজনার ফষ্টিনষ্টি করার জন্য। হ্যা বাংলা গান গাইয়েরা যান সেখানে কলকাতা থেকে – ব্যান্ডের গান বা আধুনিক রবীন্দ্র শোনাতে! সেই গান কেন আমি পারিনা শোনাতে বা মন চায়না শুনতে? কেন এত লজ্জা হয় সেই সব সাংস্কৃতিক মাফিয়াদের বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে ? কেন জানেন? এরা অনেকেই বাংলা বলতে বা পড়তে পারেনা –তারা বলে যে তাদের মা বাবা শেখান নি। বাহ! বাহ রে বাঙ্গালী-

একবার দক্ষিণের তুলুভাষীদের কাছ থেকে শিখে আসুন কি করে মাতৃভাষাকে সম্মান করে ভালবেসে বাঁচিয়ে রাখতে হয় কিম্বা তেলুগু, কন্নড়, মালায়ালী বা তামিলভাষীদের কাছে গিয়ে জানুন কেন তাঁরা মাতৃ ভাষাতেই কথা বলেন! তামিল, তুলু, কন্নড় বা মালায়ালীদের কিন্তু তা নিয়ে কোনও রাখঢাক গুড়গুড় নেই। ভারতের বানিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই শহরে কি সহজভাবে সবাই মারাঠী ভাষায় কথা বলেন! কোনও রকম হীনমন্যতা নেই ওদের মধ্যে! রাশিয়া বা চীনে গিয়ে কি ফাঁপড়ে পড়বেন যদি না তাদের ভাষা আপনার জানা থাকে! ওঁরা যথেষ্ট গর্বের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলেন এবং বিদেশীরা ওঁদের ভাষা বুঝলে বা বললে তাঁকে আলাদা সন্মান করেন! এদের কারও কোনও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আছে কি? তাদের রক্ষণশীল বলে বাঙ্গালী পিছনের দরজা দিয়ে পালায় আর পালাতে গিয়ে নিজের বিবেকের চৌকাঠে ক্রমবর্দ্ধমান হারে হোঁচট খায় আর প্রগতিশীলতার আইসক্রীম খেতে খেতে আরও শীতল এক জাত হিসেবে পরিগণিত হন। যা হচ্ছে ভালই হচ্ছে – তাই না?

আমাদের কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এক গৌরবাত্মক ইতিহাস আছে – আছে কত প্রাণ দেবার যন্ত্রণা – কত মায়ের বুক খালি করা দুঃখের কাহিনী – কিন্তু সেসব তো একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করার জন্য – আর কি কোনও প্রয়োজন আছে এই লেখা এগিয়ে নিয়ে যাবার? অনাম্নীর এই খেদোক্তি পাঠককূলকে স্বস্তিহীন এই পাঠের হাত থেকে মুক্তি দিল এখানেই! গভীর দুঃখের সঙ্গে এই ভাষা আজ নীরব হল এই কলমে। কিন্তু ভালবাসার বাংলা ভাষা আমার থেমে থাকবেনা এখানেই...
 

অনাম্নী স্বাক্ষর
একুশে ফেব্রুয়ারি ২০১১
 

***

 

ভুল বানান

  হাফিজ আহমেদ

পাঠ্য পুস্তুকে ও স্বনামধন্য লেখকদের বইতে অসংখ্য ভুল বানান দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো অনেকদিন পরপর পুনর্মুদ্রিত হয়। কিন্তু সম্পাদিত হয় না। সেখানে আমাদের মতো নগণ্য পাঠকদের মতামত প্রকাশের সুযোগ খুবই সীমিত। অপরদিকে অগ্রসর দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিন ও প্রতিসপ্তাহেই আধুনিক ও ব্যাকরণ সম্মত বানান অনুসরণ করে সম্পাদিত হয় বলে, ভুল বানান খুব কম দেখা যায়। এখানে আমাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ ব্যাপক। আমরা যা লিখি প্রকাশগণ তাদের পত্রিকায় তা প্রকাশ করেন। আমরা তখন বাধিত হই। আর সেজন্য প্রকাশকদের সাধুবাদ জানাই। স্বাধীনতার পর থেকেই এসব বিষয়ে আমরা লিখে আসছি। ফলে ভুল বানান ধীরে ধীরে  কমে আসছে। এখনও যেসব শব্দ ভুল বানানে প্রতিদিন পত্রিকায় মুদ্রিত হয় তা দেখে ব্যথিত হই। সেসব শব্দের প্রতি সম্পাদকদের দৃষ্টি চাই। অফিস, প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও বিজ্ঞাপনে শুদ্ধ বানান আসবে, তাও আমরা চাই। সবাইকে সবিনয়ে জানাতে চাই যে, ভুল বানান নির্মূল করার লক্ষ্যে আমরা যে সরব ও কলম অভিযান চালাচ্ছি, তা চলতে থাকবে।  বর্তমানে যেসব শব্দ ভুল বানানে মুদ্রিত দেখি সেসব নিয়েই এখন আলোচনা করবো

১।যদুলিখতে য ব্যবহার করা হয় ঠিকই। কিন্তু জাদুকরবা জাদুঘরলিখতে ব্যবহার করা যায় না।

২।ঘোষণালিখতে ব্যবহার করা হয় ঠিকই। কিন্তু ঘুস’, লিখতে ব্যবহার করা যায় না।

৩।পোষণলিখতে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু পোশাকলিখতে এবং আপসলিখতে ব্যবহার করতে হবে।

৪।বসন’, ‘আসন্নলিখতে ব্যবহার করা হয় ঠিকই। কিন্তু ভাষণ’, ভীষণ’, ভূষণ’, ‘দূষণ’, ‘শোষণ’, ‘পোষণ’, বিষন্ন’ ‘পাষাণ’ ‘ঘোষণা প্রশিক্ষণলিখতে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, ‘এর পর অবশ্যই হবে।

৫।মুহূর্ত’, মুমূর্ষু’, শুশ্রূষালিখতে অনেকেই প্রথম বর্ণেই  ূ - কার দিয়ে ফেলেন। তা ঠিক নয়। প্রথম বর্ণে  ু- কার, দ্বিতীয় বর্ণে  ূ-কার আসবে।

৬।ভূগোল দূরান্তলিখতে  ূ-কার হবে। কিন্তু ভুবনদুরন্তলিখতে  ু-কার হবে।

৭। অনেকেই উচিত খদ্যোতলিখতে ব্যবহার করে থাকেন। শব্দ দুটোতে ব্যবহার করতে হবে।

৮।দেখা যায় বিদেশি শব্দ লিখতে কখনও কখনও ব্যবহার করেন। তা ঠিক নয়। শব্দ গুলোর বানান হবে, ‘সোভিয়েত’, ইয়েলতসিন’, ‘সানইয়েত সেন’, ভিয়েতনাম’, ‘নাতসি’, ‘ব্লিতসক্রিগ’, ‘ইবাদত’, ‘হেমায়েত’, ‘সাহাদাত’, ‘হায়াত’, লুতফর’, ইত্যাদি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোন বিদেশি শব্দ লিখতে ব্যবহার করা যায় না।

৯। কোন কোন সম্পাদকীয়তে দেখেছি মেডিকেল। তা ঠিক নয়। শুদ্ধ বানান হবে মেডিক্যাল। যেমন  ‘সার্জিক্যাল’, ‘অপটিক্যাল’, ‘কেমিক্যাল’, ‘ফার্মাসিউটিক্যাল’, ‘অ্যাকাডেমিক্যাল’, ‘ক্যালসিয়ামইত্যাদি।

১০। অনেকেই শ্রদ্ধাঞ্জলি গীতাঞ্জলিলিখতে  ী-কার দিয়ে বসেন। এটি অনেকেরই ভুল অভ্যাস। অর্থ্যাৎ কলমের টানে শব্দ শেষ হলেই একটা ী-কার দিয়ে ফেলেন। আমাদের মনে রাখা দরকার যে স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যতীত প্রায় সকল শব্দ শেষে আজকাল  ী-কার এর পরিবর্তে  -িকার ব্যবহার করা হচ্ছে।

১১। কোন কোন পত্রিকায় নোটিস’ ‘দিয়ে মুদ্রিত হয়। তা ঠিক নয়। যেসব ইংরেজী শব্দের শেষে CE আছে সেসব CE-র স্থলে বাংলায় অবশ্যই হবে। যেমনপুলিস’, ‘অফিস’, ‘ডিফেন্স’, ‘কমার্স’, ‘প্র্যাকটিসইত্যাদি। এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই।

১২। বাংলা শব্দেই কেবল  ৃ-কার ব্যবহৃত হয়। বিদেশি শব্দে নয়। যেমনপৃথিবী’, ‘বৃত্ত’, ‘নৃত্যইত্যাদি। কিন্তু কোনো বিদেশি শব্দে যেমনব্রিটেন’, ‘ব্রিটিশ’, ‘ফ্রিজ’, ‘ব্রিজ’, ‘ব্রিগেডিয়ার’, ‘ব্রিস্টল’, ‘খ্রিস্টাব্দলিখতে কখনও  ৃ-কার ব্যবহার করা যায় না।

১৩। রেফ’, উপরে থাকলে বর্ণ কখনও দ্বিত হয় না। যেমনআচার্য’, ‘কার্যালয়’, ‘ধৈর্য্’,  ‘আয়ুবের্দ’, ‘শীর্বাদ’, ফার্মাসি’, চক্রবর্তি’, ‘বর্ষপূর্তিইত্যাদি।

১৪। উপরে রেফথাকলে নিচে অবশ্যই হবে। যেমনস্বর্ণ’, ‘কর্ণ’, ‘বর্ণ’, ‘পূর্ণিমাইত্যাদি। এই নিয়মে অনেকে ঝর্ণালিখে থাকেন। তা ঠিক নয়। ঝরনালিখতে  রেফ লাগে না। তাই আসতে পারে না। এটি মনে রাখার মতো একটি চমৎকার ব্যতিক্রম।

১৫। অনেকেই হর্ন’, জার্নাল, কর্নার, মর্ডান, কর্নেললিখতে ব্যবহার করে থাকেন। তা ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো বিদেশি শব্দ লিখতে কখন ব্যবহার করা যায় না।

১৬। অনেকেই স্লোগান’, ‘ক্লাস’, ‘পাসলিখতে ব্যবহার করে থাকেন। তা ঠিক নয়। ইংরেজী 'S' এবং ‘SS’ এর স্থলে বাংলায় অবশ্যই হবে। তবে শুগার’, ইশ্যুলিখতে ব্যবহৃত হয়। এ দুটি ব্যতিক্রম মাত্র।

১৭। ইংরেজী ‘ST’ র স্থলে বাংলায় সর্বদাই স্টহবে। যেমনঅগাস্ট’, ‘স্টার’, স্টোর’, ‘স্টিকার’, ‘ইস্টার্ন’, ‘স্টুডিও’, ‘ডেনটিস্ট’, ‘খ্রিস্টাব্দ’, ‘ফোটোস্ট্যাট’, ‘ইনডাস্ট্রিজইত্যাদি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো বিদেশি শব্দ লিখতে কখনও বা ষ্টব্যবহার করা যায় না। ওসব ক্ষেত্রে সর্বদাই বা স্টব্যবহার করতে হবে।

১৮।অন্বেষা  স্বদেশইংরেজিতে লিখতে অনেকেই Annesha Shadesh লিখে থাকেন। শব্দ দুটির শুদ্ধ বানান হবে  AnweshaSwadesh.

১৯। ‘West End School’ বাংলায় ওয়েস্ট এনড স্কুল হবে। ‘End’ -এর জন্য এনড’, ঠিকই আছে। কিন্তু ‘And’ এর জন্য অ্যানডহবে।

২০। ইংরেজি A-র জন্য বাংলায় অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাহয়। যেমনঅ্যানড’, ‘অ্যাসিড’, ‘অ্যালকোহল’, ‘অ্যাপেক্স’, ‘অ্যানজেল’, ‘অ্যাডভোকেট’, ‘অ্যাভিনিউ’, ‘অ্যাকাডেমিইত্যাদি।

২১। অনেক সাইন বোর্ডে দেখা যায়, ‘কোম্পানী’, ‘কোতায়ালী’, ফটোষ্ট্যাট। এসব ক্ষেত্রে সঠিক বানান হবে, ‘কম্পানি’, ‘কোতোয়ালি ফোটোস্ট্যাট

২২। বাংলা বর্ণমালায় ’, ‘ ’-এর জন্যে ইংরেজির ‘N’ হবে। কিন্তু ইংরেজির ‘N’ এর জন্যে বাংলায় কেবলই হবে। বা হবে না। তার পরবর্তি বর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি করবে না। যেমন, ‘ক্লিনটন’ (ক্লিন্টন নয়), ‘ক্যানটনমেন’, ‘কনটিনেনটাল’, ‘লনডন’, ‘অ্যানড’, ‘ফ্রেনচ’, ‘বেনচ’, ‘সেনচুরি’, ‘অ্যানজেল’, ‘চ্যালেনজ’, ‘লাউনজ’, ‘মনজুরইত্যাদি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোন বিদেশি শব্দ লিখতে বা কোনটাই ব্যবহার করা যায় না।

২৩। অনেকেই  শব্দ সংকোচনে ব্যবহার করে থাকেন। যেমনকোং’ ‘তাং’, ‘নংইত্যাদি। এ বিধি ব্যাকরণ সম্মত নয়। তাই সংকোচন না করে পুরো শব্দটাই লিখতে হবে। যেমনকম্পানি’, ‘তারিখএবং নম্বর

২৪। শব্দ সংক্ষিপ্ত করতে আবার অনেকেই  ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে থাকেন। যেমনডাঃ’ ‘অবঃ’, ‘মোঃ’, ‘লিঃইত্যাদি। কিন্তু ব্যাকরণে এরকম কোনো বিধান নেই। তাই বিদগ্ধ সম্পাদকগণ এসব ক্ষেত্রে ‘.’ বিন্দুর আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। শব্দগুলো মুদ্রিতাকারে দেখতে খুবই সুন্দর। যেমনডা.’, ‘অব.’, ‘মো.’, এবং লি.

বাংলাভাষায় ‘.’ বিন্দুর আগমন, শুভেচ্ছা, স্বাগতম!  সম্পাদকগণ একটি অঘোষিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ‘.’ বিন্দুর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে কোন ফাঁকে বিন্দু যে বিসর্গের স্থান দখল করে নিয়েছে, তার বিন্দু বিসর্গও আমরা টের পাইনি। যখন টের পেয়েছি, বিন্দুর অবস্থান তখন সুগভীরে সুপ্রোথিত। এ বিন্দুই বিন্দু বিন্দু করে দিনদিনই ভাষার শ্রী বৃদ্ধি করে চলেছে। এর কৃতিত্ব সবটাই সম্পাদকদের।

তিনটি বিষয় এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।

      . বিদেশি শব্দে কখনও ী- কার ূ-কার ও ৃ-কার ব্যবহার করা যায় না।

      . বিদেশি শব্দে কখনও ছ, , , ,ও ৎ বর্ণগুলো ব্যবহৃত হয় না।

      . স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যতীত শব্দশেষের ী-কার এর ব্যবহার আজকাল অনেক কমে এসেছে।  

ভাষাবিদগণ আগ্রহ দেখালে শব্দশেষে ী-কার এর ব্যবহার আরও কমে আসবে লেখার এ অংশটুকু  কপি করে টেবিলের উপর রাখলে, ভাষা প্রেমিকদের বানান সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বানান ভুল দ্রুত কমে আসবে। মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’, এটা কবির কবিতা! ভালোভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা! সে কি কম আনন্দের কথা?

***

 

যথারীতি প্রকাশনা

ধারাবাহিক গল্প

 

পৃথিবীলোক

একাধিক একা

*

প্রবন্ধ

যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ

*

আর্কাইভ

Best view with Microsoft Internet Explorer

Font download link: http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf