নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি।

 

সম্পাদক

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

পাঠক পরিষদঃ শুভলগ্না শোয়ারা, চঞ্চল চৌধুরী

প্রচ্ছদ চিত্রাংকনঃ রুমমা

Suprateek Aroop Ghosh, Humaira Haroon, Nauba Aloke Bangla

 

   

ডিসেম্বর ১৯৭১

ফকির ইলিয়াস


অনেকটা রোদকে চিনে নিয়েছি তখন । সেই ভোরবেলা
সেই তুমুল সর্ষে ক্ষেতে হলুদের ঢেউ দেখতে দেখতে খুব
সাবধানে এগিয়েছি বাঁকে । সুরমা আর বাসিয়া নদী দুটির
মিলন মোহনায় , একটি সূর্যকে স্বাগত জানাবো বলে।

একটি শিখার কাছে বন্ধক রেখেছি আমার সব প্রেম , আর
প্রতিমার প্রথম চুম্বন । এই মাটিঘেরা উষ্ণ বাদাড় । কিছুটা
অবহেলায় , হেলান দিয়ে দেখেছি উত্তরগামী নৌকোর সারি।

হাফপ্যান্ট পরা ক'জন যুবক আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে
যেতে জানতে চেয়েছে তোমার কথা ।
'কেমন আছে মাধবী ' ?
আমি ওদের বলে দিয়েছি, একটা শাদা শাড়ীর চিহ্ন রেখে
যে নিয়েছে বিদায়, ওর কোনো সমাধি নেই........

শুধুই রেখে গেছে ঘন পৌষের মতো
সবটুকু ভালোবাসার দায় ।

 

 

 

 

 

গণহত্যা যুগে যুগে, গণহত্যা -৭১

 

বিজয়ের মাস -ডিসেম্বর। আনন্দের মাস ডিসেম্বর। কিন্তু আনন্দের মাঝে রয়েছে মানুষের আত্মত্যাগের কষ্ট, যন্ত্রণার ইতিহাস আর গণহারে চালানো বাংলার মানুষের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতনের স্বাক্ষর এবং পরবর্তীতে তাদের নিধন। এর নাম গণহত্যা। '৭১ এ বাংলার মানুষের ওপর চালানো গণহত্যা স্মরণকালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভয়াবহ মানুষ নিধনের একটি কর্মকান্ড। উন্মত্ততা আর পৈশাচিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এরকম হত্যা আগেও বহুবার ঘটিয়েছে মানুষ মানবতার বিরুদ্ধে । ১৯৩৩ এ যেমন শুরু হয়েছিল জার্মানীতে পোলিশ, রাশান ইহুদীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। ইংরেজীতে এই বিশেষ ধরণের মানুষ নিধনের কার্যপ্রণালীকে বলা হয় হোলোকোস্ট। সমগ্র বা whole আর kaustos বা পোড়ানো শব্দ দুটো একত্রে যুক্ত হয়ে হোলোকোস্ট শব্দের উতপত্তি। ইশ্বরের উদ্দেশ্যে শুধু পশু বলিদানের প্রথা পালনের ক্ষেত্রে এই শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহার শুরু হলেও পরবর্তীতে নাতসী বাহিনী কর্তৃক ইহুদী নিধনের ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ সীমাবদ্ধতা লাভ করেছে। সুপরিকল্পিত ভাবে গণহত্যা সম্পন্ন করে তা পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার অমানবিক পদ্ধতি নাতসী বাহিনী কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ্য করলেও বাংলার মাটিতেও তার প্রয়োগ বিভীষিকার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

 

 

হোলোকোস্ট ১৯৪১

 


গণহত্যা বলতে খুব সহজ ভাবে বুঝি জাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে বা ধর্মীয় কারণে বা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে কোন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিধন করা। ক্ষেত্রবিশেষে এই কারণসমূহ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য অভিন্ন থাকে আর তা হলো নৃশংসতা।

 

 

চিত্রঃ ল্যান্ডসবার্গ জার্মানীর কনসেনট্রেসান ক্যাম্প

 

 

 

চিত্রঃ গ্যাস চুল্লীতে নিহতদের অবশিষ্ট

 

 

 

 চিত্রঃ পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী নিরীহ বাঙালীদের হত্যার জন্যে ব্যবহার করতো ইলেকট্রিক চেয়ার। বাঁ চিত্রে ইলেকট্রিক চেয়ার  বদ্ধ অবস্থায়, ডানে ইলেকট্রিক চেয়ার খোলা অবস্থায়।

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে '৭১ এ স্থাপিত এ ঘাতক চেয়ারে বসিয়ে প্রতি মিনিটে বিশ জন মেরে ফেলা হতো।

চেয়ারটি এখন আছে ঢাকার জাতীয় যাদুঘরে। ছবি সংগ্রহ অমি রহমান পিয়াল


যুদ্ধে বন্দীদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রুদ্ধ করে রাখার জায়গাটিকে বলা হয় কনসেনট্রেসান ক্যাম্প। ১৯৩৩ সালেই হিটলারের বাহিনী ছয় লক্ষ ইহুদী, পাঁচ লক্ষ জিপসি, আড়াই লক্ষ শারিরীক বা মানসিক পঙ্গু ব্যক্তি, তিন মিলিয়নের বেশী সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী এবং আরো বিভিন্ন দলভুক্ত মানুষ যেমন জেহোভ্যা'স উইটনেস, সমকামী, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য, কমিউনিস্ট পার্টির নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং যারা হিটলার বাহিনীর কাছে অপ্রয়োজনীয় ও অগ্রহণযোগ্য তাদেরকে কনসেনট্রেসান ক্যাম্পে একত্র করে পরবর্তীতে কিলিং সেন্টারে অবস্থিত গ্যাস চেম্বারে চালান করে হত্যাকান্ড সংঘটিত করতো।


মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা নৃতাত্ত্বিক বিভেদ থেকে সৃষ্ট হয়। সে কারণে কোন হত্যাযজ্ঞ পালনের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা গ্রুপের কার্যকলাপ সবসময়ই প্রধান থাকে। সময়কাল তখন ১৯৯২. আমাদের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ২০ বছর পর আরেকটি গণহত্যার চিত্র বসনিয়া এবং হারজাগোভিনার ভয়াবহ মানুষ হত্যা। মুসলমান, সার্ব গোত্রহীন মানুষকে সেই একইভাবে কনসেনট্রেসান ক্যাম্পে জড়ো করে নির্যাতন ও হত্যা করা। এমনি আরো একটি চিত্র পলপটের গণহত্যা। সময় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯. কম্বডিয়ার নিরীহ সংখ্যালঘু চৈনিক, ভিয়েতনামি, মুসলমান ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমূলে নিধন। নৃতাত্ত্বিক বিভেদ এবং সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগত বিভেদ থেকে সৃষ্ট ঘৃণা এর একটি কারণ। পলপটের স্বপ্নরাজ্য গড়া ছিল আরেকটি কারণ । তাই মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ নির্মূল করে দেয়া কম্বডিয়ার শাসক গোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্র একটি প্রয়াসই হয়তোবা ছিল।
 

 

 

প্রেক্ষাপট রাওয়ান্ডা। ১৯৯৪ সাল। ৮ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশুদের হত্যা করা হয় প্রায় ১০০ দিনের মাঝে।

চিত্রে হত্যাযজ্ঞ থেকে মাত্র বেঁচে যাওয়া রাওয়ান্ডার শিশু।

 

 

 

সার্বেনিয়ায় ১৯৯৫ সালের গণহত্যায় নিহতদের একটি ২০ ফুট গভীর, ১০০ ফুট চওড়া গণকবর। ফরেনসিক বিভাগের চিকিতসক দ্বারা খননকৃত এই কবরে ৮৩৭২ জন শিশু পুরুষ ও প্রৌঢ়দের স্তুপকৃত মরদেহ ।

ছবিঃ Gilles Peress ( The Graves: Srebrenica and Vukovar [Scalo Books, 1998])

 

 

 

চিত্রে কম্বোডিয়ায় খেমারুজ বাহিনী কর্তৃক গণহত্যায় নিহতদের করোটি।

 

 

গণহত্যা সংগঠকদের আরেকটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণে ততপর দেখা যায়। যেমন কোন এলাকায় বা দেশে বা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অন্যায় ভাবে সামরিক ততপরতা বা সামরিক অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে ভ্রান্ত প্রচারাভিযান পরিচালনা করা বা প্রোপাগান্ডা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজী বাহিনী বার্লিনে সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবেল তার কূটকৌশলে সফলতা অর্জন করেছিল। প্রোপাগান্ডায় সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেমন তিক্ততা সৃষ্টি করে তেমনি একই সাথে যুদ্ধ সংগঠিত করার আদর্শকে মহিমান্বিত করার উদ্যোগ স্থাপন করার লক্ষ্যে সফলতা অর্জন করে। রাওয়ান্ডা জেনোসাইডে প্রোপাগান্ডার একটি অংশ ছিল  টেন কমান্ডমেন্ড, যেখানে ঐশী বাণীর মতো নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিল দশটি নির্দেশ।

 

চিত্রে গণহত্যা রাওয়ান্ডা

 

 

রিফউজি ক্যাম্প কিবুম্বায় সদ্য আগত একটি পরিবার। আলোকচিত্র শিল্পী Jose Diogo-র ক্যামেরায় রাওয়ান্ডার গণহত্যার চিত্র

 

 

১৯৭১ এ বাংলার মাটিতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের মানুষ। স্থান ভারতের বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগনা।

ছবি আব্দুল হামিদ রায়হান, Autograph  ABP

 

 

রাওয়ান্ডার হুটু ও টুটসি জাতি দুটির মাঝে প্রকট বৈষম্য তৈরির লক্ষ্যে এই নির্দেশগুলো তৈরি করা হয়েছিল যেন অনায়াসে হুটুরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে টুটসিদের ওপর। নাতসী বাহিনী প্রোপাগান্ডায় যে মন্ত্র সরবরাহ করতো তাতে বলা হতো, ইহুদীরা শুধু ইতর বিশেষই নয়, তারা জার্মান জাতির জন্য ভয়ংকর শত্রুও বটে। হিটলারের কনসেনট্রেসান ক্যাম্প আর কিলিং সেন্টারের বন্দীদের বাস্তবে মৃত্যুবরণ সন্নিকটস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়িতে বাড়িতে পোস্টকার্ড প্রেরণের মাধ্যমে জানানো হতো তারা ওখানে বহাল তবিয়তে আছে।

 

বাংলার মাটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানী সরকারের পরিচালিত রাজাকার আলবদর বাহিনীকে গ্রহণযোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডার মাত্রা ছিল ভয়াবহ, যা অসম্ভব রকমের চাতুরী, প্রতারণা, ভন্ডামী ও ধোঁকাবাজীর আরো একটি আদর্শ নিদর্শন। প্রোপাগান্ডায় বলা হতো, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পুনর্বহাল করতে ও শান্তি কায়েমের উদ্দেশ্যে কমিটি গঠণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার নাম শান্তি কমিটি। মহল্লায় মহল্লায় আহ্বান জানানো হয়েছিল শান্তি কমিটিতে যোগদানের। প্রোপাগান্ডায় আরো বলা হতো, শান্তি কমিটির কার্যক্রম এগিয়ে চলছে সাধারণ মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস আর আস্থাকে সম্বল করে। শুধুমাত্র কিছু অশান্তিকামী মানুষ সমস্যা সৃষ্টি করছে। কিন্তু সাধারণ বাঙ্গালী জনতা, মিত্রশক্তি ভারতের দুষ্ট চক্রান্ত উপলব্ধিতে সক্ষম হয়েছে এবং তা প্রতিহত করছে। দেশের সংহতি এবং একতা রক্ষার্থে দেশের জনগণ বদ্ধপরিকর। তারা রাজাকার আলবদরের সাথে কাজকে সমর্থন প্রদান করেছে। রাজাকার আলবদর গোষ্ঠী পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানের আলোকেও প্রোপাগান্ডার মন্ত্র তৈরী করত সুচতুর ভাবে। নবীজীর জীবনাদর্শন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে সঠিক পথ চলার নির্দেশ দেয়ারও সাবধান বাণী প্রচার করতো। তারা বলতো, ধর্মকে নষ্ট করে ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে যারা, তারা মুনাফেক ছাড়া আর কিছুই নয়। ঐ পথে চললে একটি জাতি (বাঙ্গালী জাতি) সামগ্রিক ভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই আর গুজবে বিশ্বাস নয়। রাজাকার আলবদরের দোসর হওয়াই উতকৃষ্ট পন্থা।


দেশে বিদেশে মিডিয়ার মাধ্যমে এসব প্রোপাগান্ডা জোরেশোরে চালানো হতো। কিন্তু এর ফলাফল যে বেশীদিন স্থায়ী হয়না তার শিক্ষা অতীত ইতিহাস থেকে যেমন কেউ গ্রহণ করেনা, ক্ষমতার লিপ্সায় সাময়িক সময়ের জন্য হলেও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী অন্ধ হয়ে উন্মত্ত আচরণ প্রদর্শন করতেও তাই পিছপা হয়না। তার কল্পরাজ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় গণহত্যা চালানো যেন কম্পিউটার গেইম খেলার মতনই আনন্দদায়ক হয়ে উঠে।
যুদ্ধে সংখ্যলঘুদের লক্ষ্য করে অত্যাচার করা হয় সবসময়। কিন্তু বাংলার মাটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠরাও পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছে একযোগে। মুসলমান ভ্রাতৃত্ববোধকে কাজে লাগিয়েই এ হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা হয়েছে অসম্ভব দক্ষতার সাথে। জাতির মেরুদন্ডকে দ্বিখন্ডিত করতে নিধন করেছে  বুদ্ধিজীবীদের, ইতস্ততভাবে যেখানে যেভাবে পেয়েছে সেভাবে নয় বরং তালিকা করে সুপরিকল্পিত ভাবে এবং নির্মম ভাবে চরম নৃশংসতার সাথে এ কাজটি তারা সাধন করেছে। আর তাই ৭১ এর গণহত্যা নজিরবিহীন।

 

 

 

 ঐতিহাসিক একটি চিত্র, রায়েরবাজার বধ্যভূমি। বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে, পেছনে হাত বেঁধে হত্যা করার পর।

 


‘আমাদের পাশের গ্রাম ছিল রসুলপুর। এ গ্রামের অধিকাংশ লোক হিন্দু। ঐ অঞ্চলে এই গ্রামটি ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল অতিশয় বিদ্বান। বিখ্যাত র‍্যাংলার কিরণ রায় এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নানা বিদ্যায় পারদর্শী অনেকে ভারতে উচ্চপদে আসীন। এই গ্রামের ভিতর দিয়ে চলার সময় মনে হত একটি সাজানো, গোছানো, আদর্শ বসতি। পরিষ্কার ছিমছাম বাড়িঘর, নিকানো উঠান, ফুলের বাগান, ফলের গাছ, শান বাধানো পুকুর ঘাট-সব যেন ছবির মত। ভারত বিভক্তির পর অনেক হিন্দু ভারতে চলে যান। ফলে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পায়। যারা ছিলেন তাদের একজনের নাম ছিল নিশিকান্ত। অবস্থাপন্ন ব্যক্তি, মান্যগণ্যও বটে। পাঞ্জাবী মিলিটারিদের ক্রোধ হিন্দুদের উপর খুব বেশী ছিল। একদিন গভীর রাত্রে তারা রসুলপুরে হানা দেয়। রাস্তা চলতে চলতে তারা দু’ধারে জনপদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এলোপাথারি গুলি চালায়। পরে এসে পৌঁছায় নিশিকান্তের বাড়িতে। বাড়ির মালিক নিশিকান্তকে ওরা ধরে ফেলে। নিশিকান্তের শোবার ঘরের বড় খুঁটিতে তাকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। বাড়ির আরও ছয়জন ধরা পড়ে। তারপর বাড়িতে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিরাট বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। নিশিবাবুদের আর্ত চিৎকারে জেগে উঠে গ্রামবাসী। তাদের সম্মিলিত চিৎকারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জেগে উঠে আমাদের গ্রামের মানুষেরা। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় বিশাল অগ্নিকুন্ডের গগনচুম্বি লেলিহান শিখা। আগুনের প্রচন্ড তাপে আটচালা টিনের ঘরের চালের টিনগুলো ঠাস ঠাস বিকট শব্দে ছুটে যেতে থাকে। ভয়ে আবাল বৃদ্ধ বণিতা থর থর করে কাঁপতে থাকে। নিশিকান্তের আওয়াজ স্তব্ধ হয় চিরতরে।

যুদ্ধ জয়লাভের মিথ্যা প্রচারণা পাকিস্তানীরা তাদের নিজেদের দেশেও চালাতো দক্ষতার সাথে। প্রতিদিন খবরের কাগজে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বড় আকারে লেখা থাকতো ইংরেজী অক্ষর V (ভি) অর্থাৎ ভিকটরি-বিজয়। পাকিস্তানীদের ভাষায় আখেরী ফাতাহ্ হামারা হোগা। যার অর্থ হলো, শেষ বিজয় আমাদের হবে। সাধারণ নাগরিকরা মনে প্রাণে তাই বিশ্বাস করতো। তারা জানতো না এই V এর কোন সত্যতা নেই। পাকিস্তানীরা অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দূ গানের প্রোগ্রাম খুব পছন্দ করে। প্রায় সময় রেডিও চলে। কিন্তু যখন খবর প্রচারের সময় হয়, তখন তারা ঠাস করে রেডিও বন্ধ করে দেয়। উর্দূতে বলে, ইন্ডিয়ান খবর শুনে মনে হয় যেন, সত্যি কথা বলছে। কাফেররা মিথ্যা সংবাদকে কেমন সত্য সংবাদের মত পরিবেশন করে, ওরা বড় চতুর। খবর শুনলে মনে হয় বিশ্বাস করি! আসলে সব খবর মিথ্যা!
যেদিন বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হলো সেদিন সেদেশের সাংবাদিকগণ সত্য গোপন করেনি। তারা সত্য সংবাদ ছাপালো। এতদিন পর তারা পত্রিকায় বিরাট বড় হেড্ লাইন লিখলো, OUT ! একটি শিরোনাম, একটি লাইনে। এখনও সেই বিরাট OUT লেখাটি আমার চোখে ভাসে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাঠে পাকিস্তান আউট হয়েছে। এটি একটি বাস্তব ঘটনা যে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালীরা পাঞ্জাবী দৈত্য দানবের থাবা অবশ করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ বিক্রমের নিকট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হিংস্র উন্মত্ত তান্ডবলীলার অবসান ঘটেছে। অবশেষে এসেছে সেই দিন। আনন্দের দিন , বিজয়ের দিন ১৬ ই ডিসেম্বর, সেই ১৯৭১ সালেই।
কিন্তু এ সংবাদটি অবিশাস্য মনে হল পাকিস্তানী জনগণের কাছে। সেদিনে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো চারিদিক। গাছে গাছে পাতারা যেন ঝুলে পড়েছে, পাখীর কুজন গেছে থেমে। রোদ্র যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রকৃতি শুনশান। আকাশ, বাতাস, পৃথিবী সব দুঃখে মগ্ন। কোথাও কোন শব্দ নেই, কোলাহল নেই। মনে হয় ঘরে ঘরে মৃত্যু শোক। প্রত্যেকটি নাগরিক যে যেখানে ছিলো মাথা নীচু করে বসে পড়লো। তারা তাদের সরকারের হঠকারিতা উপলব্ধি করতে পারলো। তারা বুঝতে পারলো তাদের সরকার তাদেরকে এতদিন মিথ্যা কথা বলে প্রতারিত করেছে। তারা জানতে পারলো দেশের সরকার অন্যায় সমরে লিপ্ত ছিল। দেশী পত্র-পত্রিকা বা মাধ্যমগুলো এতদিন সত্য সংবাদই পরিবেশন করেছে। কিন্তু অন্ধ বধির তারা, সেসব সংবাদে কর্ণপাত করে নাই, বিশ্বাস স্থাপন তো দূরের কথা।’ [স্মৃতির দুয়ারে-ফিরোজা হারুন]


আজ স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পার হলো। এখন তো আর থেমে থাকা নয়। শুধু এগিয়ে চলা। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে দৃঢ়তার সাথে নিজ অবস্থান থেকে সোচ্চার হওয়া। যুদ্ধপরাধীদের উত্থান আর নয়। ওদের হটাতে হবে। ওদের ও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আমার সোনার বাংলাদেশ কেন চুপ করে থাকবে কেন পিছিয়ে থাকবে?
তাই এই বিজয়ের দিনে মাকসুদের কন্ঠে ফিডব্যাকের সেই গানটি (লিংক এখানে) খুব মনে হচ্ছেঃ


পৃথিবী চলছে তীব্র গতিতে
আমার বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকে
তথাকথিত কিছু আঁতেলের দল
ভঙ্গ করছে আমার ঐ মনোবল
তারা যে জন্মেছে এই যুগে...
আমার অহংকার আমি গান গাই এই যুগে

আমি জন্মেছি এই যুগে।

 

 

 


 

হুমায়রা হারুন

১৬ ই ডিসেম্বর ২০১০

কৃতজ্ঞতাঃ কন্ঠশিল্পী মাকসুদ, অ্যালবাম-মেলা, ব্যান্ড-ফিডব্যাক

ছবিঃ ইন্টারনেট

 

 

ফটোগ্রাফিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন কিশোর পারেখ

হাসান বিপুল,কাঊসার রুশো



১৯৭১ সালের কথা মনে হলেই আমাদের সামনে যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে এই ছবিগুলো ভেসে ওঠে। এই ফটোগ্রাফগুলোই আমাদের সাহায্য করে যখন পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা বলতে চাই আমাদের সেই বিশাল অর্জনের কথা, ভয়াবহ সেই দিন কিংবা রাতের কথা।
ফটোগ্রাফ ১


১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
লেফটেনান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী হেটে যাচ্ছেন। তার ডান পাশে আরেক লেফটেনান্ট জেনারেল। তিনি জগজিৎ সিং অরোরা। নিয়াজীর বাম পাশে মেজর হায়দার। পেছনে মুক্তি। সে সময়ে পাকিস্তানিদের কাছে মুক্তিবাহিনীর সংক্ষিপ্ত নাম ছিল মুক্তি। এই মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের দেখা যায় অনুসরণ করছেন উল্লিখিত
নেতৃস্থানীয়দের। তারা সবাই হেঁটে যাচ্ছেন দলিলে সই করতে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক পরাজয়ের দলিলে সই করতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতি বছর আমরা দেখি এই ফটোগ্রাফ। দেশের প্রতিটি নিউজপেপার ১৬ ডিসেম্বর ছাপে এই ছবি। এর সঙ্গে আরো কিছু ছবি যোগ হয় ছাপার তালিকায়।

ফটোগ্রাফ ২


ঢাকার রাস্তা। জনশূন্য। রাস্তার পাশের দালানের সারি দেখে বোঝা যায় রাস্তাটি পুরনো ঢাকার। বন্দুক হাতে তিন গেরিলা এগিয়ে যাচ্ছেন। ছবিটা গেরিলাদের পেছন থেকে তোলা। যোদ্ধরা যাদের ধাওয়া করছে, তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেবল রাস্তার ওপর দেখা যায় পড়ে আছে একটি
আর্মি বুট। ওই একটি চিহ্নই বলে দেয় ধাওয়া করা হচ্ছে পাকিস্তান আর্মিকে।

ফটোগ্রাফ ৩


বহু দেখা ছবি এটি। এক পাক সোলজারের সামনে দাড়ানো লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এক বাঙালি। সোলজারের নির্দেশে লোকটি তার লুঙ্গির গিট আলগা করেছে। পাকিস্তানি সোলজার লুঙ্গির ভেতর তাকিয়ে দেখছে লোকটির সাবকামসেশন করা হয়েছে কি না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফটো ডকুমেন্টেশন যারা করেছেন তাদের অনেকের নামই আমরা জানি। রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আফতাব আহমেদের মতো অনেক ফটোগ্রাফারের নাম জানা যায়। বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ছিলেন ডন ম্যাককালিন, রেইমন্ড ডিপারডন, মার্ক রিবান্ড, ম্যারি অ্যালেন মার্ক, রঘু রাই (মুক্তিযুদ্ধের ছবি যাকে এনে দেয় ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পদক পদ্মশ্রী), মেরিলিন সিলভারস্টোন, কনটাক্ট প্রেসের ডেভিড বার্নেট, এপির সংবাদ সংস্থা এপির বাঘা ফটো এডিটর হর্স্ট ফাস যিনি মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেই জিতে নেন পুলিটজার প্রাইজ, ম্যাগনাম ফটোজ-এর ইরানিয়ান ফটোগ্রাফার আব্বাস এবং সে সময়ে ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত বিদেশি ফটোসাংবাদিক। বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে প্রায় সবাই এখানে ছিলেন অ্যাসাইনমেন্টে। ৭১ সালের পরিচিত ছবির
ফটোগ্রাফারদের মধ্যে সম্ভবত কিশোর পারেখ ছিলেন সেলফ অ্যাসাইন্ড। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, তিনি নিজেই চলে এসেছিলেন এ দেশে যুদ্ধের ডকুমেন্টেশন করবেন বলে।


কিশোরের জন্ম ১৯৩০ সালে। ভারতে । ১৯৫৬ সালে ২৬ বছরের কিশোর যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় ভর্তি হন তার প্রিয় বিষয় ফিল্মে। ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি ঝুঁকে পড়েন ফটোগ্রাফিতে। কিশোর লাইফ ম্যাগাজিন এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কনটেস্টে সাতটি ক্যাটেগরির মধ্যে ছয়টিতে পুরস্কার জিতে নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সর্বপ্রথম লাইম লাইটে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিশোর যখন ট্রাভেল এবং ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত, তখন একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসবেন। কারণ তার দেশ তখন জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধে। দ্রুত যোগাড় করেন ৪০ রোল ফিল্ম। প্রথমে আসেন ভারতে। এক বন্ধু তাকে পৌছে দেয় বর্ডারে। জোর করে তিনি ঢুকে পড়েন প্রেস হেলিকপ্টারে। তারিখটি ৮ই ডিসেম্বর। ১৬ তারিখ বিজয় অর্জন পর্যন্ত কিশোর ছিলেন বাংলায়।

কাজ শেষ করেই মুহূর্ত দেরি না করে তিনি ফিরে যান। টানা তিন দিন তিন রাত সময় দিয়ে ফিল্ম ডেভেলপ করেন। ল্যাব থেকে যখন তিনি বের হন, তার হাতে ছিল ৬৭টি সফল ফটোগ্রাফ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এতো কম সময়ে এতো সফল ফটোগ্রাফি আর কেউ করতে পারেননি সে সময়। সে ছবিগুলো অলম্বন করে পরে তিনি বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর কিশোর আবার ফিরে যান কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফির পেশায়। ১৯৮২ সালে ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কিশোর আর ফিরে আসেননি প্রেস ফটেগ্রাফিতে।
 

 

 

 

শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন : একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকের কথা
সাগর জামান
 

শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন সাংবাদিকতা জগতের অনন্য মহীরুহ। তিনি তাঁর খুরধার লেখনির মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর সব ধরণের শোষণ নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের কথা তুলে ধরার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। লেখালেখি দিয়ে চেতনা জাগানোর পাশাপাশি সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার কাজটি সিরাজুদ্দিন হোসেন নির্ভীকভাবে করেছেন। প্রতিটি অঞ্চলে অঞ্চল ভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলার আহবানসহ শাসক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া বিভিন্ন বাহিনীর ব্যর্থতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা স্থানে যুদ্ধে সফলতার কথা তিনি সর্বত্র পৌঁছে দিতেন। পাকিস্তানী শাসনের সব ধরণের নৈতিকতাহীন বীভৎসতা তিনি তুলে ধরতেন তাঁর লেখায়। তিনি সত্যনিষ্ঠ ও সত্যাদর্শে নিবেদিত থেকে মানুষের কল্যাণের জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন।


শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে মাগুরা জেলার শালিখা থানার শরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। টানা পোড়েনের সংসারে তিনি বড় হতে হতে মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। তার মা ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে তখন দিশেহারা। এ সময় তাঁর বড় চাচা মৌলভী মোহাম্মদ ইসহাক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। চাচা মোহাম্মদ ইসহাক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। চাচার কাছে থাকাকালে সিরাজুদ্দিন হোসনে নবাব বাহাদুর স্কুল, যশোর জেলা স্কুল প্রভৃতি স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে চাচার কাছ থেকে চলে এসে তিনি তার ভগ্নিপতির কাছে থাকেন। কিন্তু নানা অসুবিধায় সেখান থেকে কিছুদিনের মধ্যে চলে আসেন যশোরের ঝিকরগাছার মিছরিদিয়ারা গ্রামে এক বিধবার পরিবারে। ওখানেই জায়গীর থেকে তিনি ঝিকরগাছা স্কুলে পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং যশোর মাইকেল মধুসুধন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর সিরাজুদ্দিন হোসেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বিএ পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবনে তার বইপুস্তক কেনার মত অবস্থা না থাকার কারণে তিনি সবসময় সহপাঠীদের বই নিয়ে এবং অধ্যাপকদের বক্তৃতা নোট করে পড়া তৈরী করতেন। এভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া করে ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। এ সময় সিরাজুদ্দিন হোসেন দৈনিক আজাদে সাংবাদিকতা শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বার্তা সম্পাদক পদে উন্নীত হন। ১৯৫৪ সালে আজাদ থেকে বেরিয়ে ঢাকাস্থ ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসেবে কাজ পান। এক বছর পর তিনি ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। সিরাজুদ্দিন হোসেন দীর্ঘদিন ইত্তেফাক এর বার্তা সম্পাদক থাকার পর ১৯৭০ সালে নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর আগে ১৯৬৬ সালে আইয়ুবীয় দুঃশাসন আমলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে সিরাজুদ্দিন সংবাদ প্রতিষ্ঠান পিপিআই এর ব্যুরো চিফ নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে ইত্তেফাক পুনরায় প্রকাশিত হলে তিনি পিপিআই থেকে ইত্তেফাকে ফিরে আসেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুদ্দিন হোসেন ছিলেন হৈচৈ প্রিয় এবং বুদ্ধিদীপ্ত অমায়িক একজন মানুষ। খুব সহজেই মানুষের কাছে চলে যেতে পারতেন। তার লেখালেখির শুরু সংবাদ কেন্দ্রিক ছিলনা। অনুবাদ কর্ম ও গদ্য রচনায় সিরাজুদ্দিন হোসেনের অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল। অনুবাদ ছাড়াও ছোট থেকে বড়, মহীয়সী নারী, ইতিহাস কথা কও প্রভৃতি গ্রন্থের তিনি রচয়িতা। বাংলাদেশের পূর্ণ ইতিহাস রচনার জন্য সিরাজুদ্দিন হোসেন বহু নোট লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৭১ এর ১০ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর দোসর আল বদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর স্বজনরা ফিরে পাননি সিরাজুদ্দিন হোসেনকে। তিনি দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কলম ধরেছিলেন। তার সাহসী ভূমিকা ও আত্মত্যাগের কথা চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর কাছে জাতি অপরিসীম ঋণী।‘তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।’
 

 

 

বিজয় আমাদের প্রজন্মের গৌরব
সৈয়দ আফসার


না-কিছুই বলবো না। কথা বলার আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে গলা। ওই যে আমি দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছি সকলের হেঁটে যাওয়া, আলোছায়া। হেঁটে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু পথ আমাকে ছুঁতে পারেনি, ওই যে হেঁটে যাবাব পর আমি যা পেলাম সারি-সারি গাছের প্রেম, পাতাদের আসক্তি… চারপাশ নিয়ে উড়ছে যে বাতাস, গাছপালার শ্বাস তাকে কি আমরা ধরতে পেরেছি? আমাদের শত আর্তনাদ নীরব সাক্ষী। শুধু জেনেছি গাছের নিচে বসে গাছপাতার গান শুনলে নাকি কানের অসুখ সারে।যাবার রাস্তা ধরে কেউ যদি যেতে চায়, দেখতে চায়, জানার আগ্রহ দেখায় আর কতদূরে… আর কতটুকু গেলে দেখা পাবো ‘বাড়ি নাম্বার ৩২’ তাঁকে যাবার রাস্তা বাতলে দেবে সব পথিকের আগে…

জানি বাকি পথ হাঁটলে সেও মনে মনে এঁকে ফেলবে সবমায়াজাল, থাকবে না পা-হাঁটা পথের গ্লানি…। চারপাশে ‘সামাজিক দুঃখ আছে’ জেনে দীর্ঘশ্বাস টেনে সামলাচ্ছি গ্লানি… তোমরা কি বলতে পারো, আমার গ্লানিমুক্তির শব্দগুলো কোথায় বাজে? নীরবতার শৃঙখল পরে যেখানে আত্নচিন্তার ঘ্রাণ পাওয়া যায়, সেখানেই হায়ানের থাবা। আজো আমার মনের দরজা জানালা একা একা কষ্ট পায় গোপনে। সকলেই চায়, নিজের মতো হউক সুখের নগর।

পূর্বসূরীদের বলা-কওয়ার ব্যবধান যেন মৃত আত্নার গান। দীর্ঘশ্বাস বিগত দিনের মতো উড়ে যাচ্ছে না, ছায়া হয়ে নিজের সাথে মিশে আছে আত্নগরিমায়। অনুতাপ পরিতাপের ভাষা জপে আস্থায় ছানিপরা চোখে। তখন যদি জন্ম হত আমার, আমি কি লিখতে পারতাম সময়ের যত ভয়, যত অশুভ ব্যবধান? আবার যখন টেনে নেই শ্বাস, সব শ্বাসেরই থাকে আলাদা আলাদা মুগ্ধসঞ্চারণ, লেগে যায় আঘাত।

ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস।ডিসেম্বর এলেই গর্বে ভরে ওঠে মন, ঠোটের ফাঁকে ফাঁকে জমে জমানো উচ্ছ্বাস। এইমাসেই চলে আসে মৃদুশীতের আমেজ দুর্বাঘাসে ফুটে হালকা জলফল, হাট বাজারে মিশে থাকে শীতসবজির ঘ্রাণ। সেসবই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে ভাবায়। গাছ-লতাপাতা, নদী-জল-ডোবা সবই এক, তবু মানুষের মাঝে এতো ব্যবধান… একই আবহাওয়া থেকে মানুষ, একই পৃথিবীর অক্সিজেন গ্রহণ করে, তবু মানুষই মানুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। বাঙালির এই মাস ব্যবধান ভাঙার মাস, বিজয়ের মাস। এই দিন যে আনন্দ নিতে জানে না কবির ভাষায় সে আজন্ম কৃতদাস থেকে যায়। সমস্ত শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাঁরা এই দিনটি আমাদের
সামনে হাজির করেছিলেন, তাঁরাই মহীয়ান হয়ে উঠেছেন। আমাদের অহঙ্কার হয়ে উঠেছেন। আর অনেক কিছু না-পাবার বেদনা তো আমাদের আছেই।

সেসব গোপনকথা, দাহকথা, প্রেম-প্রকৃতি-কথা কেউ লিখেন কবিতায়, কেউ গানে গানে বলে যায় মনের হাজারো অস্ফূটকথা, আর যে জন জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন খেটে খাওয়া মানুষের কবিতা, কাজ থেকে ছাঁটাই করা মানুষের কবিতা, আত্নবোধের কবিতা, বাঙালি জাতির ভেদাভেদের কবিতা, বাঙালি জাতির মুক্তির কবিতা, সুষমা-সমতার কবিতা…‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷’ তিনিইতো হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি। যার আহবানে সাড়া দিয়ে পুরো বাঙালি জাতি তাঁর ধর্ম-বর্ণ-বৈষম্য ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ছিল! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য মরণপণ লড়াই করেছেন, শহীদ হয়েছেন, যে মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন তারাতো সেই কবিতাটিরই অংশ। সে সব ভাবলেই মনভরে উঠে।

ফিরতে চাই গর্বে তিনক্রোশ হেঁটে দূরপাহাড়ের চূড়ায় তুলে রাখি বিজয়ের সুখ, মুঠো ভরে তুলে আনি ধুলো; নাক বরাবর রেখে অনুভব করি প্রতিটি কণা যেন ডাকছে... বলছে গায়ে মেখে দেখ কি অনুভূতি জাগে তোর প্রতিটি শিরায়। জানিস্ আমি উড়তে পারি, আমি পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে পারি; ‘আমি রোদে পুড়ি বৃষ্টিতে ভিজি’ যখন তোদের স্পর্শ আমার গায় ছুঁয়ে যায়; আমার ভালো লাগে খুব যেন ‘ফুরফুরে থাকে মেজাজ শরীফ’ আমার শরীরে বাঁধা সব প্রাণির সহজজীবন। আমার শরীর ছিঁড়ে-খুঁড়ে উৎপাদন হয় তোদের বেঁচে থাকার সকল আয়োজন। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে এমনই কথা কয় জন্ম-ভূমি, আমাদের কানে কানে

সব আশ্চর্য কথা আমার কানে বাজে; কাঁচামাটির ঘ্রাণে কোন অস্পষ্টতা নেই, আছে সুখ আর সুখ। না-বলা যত কথা যেন অগ্নিবীণা থেকে হয়ে যায় বিনীত আরজ। জন্মের পর যা কেটে দিলেই বাঁচি, দাদীমাই এই মাটিতে পুঁতে রেখেছেন আমার নাড়ি, এই মাটিতেই একদিন হবে চিরস্থায়ী আবাস। তখনই ভূপেন হাজারিকার একটি গান কথা আমাকে আলোড়িত করে, ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গেয়ে যাই গান— ‘মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি(আমি) মানুষ পেতে পারে না...।’

মানুষ আছে, থাকবে, প্রকৃতি যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই। আমার মরে যায় প্রকৃতির নিয়ম মেনে, মরার সাধ হয় না কারোই; তবুও সে স্বাদ নিতে হবে সবার। পালানোর যে কোন পথ খোলা নেই। কিন্তু সব মৃত্যু যে মেনে নিতে পারে না সবাই। কোন মৃত্যু একটি জাতির ললাটে কলঙ্কের দাগ লেগে যায়। যে কবি অমর কবিতার মন্ত্রে বাঙালি জাতি পেল তাঁর বাক্ স্বাধীনতা, ভূখণ্ড, লালসবুজ পতাকা, পেল শহীদের রক্তে ভেজা বিজয়ের মালা। দীর্ঘ ৩৪বছর অপেক্ষার পর জাতির জনকের বিচার পেল জাতি। তাই এবাবের বিজয় দিবস আমাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিজয়। আজ এই বিজয়ের মাসে আরো একটি বিজয় আমাদের অর্জন করার প্রতীজ্ঞা করতে হবে; যারা আমাদের বাকশক্তি কেড়ে নিতে চেয়েছিল, পতাকা কেড়ে নিতে সাহায্য করেছিল, যারা আমাদের পরাধীন রাখতে চেয়েছিল, বুদ্ধিজীবি হত্যায় সাহায্য করেছিল, সেই সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলার মাটিতে যে দিন শেষ হবে; সেদিন বাঙালি জাতি পাবে তাঁর পূর্ণ বিজয়। আমরাও পাবো পুরো বিজয়ের স্বাদ। তখনই এ বিজয় হবে আমাদের পূর্ণ গৌরবের বিজয়।
 

 

প্রবন্ধ

 

যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ

 

আর্কাইভ

 

 

 

 

Best view with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf