নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি।

 

সম্পাদক

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

পাঠক পরিষদঃ শুভলগ্না শোয়ারা, চঞ্চল চৌধুরী

কৃতজ্ঞতাঃ সুর মূর্চ্ছনায় সঙ্গীতা শঙ্কর, উস্তাদ জাকির হুসেইন (রাগ বাগেশ্রী)

 

 - এবারের প্রকাশনা -

শারদীয় রূপ

 

*

 

শরতের আমন্ত্রণে মন ছুটে যায় কোন খানে...


গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ আর বর্ষার বৃষ্টির পর এ ঋতু জনজীবনে বয়ে আনে শান্তি ও স্বস্তির বারতা। আর তাই তো এ ঋতুকে ঘিরে রচিত হয় গান-কবিতা। তাই এ ঋতু বরণে গান, কবিতা আর ছন্দের চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। অগাস্টের

শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শরতের অকৃত্রিম রূপ কেমন যেন মনকে দোলা দিয়ে যায়।

আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।
হাওয়ায় কাশফুলের দুলুনি।

‘শরৎকালের মেঘ সাদারে, বন্ধু ওইনা সাদা কাশের বন, আকাশে জোড়া বইগলেরে, মন কয় বন্ধু আমার আছে কাছে’- ভাওয়াইয়া গানের এ কথার মতই স্নিগ্ধ শরৎকাল। ঋতুর মধ্যে যে শরত আমাদের মনের গহীনে খেলা

করে অবিরত তার জন্য অভিবাদন হয় না কেন তেমন।

 বৈশাখ প্রথম বলে কি তার জন্য এতো আয়োজন। পরের বলেই কি শরত, হেমন্ত পরের !!
যান্ত্রিক নগর জীবনে সব কেন যেন ভুলতে বসেছি। গ্রামের সেই মাঠ  সেই দিগন্ত জুড়ে কাশফুলের

ছন্দের বারতা..বারবার ছুঁতে ইচ্ছে করছে খুব।

 

জসিম

 

*

 

আমার শহরে শরত নেই
 

শামস শামীম

শহরে শরত না পেয়ে ছুটছিলাম গ্রামের দিকে। সুনামগঞ্জের সীমান্তনদী 'চলতি' ধরে লঞ্চকোষায় ছুটছিলাম শরতের খুঁজে। তারপর গ্রামের মেঠোপথ ধরে, সবুজ কচি ধান গাছের ঢেউ দেখে তম্ময় হয়ে দেখছিলাম মেঘালয় পাহাড়, মেঘনীল নোয়া দিগন্ত। পাহাড়ছোঁয়া কুচিকুচি মেঘের ওড়াওড়ি, আহ কি দারণ...


বিশ্বম্ভরপুরের পলাশ গ্রামে থমকে দাঁড়ালাম। মেঘরঙ্গা শরত আমাকে ডাকছে। হাওয়ায় কাঁপন তুলে উড়ছে যেন এলোচুলের কিশোরী। ক্যামেরার চোখে দেখার আগে নিজের চোখে ভালো করে দেখে নিলাম শরতকে। একগোছা নিয়ে এলাম শুভেচ্ছা জানাবো কাউকে। কে নেবে এমন সুন্দর আড়াফুল। কেউকি গাঁথবে চুলের খোঁপায় এমন নির্মল?


দোকানের রজনী গন্ধা, লাল গোলাপ বা অন্যান্য দামি ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর রেওয়াজ এখন আমাদের সমাজে চালু। তাই অবহেলায় গ্রামের জঙ্গলে, নদী ও পুকুরপাড়ে পড়ে থাকে স্নিগ্ধ শরতের কাশফুল। গ্রামের শিশু কিশোর-কিশোরীর মন ছুঁয়ে দেয় শরত, দখনে হাওয়ার তালে তালে কাঁপন তুলে স্বাগত জানায় তাদের। আর্টিস্ট সুলতানের সাহসী কিষাণ কন্যারাও আবেগে উতলে ওঠে শরতের নীলনোয়া কাশবন দেখে।
শরত নিয়েছে বিদায় শহর থেকে? হে তিলোত্তমা...হে কংক্রিট শহর তুমি কি একখন্ড উর্বর ভূমিও আর অবশিষ্ট রাখনি একগোছা কাশবন জন্ম দিতে? আমি কাকে দেবো মেঘশাদা একগোছা শরত? কার গহীন চুলের খোঁপায় গুজে দেবো এমন সুন্দর...
 

আমি মেঘের ভেলায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডুবে যাই কাশবনের গহীনে। আমি এবার ঘুমুতে চাই কাশ ও নলখাগড়ার বনের ধারে। বাশপাতার ভারিক্কী সংগীতের তালে নিতে চাই নিশ্বাস নিমিষে...
আমার শহরে শরত নেই।

আবার এসো শরত নীলনোয়া বনের ধারে।
 

*

 কবিতা

 

 

টুইস্টেড লাইফ

 

আমিন-জাভেদ

এই শরতে চোরাকাটা নয়,কাশফুল হবো
তোমার চলার পথে ।
স্নিগ্ধ ভোরে পাখি হবো,জানালার গ্রিল ধরে চেয়ে থেকো
দেখবে, শ্যামা হয়ে বসে আছি তোমার বাড়ির লনে ।

সবুজ ছায়া হয়ে ক্লান্তি জুড়াবো ভালবাসার নীল জলে,
অহরনিশ ভালবাসার সুখ দিতে চাই,নেবে?

হেমন্তে চলো আমার বাড়ির নদীর ধারে,
উপচে গেছে পলির জোয়ার,
এক চিলতে রোদের ছায়ায় দূর হবে সব আঁধার ।

কতো যে ভালোবাসি শুনাবো তোমায় প্রতি সায়াহ্নে,
শিউলি ঝরা ফাগুনের রাত অম্লান রবে,
তোমার পায়ের চিহ্নে ।

বসন্তের সকালে,হেটে যাবো অন্য কোথাও মেঠো পথ ধরে
অনুভবে শুধুই তুমি,নেমে এসো বদ্ধ ঘরের লকার ভেঙ্গে।

বিষাদের নিশাদ সুরে বৃষ্টি হলে আসবে কি আমার কাছে?
এই দেখো অঝোর ধারায় শ্রাবণ বইছে আমার মনে।
দুঃখকে বলে দিব মিশে যেতে মোহনায়,
পরশে মিছে হবে অভিমান সব জড়তায়।

হবে কি সফেন সমুদ্র ঢেউ আমার?
নাকি দুর্বোধ্য উপমা কবিতার ?
যদি আসো হিমেল হাওয়ায় টানে,
নিঃশ্চুপ নীরবতায়,হয়ে যাবে আমার একান্তে সান্নিধ্যে।
যদি বলো,ডুবে যেতে হবে অগ্নি লাভায়,
বুঝে নিব আমি, ভালবাসা ছিল স্রেফ উপমায়।

শুধু একটিবার ছুঁয়ে যাও,
ধূপছায়া হয়ে জ্বলছি তোমারই প্রতীক্ষায়, সীমাহীন ভালোবাসায় ।
 

 

*

 

শরতের আকাশে
 

ফিরোজা হারুন

 

শরতের আকাশে,
ডানা মেলে বাতাসে
গাঙচিল উড়ে যায়, সুদূরের পাহাড়ে।
ছন্দ যে জানা নেই,
তাল লয় জ্ঞান নেই
একটানে ভেসে যায় , কি দারুণ আহা-রে!
পেটের তার ক্ষুধা নেই,
মনে তার দুখ নেই,
তবু যদি ছানা দেখে, মাঠ ঘাট পাথারে।
বুলেটের গতিতে,
নেমে আসে ত্বরিতে
থাবা মেলে ধরে ফেলে, পুরিবারে জঠরে।
গতি তার থেমে যায়,
মগডালে ঠাঁই পায়
পাখা দুটি ভাঁজ করে, বসে যায় আহারে।
সুনীল গগন তাকে,
হাতছানি দিয়ে ডাকে,
ডানা মেলে ভেসে চলে, নভোঃ দেশ বিহারে।

 

*

 

 

 

কথিকা

আমার শারদ-শৈশব
 

শারদ মানে যে শরৎ, এ কথা বুঝতে আমার অনেক দিন চলে যায়। আমি ভাবতাম শারদ বোধয় দুর্গাপূজা সংশ্লিষ্ট কোন শব্দ। ছেলেবেলায় দেখতাম দুর্গাপূজাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলতো সবাই, তাই মনে মনে আমি এরকমই ধারনা করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে এ কথাটার মানে আমার কাছে দুর্বোধ্যই ঠেকতো- গানটা ভালো লাগতো, কিন্তু এই শারদপ্রাতে এসে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। শারদপ্রাত মানে কী ঠিক বুঝতে পারতাম না। ফলে আশৈশব শারদ শব্দটিকে নিয়ে ভুল এবঙ বিভ্রান্তিতেই কাটিয়েছি আমি।

তখনো জানতাম না শারদ মানে শরৎ; কিন্তু শারদের দুর্গাপূজা- শরদীয় উৎসব, কাশফুল, গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ, আদিগন্তু মাঠ, টলটলে জল, দুপুরে খালের স্রোতে উদ্দাম সাঁতার এ সব মিলিয়ে শারদ কিম্বা শরৎ আমার কাছে এক আনন্দের। বর্ষার বৃষ্টি-কাদার স্যাতস্যাতে বিমর্ষতা কিম্বা চৈত্র-বোশাখের তীব্র খরা অথবা মাঘের দুর্বোধ্য শীতের চেয়ে নাতিশীতোষ্ণ শরৎ আমার ভালো লাগতো।

আমার শৈশবের প্রথম অংশ কেটেছে গ্রামে-মাঠে-ঢেউয়ে। এখনো স্মৃতি খুঁড়লে দেখি আমাদের নিস্তরঙ্গ গ্রামে শরৎই একমাত্র প্রানোচ্ছ্বল হাসির ঋতু। আমাদের বাড়ির পেছনেই ছিলো ক্ষেত, তার সাথে একটা শশ্মান, সেখানে শরতে অসংখ্য কাশফুল ফুটতো। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না এগুলো শারদীয় বাংলার বিখ্যাত কাশ ফুল। আমরা এগুলোকে ভূতের ফুল হিসাবেই জানতাম। কে কবে আমাদের এ কথা বলেছিল আজ মনে নেই। কিন্তু আমাদের শিশু মস্তিষ্কে  বিশ্বাস দৃঢ় ছিলো যে, এ ঝোপগুলোতে ভূতেরা থাকে। ফলে শৈশবে আমরা এই শাদা শাদা ফুলগুচ্ছের দিকে কখনো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি এরকম মনে পড়ে না। বরং যেখানেই এ ভূতের ফুলের ঝোপ দেখতাম ভয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচা থেকে পালাতো- তখন রাম নাম নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন গতি থাকতো না।

তখনো আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি- বাজারে অবশ্য ছিলো। কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে তখনো পল্লী বিদ্যুতের কাঠের পিলারের আশীর্বাদ এসে পৌঁছায়নি। ফলে ভূতপ্রেত তখনো আমাদের গ্রামে বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে ঘোষিত হয়নি। রাতে হারিকেনের আলোয় যখন আমরা পড়তে বসতাম, শারদীয় বাতাসে গাছ থেকে শুকনো ডাল খসে আমাদের টিনের চালে পড়লেই আমরা নিশ্চিত হতাম এটা ভূতেরই কাজ। কারণ আজকেই আমরা শশ্মানের বাগান থেকে জলপাই আর হরিতকি চুরি করেছিলাম। ভূতেরা ক্ষুব্ধ হয়ে এখন ঢিল মারছে আমাদের। আমরা হারিকেনের আলোর আরো ঘনিষ্ঠ হতাম এ বিশ্বাসে যে, ভূত প্রেত আগুন ভয় পায়।

 

আবার বাঙলার প্রখ্যাত শারদ-শশী যখন শুক্লপক্ষের রাতে প্রকট হতেন তখন বাড়ির পেছনে বাতাসে দোদুল্যমান কাশগুচ্ছ কিম্বা তৎকালিন ভূতের ফুলকে আমাদের মনে হতো নৃত্যরত ভূতদল- কারো ঘাড় মাটকাতে পারলে ভূতেরা নাকি রাতে এরকম উল্লাসনৃত্যে মত্ত হতো। ফলে নিজেদের ঘাড় নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যেতো। মনে মনে আমরা প্রতিজ্ঞা করতাম, জলপাই-হরিতকি পাখিতে খেয়ে ফেলুক, পেয়ারাগুলো পেকে টসটসে হয়ে পচে পড়ে থাকুক গাছের নিচে, আমরা আর ঐ মুখো হবো না।
 

প্রণব আচার্য্য
 

*

 

শারদীয় দুর্গা উতসবে

বিশেষ রচনা

 

দুগ্গা দুগ্গা


সচরাচর কোন কাজ সমাপ্ত হলে কিম্বা কোন সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেলে আমার বাপ-কাকাদের দেখতাম বেশ স্বস্তির সাথে বলে উঠতেন- দুগ্গা দুগ্গা। অর্থাৎ যাক বাবা পার পেয়ে গেলাম; এখনো দেখি আমার ঠাকুরমা ঘর থেকে বের হওয়ার আগে দুয়ারে কাছে এসে হাত জোড় করে প্রার্থনা করেন দুগ্গা দুগ্গা বলে- যেন তাঁর যাত্রাটি নির্বিঘ্ন হয়। এই ভাবে মোটামুটি সমস্ত ধার্মিক হিন্দুদের যাবতীয় দুর্গতি থেকে মুক্তির জন্য বারে বারে বিভিন্ন সময় উচ্চারিত এই শব্দদ্বয় হচ্ছে: দুগ্গা দুগ্গা। মূলত শব্দ দুটি হবে দুর্গা দুর্গা। কিন্তু চলিত উচ্চারণে তা দুগ্গা রূপ লাভ করেছে। তাতে অবশ্য উচ্চারণ জনিত ত্রুটি ছাড়া আর কোন সমস্যা হয় না। হওয়ার কথাও নয়।

গত কয়েকদিন দুর্গতি নাশিনী এই দশভুজা স্বশরীরের এসে বিরাজ করেছেন তার ভক্তদের বিশ্বাসের চৌকাঠে। জননী রূপী এই দেবতাটি ঠিক একা আসেন না। সংস্কৃত ভাষায় বলতে গেলে শ্লোকটি এমন হয়, স্বপরিবারাঐ, সাঙ্গপাঙ্গাঐ, স্ববাহনাঐ... অর্থাৎ স্বপরিবারে, আসেন তিনি। আসেন সাঙ্গপাঙ্গ সহকারে। এবং নিজস্ব বাহনে। তার বাহনটি বেশ শৌর্যের প্রতীক; সেটি আমাদের বনরাজ সিংহ মহাশয়। সাথে দুই পুত্র যথাক্রমে গনেশ এবং স্বস্ত্রীক কার্তিক আর দুই কন্যা লক্ষ্মী ও স্বরস্বতী। এবং স্বামী কৈলাশপতি মহামহিম দেবাদিদেব খ্যাত মহাদেবও আসেন শ্বশুরবাড়ির মধুর আনন্দে। সাঙ্গপাঙ্গ হিসাবে আসে দেবীর পুত্রকন্যাদের নিজস্ব বাহন,কার্তিকের স্ত্রী; এমনকি মহিষাসুর নামে যে অসুরকে তিনি বধ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন,সেও বাদ পড়ে না। সাঙ্গপাঙ্গসমৃদ্ধ দেবীর মূর্তিতে কিম্বা প্রতিমায় ভরে উঠে তার ভক্তকুলের মন্ডপ। বিশেষ করে বাঙ্গালী হিন্দুদের সামর্থের উঠানে। যেহেতু দুর্গাপূজা মূলত বাঙ্গালী হিন্দুদের প্রধান উৎসব; অবাঙ্গালী হিন্দুদের নয়।

কথিত আছে, একদা রাম (সুশাসক হিসাবে মহাকবি বাল্মিকীর এ চরিত্রটির বেশ সুখ্যাতি রয়েছে) তার সুলক্ষণা স্ত্রীর অপহরণকারী রাবণকে পরাজিত করার জন্য দ্বারস্থ হন এই দুর্গতিনাশিনীর। আবাহন করেন দেবী দুর্গার। কিন্তু সেই সময়ে দুর্গার আবাহন করার হতো বসন্ত ঋতুতে। কিন্তু রাবণকে পরাজিত করার জন্য নিরুপায় রাম অকালে,অর্থাৎ শরতকালে দেবীর আরাধনা করতে বাধ্য হন এবং দেবীর কৃপা লাভ করেন। সেই থেকে বসন্ত কালের বদলে দেবীর পুজা শরতকালের অনুষ্ঠিত হয়। অকালে দেবীর এই শারদীয় আরাধনা হয় বিধায় এই আরাধনাকে অকালবোধনও বলা হয়। কিন্তু আজও কোথাও কোথাও বসন্তে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বসন্ত কালে হয় বিধায় সেটির নাম অবশ্য এখন বাসন্তী পূজা।

আমি যে অঞ্চলটায় থাকি সেটা আংশিক হিন্দু অধ্যুষিত বিধায় মহালয়া থেকে শারদীয় দশমী তিথি পর্যন্ত দুর্গা দেবীর আরাধনা চলে বেশ সাড়ম্বরেই। আমাদের বাড়ীর সামনেই হয় এই অঞ্চলের প্রধান পূজাটি। এছাড়া কাছাকাছি আরো দুইটি পূজা সংগঠিত হয়। তিনটি মন্ডপে শরতের প্রথমার্ধের ষষ্ঠী তিথি থেকে দশমী তিথির পূর্বাহ্ন পর্যন্ত চলে দেবীর আরাধনা। আয়োজনে এবং ব্যাপ্তিতে বৃহত্তর বলে এটি হিন্দুদের প্রধান পূজা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পাঁচ দিন বিভিন্ন আয়োজনে চলে দেবীর আরাধনা। পূজাটি ব্যক্তি উদ্যোগে না হয়ে সকলের আর্থিক অংশগ্রহনে সম্মিলিত ভাবেই মূলত অনুষ্ঠিত হয়। একে বলে বারোয়ারি আয়োজন। তবে যারা ঐতিহ্যগত ভাবে একটু ধনী তাদের কেউ কেউ পারিবারিক ভাবে এ পূজা করে থাকে।

প্রযুক্তির অভাবিত উৎকর্ষতার ছোঁয়া থেকে এই সব ধর্মীয় পূজা অর্চনাও ব্রাত্য নয়। মন্ডপের আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে দেবী প্রতিমাতে লেগেছে প্রযুক্তির ছাপ। প্রায় পাঁচদিনই প্রতিটি মন্ডপে জোরে গান বাজানো হয়। বাজানো হয় ধর্মীয় কাহিনী নির্ভর কথিকা, নাটিকা প্রভৃতি। এমনকি চিরায়ত ঢাকঢোলের বোল ছাপিয়ে বর্তমান সময়কার হাবিব মিলা মেটাল ব্যান্ডও বাদ যায় না।

হিন্দুদের একটি সাধারন প্রবণতা হচ্ছে ভারতপ্রীতি এবং অন্ধ ভারতীয় অনুকরণ। (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু,নাস্তিক হলেও যেহেতু আমি উঠে এসেছি হিন্দু কমিউনিটি থেকে, দুঃখজনক ভাবে হিন্দুদের এই প্রবণতা আমাকে ব্যথিত করে ভীষণ ভাবে। অথচ এদের শাস্ত্রেই বলা হয়েছে জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী সর্ব ক্ষেত্রে। ইন্ডিয়ার অন্ধ অনুকরনের ফলে মন্ডপে মন্ডপে দুর্গার আরাধনায় লাউড স্পিকারে বাজতে থাকে হিন্দি গান,হিন্দি ছবির অশ্লীল আইটেম গান সমুহ। আর বাংলা বলতে ভারতীয় উত্তেজক গান সমূহ। ভারতীয় বাংলা ছবির আইটেম গান।

যেহেতু ধর্মাচার কিম্বা ঈশ্বর চিন্তায় আমি নাস্তিক সেহেতু স্বভাবতই এই সব আয়োজনে আমি কিছুটা বিরক্ত বোধ করি। কিন্তু পাছে তাদের তথাকথিত সংবেদনশীল ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে তাই নিরবেই এইসব সহ্য করি। পাঁচ দিনের নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ দূষণে আমি ঘুমোতে পারিনা। সকলের মধ্যে অতিমাত্রায় ধর্মভাব প্রবল হওয়াতে,এমনিক সবচেয়ে লম্পট ছেলেটিও মাথায় সিঁদুর দিয়ে যখন আমাকে তিরস্কার করে নাস্তিকতার জন্য,করুনা বোধ করে এবং সিদ্ধান্ত দেয় আমার স্থান হবে সবচেয়ে ভয়াবহ রৌরব নরকে,ঘরে বাবার নিরন্তর চাপ,পাড়া প্রতিবেশীর বক্র দৃষ্টি,সব মিলিয়ে খুব সাইলেন্টলি অস্পৃশ্য ঘোষণা করে আমাকে একঘরে করার প্রবণতা আমার নাগরিক অধিকারকে ব্যহত করে। দুঃসহ করে আমার বেঁচে থাকাকে। আমি তারপরও কিছুই বলিনা। পাছে তাদের ধর্মানুভূতি নামক ঐ বিশেষ সংবেদনশীল অংশে আঘাত লাগে। আমাদের সরকার আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে না পারলেও, আমাদের যৌক্তিক অপরাপর চাহিদা সমূহ নিশ্চিত করতে না পারলেও,আমাদের মুক্তচিন্তাকে অবাধে প্রকাশ করার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও অন্ধকারাচ্ছন্ন ঐ বিশেষ সংবেদনশীল অনুভূতি রক্ষায় সদা সচেষ্ট। এবং এদেশে খুনের শাস্তি না হলেও,ধর্ষণের শাস্তি না হলেও,এমনকি এদেশের অস্তিত্বের বিরোধী সক্রিয় শক্তির শাস্তি বিধান না করতে পারলেও মুক্তচিন্তাকে ঐ বিশেষ অনুভূতির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে একে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে তার (যদিও মুক্তি চিন্তা কখনোই অপরাধ নয়) শাস্তি ঠিকই নিশ্চিত করে তড়িৎ বেগে। তাই আমিও নিশ্চুপ থাকি। আমার অধিকার আর কন্ঠস্বরকে রোধ করে প্রতি বছর পূজা শেষ হলে হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি। স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে আপন মনে বলি দুগ্গা দুগ্গা।

প্রণব আচার্য্য

 

*

গল্প

 

আমাদের পাহাড়ে শরৎ

সৈয়দ ইবনে রহমত


বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি নিয়ে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম। উঁচু-নিচু পাহাড়, ঝর্ণা, লেক আর খরস্রোতা নদীর মিলনে বড়ই মায়াময় এ অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এবং সমান্তরাল পাহাড়শ্রেণী বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এসব ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পরতে পরতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং, খুমী, পাংখো, লুসাই, রিয়াং, বম, উসুই, অসমীয়া এবং বাঙ্গালীদের বসবাস এঁকেছে বিচিত্র জীবনধারার মোহনীয় ছবি। তাই প্রকৃতি এবং নানা জাতির মানুষ মিলিয়ে অপূর্ব এই অরণ্যময় অঞ্চল।

এখানে জীবন ও প্রকৃতির রং বদলাতে ছয় ঋতুর আনা-গোনা চোখে পড়ার মত। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত সব ঋতুই আসে স্বকীয়তা নিয়ে, আসে বৈচিত্রময় রূপ-রস নিয়ে। এর মাঝে সবুজের ঢালি হাতে আসে শরৎ। শরতের আগমনে সবুজে সবুজে ঢেকে যায় সব পাহাড়। সবুজ চাদরে আবৃত হয়ে পূর্ণতা পায় পাহাড়ী পরিবেশ।

গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার অঝোর ধারায় জেগে উঠতে শুরু করে এখানকার প্রকৃতি। গাছে গাছে উঁকি দিতে থাকে নতুন কুঁড়িরা। কচি পাতা আর গুল্ম-লতাদের লাজুক চাহনি বয়ে আনে জীবনের জয়গান। বর্ষায় জেগে ওঠা এই কুঁড়িদের দেহে দিপ্তী আসে শরতের ছোঁয়ায়। ঢালে ঢালে শত-সহস্র সবুজ পাতার বন্ধন ছড়িয়ে যায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে। সবুজে সবুজে ঢেকে যায় সমস্ত পার্বত্যাঞ্চল।

বর্ষা পেরিয়ে এখানে শরৎ এলেও থামে না বৃষ্টির দাপট। বরং কোন কোন সময় বর্ষার মতই ভারি বর্ষণ চলতে থাকে দিনের পর দিন। তবে এসময় বেড়ে যায় মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি খেলা। সকাল-সন্ধ্যা, দিন কিংবা রাতে প্রকৃতির এ হেয়ালিপনায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। পাহাড় থেকে পাহাড়ে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়ায় সাদা মেঘের বেলা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত কালিদাসের মেঘদূতেরা ফুরামোন, তাজিং ডং, কেওক্রাডাং, চিম্বুক, নীলগিরি হয়ে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ীদের আঙিনা অবদি। চির চঞ্চল শিশুর মত শৈলপ্রপাত, সুভলং, রিচাং এবং আরো জানা-অজানা ঝর্ণাগুলো মনের আনন্দে নেচে যায় অবিরাম। বগাকাইন, রাইনখ্যং, মাতাই পুখিরী হ্রদের বুকে দিনে সূর্য আর রাতে চাঁদের আলো শরতেরআল্পনা এঁকে যায়।

শরতের আগমনে ফুলে-ফেঁপে ওঠে কাপ্তাই লেক। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জালের মত মেলে দেয় তার শাখা-প্রশাখা। কর্ণফুলী নদীর বুক ছাপিয়ে ছড়িয়ে যায় সারা মাইনী উপত্যকায়। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে মায়ালোকের সৃষ্টি করে লেকের স্বচ্ছ গভীর জলরাশি। আর লেকের এই জলরাশিকে ঘিরে বেড়ে যায় পাহাড়ী মানুষের ব্যস্ততা।

শরৎ শুধু এখানের প্রকৃতিতেই সুখের বীজ বুনে না, আনন্দের জোয়ার আনে মানুষের মনেও। কঠোর পরিশ্রম আর দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর জুমিয়ারা ঘরে তুলতে শুরু করে সোনালী ফসল। তাই ঘরে ঘরে খেলা করে নতুন ফসল আর নুয়া ভাতের আনন্দ। অন্যদিকে বৌদ্ধ সাধকেরা তিনমাস ব্যাপী বর্ষাযাপন শেষে বিহারে বিহারে ফানুস উড়িয়ে আয়োজন করে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব।

এখানে মানুষ,পাহাড় আর প্রকৃতি সব মিলিয়ে এক অবর্ণনীয় মহাকাব্যের সৃষ্টি করে শরৎ। আর একারণে, শরৎ এলেই পাহাড়ের দিকে ছুটতে থাকে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের স্রোত।
ছবিঃ  নীলগিরির চূড়ায় কালিদাসের মেঘদূত (এখানে)


 

 

*

 

বৃষ্টি নীল জল

~~ নীল স্বপ্ন ~~

 

 

লিলির ঘুম ভেঙ্গেছে অনেকক্ষণ হলো।  সে শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ সকাল থেকেই আকাশের মন ভার হয়ে আছে। সারা আকাশ কাল মেঘে ঢেকে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তার ঘুম ভাঙ্গার কিছুক্ষণ পর থেকেই। তার মন আকাশের সাথে সাথে রঙ পরিবর্তন করে।আকাশের রঙ নীল হলে তার মন অনেকটাই ভাল থাকে। সে অকারণেই সেদিন হাসে।যেদিন আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় সেদিন তার অনেক ইচ্ছে করে সবুজ কোন মাঠে হাঁটতে। সে শুনেছে ময়মনসিংহে নদীর পাড় জুড়ে অনেক সাদা কাশফুল ফুটে শরকালে। তার খুব ইচ্ছে করে সেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে।

আজ আকাশ জুড়ে মেঘ। তার  মনে হচ্ছে আকাশটা কাদঁছে। তারও কেন জানি কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে বিছানা থেকে উঠছে না, তার একটা কারণ আছে। সে অপেক্ষা করে আছে কখন তার আম্মু আসে। সে তার রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলেই চোখ বন্ধ করে ফেলবে। তার আম্মু এসে তার মুখের উপর হাত বুলিয়ে আদর করবে। সে সেই আদরের জন্য অপেক্ষা করে আছে.........

 

 

 

পৃথিবীলোক

 

(ধারাবাহিক উপন্যাস)

গাজী তানজিয়া

 

হিমান্তিকার আজকাল প্রায় সব সময় মনে হয়, গভীর একটা অন্ধকার কুয়ার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে। চারিদিকে অন্ধকার একটা ঘর। জানালা আছে, খোলাই থাকে, কিন্তু আলো প্রবেশ করে না। সারাক্ষণ মনে হয় যেন বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরেটাও অন্ধকারাচ্ছন্ন । ঘরে এবং ঘর থেকে তাকিয়ে বাইরে সব জায়গায় একটা দম বন্ধ করা অবস্থা তার এখন। ভীষণ অন্ধকার  চারিদিকে, কত কাল হলো আকাশ দেখেনি সে। নীল আকাশ কেমন হয়? ভুলে গেছে হিমান্তিকা। ঝকঝকে রোদ্দুর? তাও ভুলে গেছে। রাস্তা, লোকালয়, মানুষ ধীরে ধীরে সব ভুলতে বসেছে সে। হাসপাতালের এই বদ্ধ ঘরটাতে তার বাস।.......

 

*

গোরী- আমার ভালবাসার ঘাসফুল
সজল শর্মা


আমি রাজ ভরদ্বাজ। কুলীন ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের বীর্যে এক ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্মগ্রহন করে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। আর মনে হত পূর্ব জন্মের কৃত পূণ্যফলে সমাজের উঁচু শ্রেণীতে আমার জন্ম। আমার হাতেই সমাজের জ্ঞান শিক্ষার দায়িত্ব। আমার হাতেই সমাজকে আলো দেখানোর দায়িত্ব অর্পিত। কিন্তু আজ ভাবি তো মনে হয় কত কিছুতেই আমি অপারগ। আমি আমার নিজের স্বপনের মল্লিকা ফুটাতে অক্ষম। আমি আমার ঘাসফুলকে বুকের ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে অক্ষম। নিরলে-বিরলে যখন ভেবে যাই, এই অক্ষমতা আমাকে কুরে কুরে খেয়ে যায়। আর আমি শুভকামনা জানিয়ে যাই, আমার সেই ঘাসফুল কারও বুকের বাগিচায় গোলাপ হয়েই থাকুক।

গৌরীকে দেখে এসেছি সে যখন ছোট্টটি ছিল। আমি অবশ্য তাকে গোরী বলেই ডাকি। আমার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার শৈশব দেখেছি। তার কৈশোর দেখেছি। প্রাতের ফুটা কুসুমের মত কৈশোরের তার মুখখানি আমার হৃদয়ে কি জানি এক উদাস ভাব জাগিয়ে যেত। আমি মনে মনে ভাবতাম- স্রষ্টা আমার রূপের কারিগর। তার সেই টানা চোখ। চোখের চাহনি শরত প্রভাতের শিশিরের মত স্পর্শ দিয়ে যেত মনের গহীনে। আর গোরির সে হাসি! ভুবন ভুলানো মোহিনী সে হাসি। ঘর ভুলানো সুরের মত কলকল স্রোতের নির্ঝরিনী হয়ে যখন মিলিয়ে যেত। মনে হত এই হাসিতেই তো ঘর ভুলে থাকা যায় আরণ্যক জীবন নিয়ে, যদি অহর্নিশ এই হাসির নির্ঝরিনী বয়ে যায় পাশে। ঊষার অরুণিমা আভার মতি ছিল তার অধর, স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম কারুকাজই মনে হত। এমনই অধরের সোমরস পান করে বিহবল হতে কে না চাইবে। কে না চাইবে এই নাম মুখে নিয়ে ব্রজের কানুর মত যমুনার তীরে বসে মুরলী বাজাতে। তার কন্ঠ! সে তো বীণার ঝংকারের মত। আমি শুনিনি এমন কন্ঠ কোন নারীতে। শুনলে পরে যেন বায়ু স্তব্ধ হয়ে যায়, তারপরে ঊর্মিতে যেন ছড়িয়ে পড়ে। আর আমি তখন ইষ্ট নাম ভুলে শুনে যাই কন্ঠের লহরী।

একদিন পথে শারদ বিকেলের মিঠে কমলা রোদ গায়ে মেখে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম গোরী আসছে। সাথে সপ্তবর্ষীয়া আরেক বালিকা। ঠমক থমক পায়ের ছন্দে কৈশোর তনুতে জাগিয়ে দোল সে আসছে। আমাকে দেখেই মুখে সলাজ চেতনা, অরুণিমা অধরে সেই ভুবন মোহিনী হাসি। ভীরু ভীরু হরিণ চাহনি। পলকের লুকোচুরি। আমার পাশ কেটে যাবার সময় বলেছিলাম- গোরী, তুমি কই যাও? আমার কথায় বালিকার মুখে যেন হাসির বর্ষণ এলো। কী এমন রসের বাক্য যেন বলেছি। আর গোরী- বালিকার হাসিতে সেও হাসি চাপা দিয়ে বলল- দোকানে যাই। আমার মাঝে তখন ব্রজের কানু এসে ভর করেছে। আমি আবার বললাম- আমার জন্য কি আনবে? চকোলেট নিয়ে আসব বলে- বালিকার আবার সেই হাসি। চকোলেট না, আমার জন্য সুখকাঠি নিয়ে এসো বলে আমি আবার রোদ মাখতে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোরী তার পায়ের ছন্দে ছুটে চলল। দূর থেকে দেখলাম বালিকা আর কিশোরীর মাঝে কথোপকথন আর তার সাথে বিনোদিনী হাসির বন্যা। ফেরার পথে গোরী ঠিকই নিয়ে এসেছিল সুখকাঠি। তার যে কাজে আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি তা হল- সে নিজেই সুখকাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিজেই গুটি কয়েক সুখটান দিয়ে নিয়ে এসেছে। আমি তো এমনি বলেছিলাম। আমার সাথে তো ছিল। কিন্তু তার সেই চপলতার দানটুকু ফেলে দিতে পারিনি। আমি হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। এই চপলতা বিনে কি আর রস জমে। চপল কিশোরীই তো জানে প্রেমের রাগ মোচন।

গাঁয়ের এক বধূ ঠাট্টা করেই বলেছিল- ঠাকুরদা কাল রাতে তোমায় স্বপ্নে দেখেছি। তুমি যে আমার বিষ্ণুপুরুষ। বলেই অপরাপর বধূদের সাথে সে কি বিনোদ হাসির ধারা। আমিও হেসেছি আর বলেছি- তোমার নাগর শুনলে পরে মুখে তালা দেবে গো। বিষ্ণুপুরুষ করে তাকেই মালা দিয়েছ আর আমি কি না স্বপ্নে আসি। দূরে দাঁড়িয়ে সেদিন গোরীও শুনেছিল। তারও সে কি হাসি।আমি তাকাতে পারি না বধূদের এত কুটিল চোখকে ফাঁকি দিয়ে। আমার আড়ালেই রয়ে যায় গোরীর সেই ভুবন ভুলানো হাসি। অলস দ্বিপ্রহরে কত দিন তাসের রাজ্যে ডুবে গেছি। সময় যে আর কাটে না। আত্মীয়া কোন গৃহবধূর এক পেয়ালা চা তন্দ্রাচ্ছন্ন চেতনায় জাগরনের দোলা দিয়েছে। পুরুষরা তখন বাইরে কাজে। অকাজী আর কয়জন আছে। তাই মাঝে মাঝে গোরী আমার সাথেই খেলেছে। আমার চাহনির সামনে সেই লাজ অবনত মুখ আর সলাজ সে হাসি। চৌসর খেলায় আমি একাকী যতবার খেলেছি ততবারই যুধিষ্টিরের মত হেরে গেছি। যতবার গোরী আমার হয়ে খেলেছে আমি জিতে গেছি রাজ্যপাট।

গোরীর ঘরের পাশে আত্মীয় কুঠিরের আঙ্গিনার যখন আমি বসে থাকতাম, সেদিন শত কাজের মাঝে ব্যস্ত হলেও গোরী বারবার নানা ছলে দেখা দিয়ে যেত। আমার ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়ারা বলত- দেখো, তোমাকে দেখে আর তর সইছে না তার। আমিও যে তাকে দেখব বলে বসেছিলাম, তা কি আর কেউ জানে অন্তর্যামী ছাড়া। গোরী হয়তো জানে। একদিন রাতে তার হাতখানা ধরেছিলাম। থরথর করে ভীতু হরিণীর মত কেঁপে উঠেছিল সে। লজ্জাবতীর মত অবশ হয়ে গিয়েছিল। না, আমি অবশ গোরীকে দেখতে চাই না, আমি তো চাই সে চপল হরিণীকে। হাতখানা সরিয়ে নিয়েছিলাম। কূপির আলোয় পাশে বসে মাথা নিচু করে ছিল গোরী। মুখে তখনও তার সেই সলাজ হাসি। গৃহস্থের কুঠিরে কি আর ব্রজের যমুনা পুলিনের প্রেমালাপ হয়। গোরীও আর সময় পায়নি। ডাক পড়েছিল তার। সেই হাতের স্পর্শটুকু এখনও মনে আছে।

আমাকে ব্রাহ্মণদেব ভেবে গোরীর বাবা যখন আমারই পায়ের ধূলি নিয়ে নিজেকে কৃতার্থ মনে করেন, আমি তখন ভগবানে বলে যাই, এ ভক্তি তোমার তরে প্রভু। তুমি দিও তার প্রতিদান। আমি অধম কি জানি সে ভক্তির মূল্য। অন্যের কাছে আমি যা আছি তাই। কিন্তু গোরীর কাছে আমি হতে পারিনি। গোরী যখনই আমার পায়ে পড়েছে আমার মনে হয়েছে- এ ফুলের স্থান পায়ে নয়, একে তো স্থান দেব বুকে। আমি ব্রজের কানু হলে গোরী হয়েছে আমার বিনোদিনী রাধা। আমি তার কাছে ব্রাহ্মণদেব হতে পারিনি। গোরীও জানে সে কথা। তবু গোপনে খেলে যাওয়া প্রেমের রঙ্গ খেলা।

গোরী- আমি তাকে ঘাসফুল নামে ডাকি। সে জন্মেনি সমাজের কুলীন ঘরে। সে হতে পারেনি কুলীন কিশোরীদের মত বাগিচার গোলাপ। তাই সে আমার ঘাসফুল। বাগানে যারা স্থান পায় না কখনও, পথের মাঝেই ফুটে আর পথেই ঝরে। পায়ে দলিত-মথিত হয়ে তবু সুখ তাদের। কত বাগানের গোলাপ দেখেছি। কত নর্দমার কমল দেখেছি। তাদের নাগপাশে কাঁটার যন্ত্রণা পেয়েছি। বেলা শেষে সুবাসের বদলে পূতিগন্ধ পেয়েছি। কিন্তু ঘাসফুল আমার সবচেয়ে আলাদা। আমি কিন্তু এই ঘাসফুলকে আমার বুকের বাগানে রেখে দিতে কত স্বপ্ন দেখেছি। কত পূর্ণিমার রাতে একাকী বাইরে বসে তার কথা ভেবেছি, যদি পাশে থাকত আমার সেই ঘাসফুল। কিন্তু আমার সেই স্বপ্নকে মাটিতেই চাপা দিতে হয়। গোরী আমার হবে না। কোনদিনও হবে না। এই সমাজ হতে দেবে না। আমার ভগবান যদিও সেই পথ খোলে রেখেছেন, তবু মানুষ তা হতে দেবে না। এই সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষ কোন বিচার করে চলে না। এক আছে যারা উচ্চ শ্রেণীর, যারা যা ইচ্ছে করে সেটাই আইন। আর আছে সমাজের ভাসমান, তাদের তো কিছুই নেই, সাথে এত কিছু ভাবনা নেই। মরেছে তো মধ্যবর্তী। তফাতে চলে চলেই তো মরণ। কবি ঠিকই বলেছিলেন- “উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।“ আজ বড় অনুশোচনা হয়, আমি কেন ঠাকুর বীর প্রতাপ সিং হলাম না। আমার মুখের কথাই তখন হয়ে যেত শাস্ত্র। আর আমার ঘাসফুল তখন আমার বাগিচায় এলে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। হায়! আমার ঘাসফুল, এ জীবনে আমার এ সাধ মিটলো না।

শেষবার যখন গোরীকে দেখেছি। দূর থেকেই দেখেছি। কোন কথা হয়নি। আমার আত্মীয়া বলেছিল- যাও, শেষবারের মত দেখে যাও। আবার এলে সে আর তোমার র’বে না। শুনেছি গোরীর বিয়ে হবে। আমি ফিরে আসার সময় গোরীর বাবার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে এসেছি। বৃদ্ধ এক কন্যার দায় মাথা থেকে নামিয়ে মুক্ত হতে চায়। আমি আশীর্বাদ করে এসেছি- গোরী, তুমি সুখী হও। আবার যখন দেখব তখন তোমার সিঁথীতে পরিণীতার সিঁদুরের আলপনা দেখব সেদিন আমি ঠিকই তোমার গুরুদেব হয়ে যাব। আমি আর তোমার ব্রজের কানু হয়ে রইবো না।

একটাই খেদ রয়ে গেল মনে, এ জীবনে আমি বীর প্রতাপ সিং হলাম না। আমার ঘাসফুলও আমার বুকের বাগানে এলো না। ব্রহ্মদেবই জানেন, প্রেম জাগিয়ে মনে তাকে মাটি চাপা দিয়ে, এ তার কোন লীলা।
 

*

অনুবাদ রোমাঞ্চ গল - শেষ পর্ব
সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকার

 

*

 

প্রবন্ধ

 

যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ

 

 

 

আর্কাইভ

 

 

 

Best view with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf