মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস

প্রতীক্ষা

 

ফিরোজা হারুন

 

বহুদিন আগের কথা। একটি সাধারণ ঘটনা জীবনের মোড় এমনভাবে ঘুরিয়ে দিতে পার, তা ছিল কল্পনার অতীত। তবুও তাই ঘটেছিলো। তারপর জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে আজ বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু সেদিনটির সেই ঘটনা আজও অন্তরের অন্তঃস্থলে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে। সে দৃশ্যটি বিস্মৃত হওয়ার প্রয়াস পাইনি কখনও। কেন বিস্মৃত হবে তার কথা! সে যে আমার ভালবাসার, ভাল লাগার, বেদনার, জন্ম জন্মান্তরের আরাধনার লব্ধ সম্পদ। তাকে তো উপেক্ষা করতে পারিনা। তাই তো স্মৃতির বীণায় আজও তারই কথা ফিরে ফিরে বাজে।

 
        মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছুকাল আগের সময়। তখন আমরা কলেজ হোস্টেলে থাকি। সে সময় মেয়েদের ঘরে বাইরে এমন যত্র-তত্র বিচরণ ছিল না। চলাফেরা ছিল অনেক সীমিত। হোস্টেলের মেয়েরা ছিল বন্দী। একই কম্পাউন্ডে স্কুল, কলেজ, হোস্টেল। বড় বড় ছুটিতে মেয়েরা বাড়ি যেত। তাও পিতা অথবা পিতা কর্তৃক নির্দিষ্ট গার্জিয়ানের সঙ্গে। পুনরায় ছুটি শেষে হোস্টেলে পদার্পণ। এভাবেই কেটে যেতো ছাত্রীজীবন। সেজন্য মেয়েদের হোস্টেলের বাইরে চিত্তবিনোদনের একমাত্র উপায় ছিল বনভোজন। সকলের জন্য নয়। নাইন-টেন, এবং কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার এর ছাত্রীদের জন্য। আশায় আশায় দীর্ঘকাল পার হয়ে শেষে নাইন টেনে এসে বনভোজনের সুযোগ পেলাম। এইভাবে একবার যখন কলেজে পড়ি মধুপুরের মধুবনে বনভোজনে গেলাম। আমরা, আপারা, বড় আপা, বাবুর্চিরা, বিরাট বিরাট দুই বাস ভরে গান গাইতে গাইতে জঙ্গলে এসে পৌঁছালাম। বাসের মাথায় বড় বড় ডেকচি, চাউল, ডাল, মাংস, মসলা-সব কিছু ছিল। ছিলনা কেবল জ্বালানী। থাকবেই বা কেন? নিউ ক্যাসেলে কেউ কি কয়লা নিয়ে যায়? বন-জঙ্গলে কাঠ-খড়ি বহন করে নিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। বাস থামার পর আমরা ছুটে গেলাম খড়ি কুড়াতে। এটা ছিল খুব মজার ব্যাপার। মুহূর্তের মধ্যে প্রচুর জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ হয়ে গেল। বাবুর্চি ভয় পেয়ে চিৎকার করে বললো, ‘আর নয়, আর নয়। যথেষ্ট হয়েছে’।
        বনের ভেতর বেশ খানিকটা জায়গা আমাদের জন্য পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিলো। সেটা ছিল ঘন বন। অদূরেই ছিল একটি ডাক বাংলো। সেখানে পানির ব্যবস্থা ছিল, বিশ্রামের আয়োজন ছিল। জীবনে কোনদিন কূয়া দেখিনি। কূয়া হতে পানি উত্তোলন- সেকি প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকে পানি তুলতে চায়। বাবুর্চিরা নিষেধ করলো। এভাবে পানি তুললে কূপটি পানি শূন্য হবে অচিরেই। গানে, নাচে, আনন্দে আমরা আত্মহারা। কেউ কেউ রন্ধন কার্যে সহায়তা করছে। চারিদিকে রান্নার খুশবু মৌ মৌ করছে। কেউ বা সালাদ ইত্যাদি কাজে হাত লাগিয়েছে। এমন সময় আমরা তিন তরুণী হাস্না, হেনা, আমি -শিউলি বনের ভেতর অ্যাড্ভেঞ্চার করতে চলে গেলাম। ভেবেছিলাম একটু আশে-পাশে ঘুরে দেখবো। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম বেশ দূরে। জঙ্গলে যে এত কিছু দেখবার আছে জানতাম না। বিরাট বিরাট বৃক্ষ। মনে হয় হাজার বছরের পুরানো। যেন কত কথা বলতে চায় বয়স্ক নাগরিকদের মত। কত প্রকার যে গাছ-পালা তার ইয়ত্তা নেই। লতাগুল্ম অজস্র। পায়ে জড়িয়ে যায়। বড় বড় লতা অন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে কোথায় উঠে গেছে!


 

সময়টি ছিল শীতকাল। সেজন্য কিনা জানিনা, এত নাম না জানা ফুলের গাছ, চারিদিকে সুবাস ছড়াচ্ছে। গন্ধ নেবার কেউ নেই। এত ফুল দেখে আমরা তিন বান্দা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। ইচ্ছা করছিল ফুলের চারা নিয়ে যাই। হোস্টেলের বাগানে লাগাবো। অরণ্য যে এত বিচিত্র সম্ভারে পূর্ণ তা আমাদের জানা ছিল না। নজরে পড়লো প্রচুর গিলার গাছ। লতানো। মোটা মোটা লতায় ধরে আছে অসংখ্য গিলাফল। অনেকগুলো তুলে নিলাম। কোঁচড় ভরে ফেললাম। এগুলো বাঙ্গালী ললনাদের বিয়ের গোসলের জন্য হলুদ বাটার সঙ্গে মেশানো হয়। এ গাছ থেকে ও গাছ, এ ফুল থেকে ঐ ফুল- এই রকম করে করে কখন যে পথ হারিয়ে ফেলালম জানিনা। যখন বোধগম্য হল তখন আমরা আমাদের আস্তানা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এবার ফেরার পালা। যেদিকে যাই মনে হয় এদিকে নয়, ঐদিকে। পথ ঠাহর করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ালো। গাছপালার সঙ্গে লুকোচুরি করতে করতে বেশ বেলা হয়ে গেল। গভীর অরণ্যে সূর্যের কিরণের প্রতিফলন দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে বেলা অনেক গড়িয়েছে। আমাদের হাতে ঘড়ি ছিলনা। ছিল চুড়ি। তাতে রিনিঝিনি শব্দ হলেও সময় দেখার কোন উপায় নেই। ভীষণ ভয় পেলাম। চঞ্চল পদক্ষেপে হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হল। শাড়ীর অঞ্চল ছিন্ন হল। এত ভাল লাগার অনুভূতি অন্তর্হিত হলো। শীতের বেলা ছোট। কোনদিকে গেলে পথ খুঁজে পাবো জানিনা। আমরা তো গল্পের নবকুমার নই, যে কোন এক কপালকুন্ডলা এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে কান্না জুড়ে দিলাম। ইতিমধ্যে একটি বাঁশির সুর আমাদের কানে এলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই শ্রুতিগোচর হচ্ছিল। তবে চৈতন্যে প্রবেশ করে নাই। সচকিত হয়ে হাস্না, হেনাকে বললাম, ‘চল, ঐ বাঁশীর সুর অনুসরণ করে ওদিকে যাই।’ আর কোন উপায় নেই আমাদের। আমরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছি গাছ-পালার বাধা অতিক্রম করে। বোধ হয় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। এমন সময় সুরটি গেল থেমে। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কান পেতে রই সুরটি পুনরায় শ্রবণ করার জন্য। কারণ দ্রুত পদক্ষেপের দরুণ পাতার মর্মর ধ্বনি পাছে সুর শোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। কিন্তু বাঁশী আর বাজেনা। তখন আমরা তিন কন্যা উচ্চস্বরে অরণ্যের মধ্যে রোদন করতে আরম্ভ করলাম। ‘অরণ্যে রোদন’ এখন বাংলা ব্যাকরণ ছেড়ে আমাদের কণ্ঠে, এই জনমানবহীন গভীর জঙ্গলে বাস্তবে রূপ নি


        অরণ্য যে বৃক্ষলতা, বাহারী ফুল, লতাপাতায় সজ্জিত, কেবল তাই নয়, নানারকম পাখির কলকাকলীতে মুখরিত। তারা মনের সুখে, প্রাণ খুলে সঙ্গীত চর্চায় ব্যস্ত। যেন সুরের সাধনায় মগ্ন। যদি পথ না হারাতাম তবে হয়ত এই গাছ-পালার জগতে তাদের বাসিন্দা পক্ষীকূল ও কিছু বনবিহারী প্রাণীর কথাই চিরকাল সুখের স্মৃতি হিসাবে মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখতাম। কিন্তু বিপদগ্রস্ত হয়ে সেদিকে আর মন দিতে পারিনি। এমন সময় সেই বাঁশী আবার বেজে উঠল। ‘...... বাঁশী কেন গায়, আমারে কাঁদায়, যে গেছে হারায়ে .......।’
        আমাদের অনুভূতি আর্তচিৎকারে পরিণত হল। আবার থেমে গেলাম। একটু ফাঁকা জায়গায় দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখতে পাই এক তরুণ যুবা। কয়েক ফার্লং দূরে বংশী হস্তে দন্ডায়মান। এক বিরাট বৃক্ষের গায়ে ঈষৎ হেলান দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মত এক পায়ের সঙ্গে অন্য পা ক্রস করে দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে। ঘন কৃষ্ণ, কিঞ্চিত কুঞ্চিত কেশদাম ঘাড় অবধি বিস্তৃত। শ্যামল, মাঝারি উচ্চতা। তারুণ্য উৎরে গিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে মাত্র। নবকুমারের যেমন কপালকুন্ডলাকে দেখে বাকরোধ হয়েছিলো, আমাদেরও তাই হল। আমাদের পা আড়ষ্ট, যেন মাটির সঙ্গে আটকে গিয়েছে।
        আমাদের তিনজনেরই মনে হল, যদি আমরা একটু অগ্রসর হই, তবে এই দেবদূত নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমরা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ক্রন্দন সম্বরণ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার প্রয়াস পাই। অনুনয় করে বললাম, ‘আমরা বিপদে পড়েছি। আমরা সরকারি কলেজের ছাত্রী। পিকনিক করতে এসে পথ হারিয়েছি। দয়া করে একটু সাহায্য করুন। চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের কথা একটু শুনুন।’
        ছেলেটির দয়া হল। একটু এগিয়ে এলো। সেও ভয় পেয়েছে। এই নির্জন বনভূমিতে তিন তরুণী, নাকি জ্বীন-পরী, কে জানে? ভূত-প্রেত নাকি মানবীর রূপ ধরে মানুষকে ভুলিয়ে কোথায় নিয়ে যায়!
        ছেলেটি বললো, বনের ভিতর পথ নির্ণয় করা কঠিন। আপনাদের পিকনিক স্পট খুঁজে বের করা অসম্ভব কাজ। কেবল যেদিক থেকে আমি এ বনে প্রবেশ করেছি, সেদিকে নিয়ে গিয়ে হাই ওয়েতে আপনাদেরকে পৌঁছে দিতে পারি। তার বেশী নয়। আমিও খুব একটা চিনিনা এই এলাকা। বনভূমি আমাকে টানে। তাই ছুটি হলেই সেই আকর্ষণে একবার এখানে এসে বাঁশী বাজিয়ে মনে এক অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে ফিরে যাই।
        আমরা ছেলেটিকে রীতিমত পর্যবেক্ষণ করি। মাঝারি উচ্চতা। উজ্জ্বল শ্যাম গাত্রবর্ণ। নিখুঁত সুন্দর অ্যাপোলোর মত চেহারা। চোখ দুটি গভীর দীপ্তিময় যেন অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পায়। দেবদূতই বটে। স্বয়ং ঈশ্বর আমাদেরকে উদ্ধার করবার জন্য তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। তা না হলে আজ আমাদের কি হত ভাবতেই গা শিউরে উঠে।


        ছেলেটি যে বিরাট বৃক্ষের নীচে আপন মনে বাঁশী বাজাচ্ছিল, সে বৃক্ষটির একটু বর্ণনা দিতে হয়। সেটি এক বিরাট বটগাছই নয়, দিগন্ত জোড়া তার শাখা-প্রশাখা-চারদিকে বিস্তৃত। মাঝখানে ঠেসমূল দিয়ে তাবত এলাকা একটি প্রকান্ড বৃষ্টিচ্ছায়া আশ্রমে পরিণত করেছে। মাইল খানেক হয়ত হবে তার বিস্তারের পরিধি। ঠেস মূলগুলো যেন ঘরের ছাদের খুঁটির মত। কোন প্রকৌশলী হয়ত বুদ্ধি প্রয়োগ করে খুঁটিগুলো সুবিন্যস্ত করেছে যে, কোথাও তার অসামঞ্জস্য নজরে না পড়ে। তবে স্থানে স্থানে বেশ ঘন হওয়ায় পথ চলায় বিঘ্ন ঘটায়। এমন ছায়া সুনিবিড় একটি পরিবেশে এই যুবক চয়ন করেছে তার ভাল লাগার সময়টুকু কাটাবার জন্য।
ছেলেটি বললো, ‘এই বটবৃক্ষ আমার বন্ধু, পরম আত্মীয়, আমার অবিচ্ছেদ্য অংশের মত। কেন জানি না, প্রথম দেখার পর হতেই অনিবার্য আকর্ষণে এখানে চলে আসি। আরেকটু পরেই দেখতে পাবেন আদিবাসীদের বসতি। সংখ্যায় তারা নগণ্য। অরণ্য তাদের ঘরবাড়ি। নির্ভয়ে, আনন্দে তাদের দিন কাটে। হিংস্র পশুও এ বনে আছে। কিন্তু ওরা ভয় পায় না। আমার সাথে এদের বন্ধুত্ব। এরা আমাকে ভালবাসে। এদের ভরসাতে আমি স্বচ্ছন্দ অনুভব করি। আমার বাঁশীর সুরের একটি সংকেত আমি ওদেরকে চিনিয়ে দিয়েছি। সেটি বাজালেই ওরা ছুটে আসবে আমাকে উদ্ধার করবার জন্য, যদি কখনও বিপদে পড়ি।’


        এসব শুনতে শুনতে আমরা পথ চলছিলাম। আতংকে দুশ্চিন্তায় আমাদের গল্প শোনায় তেমন মনযোগ ছিলনা। এসে পৌঁছালাম আদি বাসীদের এলাকায়। অরণ্যাচ্ছাদিত লোকালয়। এক বিচিত্র মিশ্রভাষায় যুবকটি আমাদের কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করে ওদের নিকট। তারপর জানতে চায় ডাক বাংলো কোনদিকে। উপজাতীয় লোকটি দক্ষিণ হস্ত দক্ষিণ দিকে প্রসারিত করে বললো আরো আধা মাইল দূরে। আমরা এতক্ষণে প্রায় মাইল খানেক পথ হেঁটেছি। তারপর আরো আধা মাইল! আমাদের ‘কপোল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে।’ অনুনয় করে বললাম, একটু পৌঁছে দিয়ে আসুন আমাদেরকে। ইতস্তত করে ছেলেটি আদিবাসীদের একজনকে সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে মহাসড়ক ধরে হাঁটতে লাগলো। এবার আর কোন কথা নয়। কেবল পথ চলা।
        যদি ডাকবাংলো খুঁজে না পাই, তখন কি হবে, জানতে চাইলাম আমি। অনায়াসে ছেলেটি বললো, কিছুই হবে না। সে ব্যবস্থা আরো সোজা! আমার সঙ্গে বাসে চড়ে শহরে চলে যাবেন। তারপর লোকালয়ের নিয়ম অনুযায়ী আপনাদের বিচার হবে, এই যা। শুনে আমাদের পিলে চমকে উঠলো। সত্যি তো, আমাদের হেনস্থার অন্ত থাকবেনা। কলেজে রাষ্ট্র হয়ে যাবে আমাদের কুকীর্তির কথা। সকলেই ধিক্কার দিবে। কর্তৃপক্ষ হয়ত আমাদেরকে রাস্টিকেট করবে তিন বছরের জন্য।


        বনানীর প্রান্ত ঘেঁষে পথ চলতে চলতে আমরা পর্যদুস্তু। একসময় আদিবাসী বললো, এদিক দিয়ে ভেতরে চলে যান। দেখলাম সামনে ফাঁকা জায়গা। লাউড স্পীকারে গান আর মেয়েদের কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে মৃদু মৃদু। আমরা কূল পেলাম। তিন কন্যা তড়িৎ পিছন ফিরে একযোগে বলে উঠলাম, এবার আপনি যান। অনেক ধন্যবাদ। বলেই এ্যাবাউট টার্ন করে সামনের দিকে মার্চ করতে শুরু করলাম। হঠাৎ কি মনে হল। চকিতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওরা দুজন বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে আমাদের গমন পথের দিকে চেয়ে আছে। আমি ফিরে গিয়ে বললাম, আপনার নামটি জানা হয়নি। কি নাম আপনার? উত্তর এলো, পিন্টু- ফেরদাউস খান। আপনার? বললাম, শিউলি। আবার হয়ত দেখা হবে। বিদায়।
        দৌড়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম, বনভোজনের স্পটে- শব্দ অনুসরণ করে।
        দিনের আলো কোমল হয়ে সোনা ঝরাচ্ছে। বনভূমি অপূর্ব মায়াবী রূপ ধারণ করেছে। চারিদিকে এত সৌন্দর্য। তারই মাঝে আমরা ভগ্নদূতের মত গিয়ে হাজির হলাম। আনন্দে চিৎকার করে উঠলো মেয়েরা। প্রিন্সিপাল, স্যাররা এগিয়ে এলেন। বড় আপা নরম ভাষায় জানতে চাইলেন, তোমারা এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
        সহসা উত্তর এলোনা মুখে। ব্রহ্মতালু কণ্ঠ যেন শুষ্ক কালাহারি মরুভূমি। বড় আপা গর্জে উঠলেন, ‘জবাব দাও।’
   কোন রকমে বললাম, ‘পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
-‘কেন গিয়েছিলে না বলে? কার পারমিশনে?’
-‘কাছেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ কোন দিকে যাবো ঠিক করতে পারিনি। পথ খুঁজতে খুঁজতে দূরে চলে যাই।’
-‘কি করে পথ খুঁজে পেয়েছ?’
এবার হাস্না, হেনা বললো, ‘বুদ্ধি করে পথ খুঁজে খুঁজতে বনের বাইরে এসে দাঁড়াই। সেখান থেকে আন্দাজ করে এদিকে এসে ডাক বাংলোর সন্ধান পাই।’
--তা তোমাদের বুদ্ধি অনেক! সকলে আমাদেরকে ঘিরে ধরলেন। বড় আপা, অন্য আপারা যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগাল করলেন। কলেজ থেকে বের করে দেবেন বললেন। গার্জিয়ানদের ডেকে মিটিং করে জিজ্ঞেস করবেন, এসব মেয়েদেরকে হোস্টেলে রাখা উচিৎ কিনা। ইত্যাদি নানা বাক্যবাণে আমাদের জর্জরিত করলেন। কেবল শূলে চড়াবার বাকি রাখলেন।
এদিকে বেলা পড়ে এলো। আমরা নিখোঁজ না হলে এতক্ষণে আমরা শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। তৈজসপত্র বাঁধাছাদা, বাসের উপর তোলা- সব শেষ। বনভোজনের ভোজন পর্ব তো আগেই সারা। খাওয়ার পরপরই খবর হল যে তিন মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছেনা। তারা ভোজনে যোগদান করেনি। এদিক ওদিক অনুসন্ধান করে মেয়েরা কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। বড় আপা তৎক্ষণাৎ রোলকলের ব্যবস্থা করেন। মেয়েদেরকে লাইন করিয়ে নাম ডাকা হল। তিন মেয়ে অনুপস্থিত। চিন্তায় সকলেই স্তব্ধ হলো। জঙ্গলে চতুর্দিকে লোক পাঠানো হলো। সকলেই ফিরে এলো ম্লান মুখে। বড় আপা থানায় লোক পাঠালেন। সেখান থেকে পুলিস এসে হাজির। ডাকবাংলোর ইঁদারার ভেতরেও আমাদেরকে খোঁজ করা হল।


        ইতিমধ্যে পড়ন্ত বিকেলে আমরা তিন বান্দা এসে উপস্থিত হলাম। আমরা বুদ্ধি করে সেই ছেলেটির নাম বলিনি। বললে নির্ঘাত এই কাহিনী অন্য একটি রোমাঞ্চকর রূপ ধারণ করতো। তারপর কত রসালো, মুখরোচক গল্প হোস্টেলে প্রচলিত হয়ে যেতো, তার হিসাব নেই। আর আমাদেরকে কত যে লাঞ্ছনা, মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো, তা একমাত্র আন্তর্যামীই জানেন।
        মধুপুরের মধুবনে বিলাস ভ্রমণে কোথায় আনন্দ আহরণ করতে গিয়েছিলাম! কিন্তু ‘কি ফল লভিনু হায়! তাই ভাবি মনে।’ তিন আসামী ফিরে এলাম হোস্টেলে। সারাদিন অভুক্ত। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। তার উপর খাঁড়ার ঘা। বাবুর্চি ভাইদের কৃপায় একটু জলপান করতে পেরেছিলাম মাত্র। পিকনিকের ভোজন সামগ্রী যা উদ্বৃত্ত হয়েছিল, তা আদিবাসী বালক বালিকাদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওরা কোথায় যেন আশে পাশেই থাকে। পিকনিক পার্টির ফেলে যাওয়া খাদ্য কুড়িয়ে খায়, অমৃতের স্বাদ পায় যেন।


        পথ হারিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি। আতংকগ্রস্ত হয়েছি। অপমানিত হয়েছি। বকা খেয়েছি প্রচুর। তবে যেটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল- একটু খাদ্য, একটু পানীয় তা পাইনি। ত্রাসে, ক্লান্তিতে আমাদের তিনজনেরই জ্বর উঠে গেল। রাত্রে শরীরের তাপ এত বৃদ্ধি পেল যে প্রলাপ বকতে শুরু করলাম। রুম মেটরা সেবা যত্ন করে বিফল হয়ে আপাদের শরণাপন্ন হলো। অবস্থা দেখে তাঁরাও বিচলিত। নৈশ প্রহরীদের তলব করলেন। ডাক্তার আপাকে যেমন করে হোক নিয়ে আসার জন্য হুকুম দিলেন। ডাক্তার আপা বললেন, ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। ভয়ে ওদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। অষুধ দিলেন, পথ্য দিলেন। আর উপদেশ দিলেন, ‘ওদের সঙ্গে আপনারা আর খারাপ ব্যবহার করবেন না। অভয় দিন, সহানুভূতি প্রদর্শন করুন। মমতাপূর্ণ ব্যবহারে ওদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। নইলে ওদের মনোবিকলন দেখা দেবে। যে শাস্তি ওদের জন্য ধার্য করা হয়েছে, সেগুলি তুলে নিন।’


        পরদিন বড় আপা এসে হেসে আমাদের কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, ‘এই মেয়েরা, এত ব্যাকুল হওয়ার কি আছে? তোমরা হারিয়ে গেলে আমাদের কি হতো? একবার ভাব তো? তোমাদের বাড়ীতে কি হতো? আমরা কি জবাব দিতাম তোমাদের বাবা মার কাছে? সেজন্য আমরা রাগ করেছি। তোমাদের কোন শাস্তি হবেনা। সব ভুলে যাও। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত কর। সামনে বড়দিনের ছুটি। বাড়ি যেতে হবে। নইলে মেট্রন মাসীমার পাশের সিক রুমে শুয়ে শুয়ে ছুটি কাটাতে হবে।’
        বড় আপার সান্ত্বনার সুমধুর বাণী শ্রবণে তিন মেয়ের উত্তপ্ত চিত্ত শান্ত হলো। তাপ কমে গেল ধীরে ধীরে।

    ২

 

        আমার লোকাল গার্জিয়ান ছিলেন আমার চাচা। কলেজের নিকটে, কলেজ রোডে বাসা। শীতকালীন ছুটির জন্য কলেজ বন্ধ হল। চাচার সঙ্গে বাসায় এলাম। পরের দিন বাড়ি যাব চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে, যদিও বয়সে সে আমার চাইতে ছোট। সেদিন বিকেলে, চাচীরা চায়ের আসরে তখন। আমি গিয়ে ঢুকলাম তাদের ঘরে। হঠাৎ যেন ভূত দেখে চমকে উঠলাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিনা। বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্র আমার। দেখি সেই তরুণ! আমাদের নবজন্মের নবকুমার মধুবনের পিন্টু! অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আবেগে আপ্লুত আমি। তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো পিন্টু। আমরা পরস্পরের প্রতি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে বললাম, আপনি? জবাব না দিয়ে বললো, আপনি? চাচী বললেন, চেন নাকি? উপবেশন করতে করতে বলললাম, চিনি ঠিক নয়, তবে চিনি বৈকি! সেটা কি রকম হেঁয়ালী হল? খুলে বল। মনে মনে ভাবলাম, এরা ভুল বুঝবেন। সেজন্য সব ঘটনা ব্যক্ত করতে হল চাচীদের কাছে।
        তারপর তার পরিচয় জানতে পারলাম। সে চাচীর মামাতো ভাইয়ের একমাত্র ছেলে। কবে কোন এক ছুটিতে মধুপুরের জঙ্গলে এসে বাঁধা পড়েছে সবুজ বনানীর মায়া পাশে। সেই হতে যখনই সুযোগ পায়, বছরে একবার অন্তত আসে, তার এই তীর্থে। চাচার বাসায় থেকে মধুপুরে বেড়াতে যায়। হাতে থাকে তার মোহন বাঁশী। গভীর নিশীথে সে যখন বাঁশীতে তান তোলে তখন সুপ্তিমগ্ন পুরবাসীরা যেন স্বপ্নের রাজ্যে চলে যায়। স্বর্গীয় সুরের সরোবরে অবগাহন করে তারা যেন সংসারের দুঃখ-যাতনার কথা ভুলে যায়। সুরের আনন্দধারা মানুষের অন্তরের নিদাঘের খরতাপকে শীতল করে। হৃদয় ভারমুক্ত হয়। আত্মার ঐশ্বর্য্য বৃদ্ধি পায় ক্ষণিকের জন্য। বাঁচতে ইচ্ছে করে, ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে, ভালবাসতে ইচ্ছে করে।


        পিন্টু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। ভাবুক প্রকৃতির। বুদ্ধিমান। কর্মঠ। পরের তরে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। যেখানে পিন্টু থাকবে, সেখানে সকলের ভরসা। তিন বোনের একমাত্র বড় ভাই। চাচী বলেন, পিন্টু আমাদের কলির কৃষ্ণাবতার। গায়ের রংটি কালো নয়, এই যা তফাৎ!
        সেদিন সারাবেলা পিন্টুর সঙ্গে নানাবিধ আলাপ হল। পিন্টু অনার্স দিয়েছে। আমি আগামী বছর ভর্তি হব বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শনশাস্ত্র পড়ার ইচ্ছা আমার।
        সৃষ্টির রহস্যের বিতর্ক সম্বন্ধীয় পড়াশুনায় আমার খুব আগ্রহ। ডে-ইজম থে-ইজম, আইডিয়ালিজম, রিয়ালিজম- ইত্যাদি মতবাদ সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। পিন্টু বললো, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো ভর্তির ব্যাপারে। তখনকার দিনে ভর্তি পরীক্ষা ছিলনা বললেই চলে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার ছাড়পত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হতো।
        পরের দিন বাড়ি চলে গেলাম। আমাদের বন ভোজনের রোমাঞ্চকর কাহিনী বর্ণনা করলাম। মা ও ছোটভাই বোনেরা শিউরে উঠলেন ভয়ে। কেবল বাবা অজ্ঞাত রইলেন এ ব্যাপারে। কারণ কন্যাকে হোস্টেলে রেখে সর্বদা তিনি উদ্বিগ্ন থাকেন। পিকনিক করে তাদেরকে বনে-জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে এরকম বিপদের ফাঁদে পড়া মোটেই ভাল কথা নয়। এতগুলো চঞ্চল মেয়েকে সামলানো কয়েকজন শিক্ষিকার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া তাঁরাও মহিলা। কোন বিপদের সম্মুখীন হলে তার শিকার হবেন তাঁরা নিজেরাও।


        মা খুব করে বকা দিলেন। ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিলেন। পরের বছর আই.এ. পরীক্ষা হলো। আমরা তিন মেয়ে ভালভাবেই উৎরে গেলাম। আমার উচ্চ শিক্ষার খুব শখ।হাস্না-হেনা বললো, ইউনিভার্সিটিতে বিরাট লাইব্রেরী আছে। সেখানে নাকি মই দিয়ে উপর থেকে বই নিয়ে পড়তে হয়। প্রচুর পড়া; প্রচুর বই সেখানে। সুতরাং উচ্চ শিক্ষায় কাজ নেই।


        তখনকার দিনে এত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। অনার্স পড়তে হলে ঢাকায় যেতে হত। গ্রাম থেকে অচেনা শহরে এসে ভর্তির কাজ করা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। মনে পড়লো পিন্টুর কথা। বাবা, চাচার বাসায় এসে পিন্টুর খোঁজ করেন। চাচা আমার কাগজ পত্র সব ডাকযোগে পিন্টুর নিকট প্রেরণ করেন। পিন্টু সব কিছু ঠিক করে দিল। কিন্তু গোল বাঁধলো হোস্টেলের সীট নিয়ে, ছাত্রী হলে সীট খালি নেই। সেজন্য হল কর্তৃপক্ষ ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। বাড়ির নাম লেইক লাক্সারী, স্বয়ং আমার পিতৃদেব সেখানে গিয়ে অনুরোধ করে আবেদন করায় একটি সীট বরাদ্দ করা হলো আমার নামে। মাস খানেক পর আমি ঢাকায় আসি। পূর্ব যোগাযোগ অনুযায়ী পিন্টু ছিল ঢাকা রেল স্টেশনে। সেই আমাদের নিয়ে গেল, ধানমন্ডির লেইক-লাক্সারী এক্সটেনশান হলে। ঢাকায় তখন আমাদের কোন আত্মীয় ছিলনা। সেজন্য পিন্টুর মামাকে আমার লোকাল গার্জিয়ান করা হল। তিনি পিন্টুরও লোকাল গার্জিয়ান। তিনি খুশী হলেন। যে কোন প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষভাবে বলে দিলেন। আমার পিতৃদেব অনেক সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার জন্য উপদেশ দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। আগেও হোস্টেলে ছিলাম। কিন্তু মন এত উচাটন হয়নি। এবার যে প্রাণ কেন এত আনচান করছে। মনে হলো বিদেশে আছি। সুতরাং পিন্টুই আমার একমাত্র ভরসা।


        দর্শনের ছাত্রী আমি। ক্লাস শেষে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াই। পিন্টু আমাকে তিন নম্বর বাসে করে হলে পৌঁছে দিয়ে যায়। কয়েকদিনে একটু সাহস সঞ্চয় হয় আমার। পরিচয় ঘটে বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যাতায়াত করি বাসে। তবে প্রায়ই ক্লাস না থাকলে পিন্টু বাসস্ট্যান্ডে আমার জন্য অপেক্ষা করে।


        একবার ভেবেছিলাম পড়াশুনা ছেড়ে বাড়ি চলে যাই। ঢাকায় থাকতে পারবোনা। পিন্টু বলে, সারা দেশের ছেলে-মেয়েরা ঢাকায় আসার জন্য পাগল, আর তুমি ঢাকায় থাকতে চাওনা? এ কেমন কথা! ঢাকা রাজধানী! দেশের সেরা শহর। পথঘাট, গাড়ি-ঘোড়া, বৈদ্যুতিক আলো-বাতাস। দেখবার মত কত কি? সবচে ভাল ঢাকার পানি। এত মিষ্টি যে প্রাণভরে পান করা যায়। মনে হয় সব রোগশোক হরণকারী। তুমি ঢাকায় থাকবেনা তো যাও, মধুপুরের মুধুবনের মধুকুঞ্জে প্রস্ফুটিত পুষ্পবীথির সঙ্গে, সেই দুই মেয়েকে নিয়ে নেচে নেচে বেড়াও গে। লেখাপড়াও করতে হবে না, ঢাকায়ও থাকতে হবে না।


        উচ্চ শিক্ষা লাভের বাসনা হয়ত ত্যাগ করতে হতো। রয়ে গেলাম পিন্টুর জন্য। একদিন পিন্টুর দেখা না পেলে মনে হতো পড়া ছেড়ে দিব। পিন্টু এলে মনে হয়, না ঢাকায় থাকবো। অন্য কোথাও যাবো না। এভাবে পিন্টু হলো আমার নিত্য দিনের সাথী। বাসস্ট্যান্ডে এসে আমার দুচোখ কেবল পিন্টুকেই খোঁজে।


        একবার কয়েকদিন ধরে পিন্টুর দেখা নাই। আমার মন বড্ড ব্যাকুল। কি জানি পিন্টুর কি হল। ভেবে ভেবে শয্যাশায়ী হলাম। তবুও ক্লাসে যাই এই আশায় যদি সে এসে ফিরে যায়। ‘কেমনে রাখি, আঁখি বারি চাপিয়া।’ লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছি দিন রাত। এক সপ্তাহ কেটে গেল। রুমমেটকে নিয়ে গিয়ে হাজির হই পিন্টুর হলে। সে সময় ছেলেদের হলে মেয়েরা যেতো না। নিষিদ্ধ ছিল কিনা জানিনা। সাহস করে গেলাম সলিমুল্লাহ হলে। গিয়ে দেখি পিন্টু নেই। ওর রুমমেটকে একটি চিঠি দিয়ে আসি পিন্টুকে দেবার জন্য। জানতে পারলাম সে বাড়ি গিয়েছে। ভাবলাম মধুপুরের অরণ্যে বাঁশী বাজাবার সময় হয়েছে হয়তো! বছরে একবার তো তার সেখানে যাওয়া চাই। সে তো বৃক্ষ প্রেমিক গোপালকৃষ্ণ-মধুপুরের! বৃন্দাবনের নয় যদিও। তা বলে আমাকে বলে যাবেনা? মনে মনে ভাবলাম, আমি তার কেই-বা? বাবার ফুফাতো বোনের ভাসুরের মেয়ে। আমার জন্য সে অনেক করেছে। সারা বছর কি সে আমাকে আগলে রাখবে? খুব অভিমান হল। মন কিছুতেই মানে না। যুক্তি দিয়ে মনকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। এবার আর লুকিয়ে নয়, উচ্চস্বরে। সংযমের বাধ ভেঙ্গে গেল। সব মেয়েরা জড়ো হল। সান্ত্বনা দিল অনেকে। সেই রুমমেট অনু, যে বুঝতে পেরেছে আমার ক্রন্দনের হেতু কি, তাকে আগেই প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলাম সে যেন আমার অভিসারে যাওয়ার কথা গোপন রাখে। সুতরাং সকলে জানতে পারলো বাড়ির জন্য আমি এমন উতলা হয়েছি। প্রথম প্রথম প্রায়ই একরম আচরণ করেছি। সবাই বললো, মেয়েটা বড় কোমল হৃদয়ের, হোম সিক।


        পরদিন ছিল রবিবার। ছুটির দিন। মনে হল এত ছুটির দিনের কি প্রয়োজন? কাল অন্যবার হতে পারতো। পিন্টুকে দেখতে পেতাম হয়তো। রবিবারের উপর খুব রাগ হল। যদিও রবিবার ছাত্রী হলের জন্য শুভবার। কারণ ঐদিন ভিজিটরস্ ডে। মেয়েদের আত্মীয়স্বজনেরা দেখা করতে আসেন। আমার আর সেদিকে মন নেই।
        বিকেলের দিকে বসে আছি বাতায়ন পাশেই। জানালার পাশটি বেশ চওড়া। সেজন্য গরাদ ঘেঁষে লম্বা করে পা মেলে উদাস বিরহী দৃষ্টি তুলে আকাশ পানে চেয়েছিলাম।
হোস্টেলটি একটি বাড়ি। সেজন্য মেইন ছাত্রী হলের ন্যায় প্রশস্ত নয়। সুতরাং ভিজিটরদের জন্য পৃথক রুম নেই। গাড়ী বারান্দার নীচে কয়েকটি চেয়ার পাতা আছে। সেখানে বসেই দেখা সাক্ষাতের কাজ চলে। দু’চারজন ভিজিটর বসে সামনে। কথোপকথনে ব্যস্ত তাদের ওয়ার্ডদের সঙ্গে। গেইটে টুলের উপর বসে দারোয়ান। এমন সময় কে একজন এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। হাতদুটি কটিদেশে স্থাপন করে মৃদু হাস্যে দন্ডায়মান এক যুবক। চকিতে বলে উঠলাম, তুমি? ইতিপূর্বে কখনও পিন্টুকে তুমি বলে সম্বোধন করিনি। সে কথা মনেও পড়লো না। ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা কুটে মরি। সমস্ত রাগ অভিমান ভাষায় প্রকাশ করি। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। অশ্রু সংবরণ করার জন্য চুপ করে রইলাম।
‘পাখির নীড়ের মত আঁখি দুটি তুলে’ বললাম, এতদিন কোথায় ছিলে?
-বাড়ি গিয়েছিলাম।
-আমাকে না বলে?
-খুব জরুরী ছিলো। মায়ের অসুখের বার্তা নিয়ে লোক এসেছিলো। তারই সঙ্গে যেতে হয়েছিল।
-আমাকে একটু খানি বলে গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো?
-একটু খানি হতো। যেদিন সন্ধ্যায় লোকটি আসে তারপরের দিন সকালে ‘দ্রুতযানে’ (রেলকারে) চড়ে ময়মনসিংহ যাই। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে আরও পাঁচক্রোশ অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের নিবাস। মায়ের আদেশ সকালের যাত্রা শুভ। দিনে দিনে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। বার বেলা- কাল বেলা। যাত্রা ভাল নয়। সে জন্য যেতে হলো। নচেৎ একদিন বিলম্বে বাড়ি পৌঁছাতে হতো।
-কি হয়েছিলো মায়ের?
-জ্বর! তাপমাত্রা একটু বেশীই উঠেছিল। তাছাড়া আমাকে দীর্ঘদিন না দেখলে তিনি অসুখে পড়েন। আমি গেলাম। পরের দিন মায়ের জ্বর ছেড়ে গেল। মায়ের মুখে হাসি ফুটলো। আসলে কি জান? বড় ছেলেকে কাছে পেলে মায়ের আনন্দের সীমা থাকেনা।
মনে পড়লো আমিও পিতা-মাতার প্রথম সন্তান। আমার জন্য তাদের মমতা সীমাহীন। তাদেরও আমার জন্য উৎকণ্ঠার অন্ত নেই।
-গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছেছি, বললো পিন্টু।
অভিযোগ মিশ্রিত স্বরে বললাম, আর আজ বিকেলে এসেছ আমার খোঁজ নিতে? আমি তো ইতিমধ্যে মরেও যেতে পারতাম।
-কেন, মরে যাবে কেন? আমি তো গত সাত দিন ধরে বেঁচে রয়েছি। আমি থাকতে তুমি মরতে পারনা।
-আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। কেন, জানি না, কিছুই জানিনা।
-তুমি আগের মতই আছ শিউলি। সেই মধুপুরের অরণ্যে প্রথম যেভাবে দেখেছিলাম, আজও ঠিক তেমনি।
এমন সময় দারোয়ান হাউজ টিউটর আপার নিকট থেকে পারমিশন নিয়ে কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আমায় ডাকছে। আপা, ‘আপনার ভিজিটর- ফেরদাউস খান’ পিছন ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে যাচ্ছি।’


 

বাইরে এসে বললাম, আমাকে নিয়ে চল কোথাও। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি যে হঠাৎ করে তুমি বলে সম্বোধন করছি, এতে পিন্টু অবাক হয়নি। যেন বরাবর আমি তাকে তুমি বলে আসছি। সত্যি, এই ছেলেটার কোন কিছুতেই কোন রকম প্রতিক্রিয়া হয়না। বড্ড সহজ, সরল আবার শক্ত বটে। কিছুতেই টলে না। উপস্থিত বুদ্ধি তার অসাধারণ।
-চল রমনা পার্কে যাই। মুক্ত বাতাসে বেড়িয়ে তোমার হয়ত ভাল লাগবে, বললো পিন্টু।
বিকেলের সোনা ঝরা রোদে রমনার সবুজ চত্বর, গাছপালা, ফুলের ঝোপঝাড় যেন খুশীতে হাসছিল। ঝিলের জলে রং বেরংয়ের মাছেরা খেলা করছিল। এসব দেখে তাপিত চিত্ত শীতল হল। কয়েক চক্কর দিলাম। প্রজাপতির পেছনে ছুটলাম। ফড়িং ধরবার প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। শান্ত, সৌম্য পিন্টু। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলো আমার ছেলে-মানুষী। আমি যে কত বড় হয়েছি সে কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।

 

রমনা রেস্টুরেন্টে বসে অনেক কথা বললাম। সন্ধ্যায় পিন্টু আমাকে ‘লেক লাক্সারীতে’ (হোস্টেলে) পৌঁছে দিয়ে গেল।

 

পরের দিন বাস স্ট্যান্ডে আবার দেখা। রোজ রোজ আসতে হবে। গত সাতদিনের অনুপস্থিতির শোধ দিতে হবে- বললাম রাগত স্বরে। -হুকুম শিরোধার্য, তবে যদি সময় পাই। আরো মজার মজার কথা বলে পিন্টু চলে গেল।
 

আমার ছিল ফার্স্ট ইয়ার, পিন্টুর ছিল এম.এ. ফাইনাল ইয়ার। ওর পড়ার খুব চাপ। আমার তো কেবল ক্লাস করা আর আনন্দ করা। আর কোন চাপ নেই। নতুন নতুন মতবাদ পড়ে অবাক হচ্ছি। এত মতবাদ আছে পৃথিবীতে! সৃষ্টি রহস্য এত জটিল, এত গভীর! সৃষ্টি কর্তাকে নিয়ে এত ভাবনা, এত আলোচনা, ভাবতে পারিনি। ভাগ্যিস আমি দর্শন শাস্ত্র পড়ি।
দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে গেলাম। লেখা-পড়ায় আমি সিরিয়াস নই। তবে পড়াশুনা ভাল লাগে। মনোযোগ দিই অধ্যয়নে। রেজাল্ট মোটামুটি ভাল। পড়ার বিষয় বড় ইনটারেসটিং। মাঝেমাঝে পিন্টুকে শোনাই নতুন নতুন মতবাদের কথা। পিন্টু বলে, ফিলসোফিকে লোকে ডেড সাবজেক্ট বলে কেন? এসব তো সকল বিদ্যার সার। সকল জ্ঞানের বুনিয়াদ, ভিত্তি। তুমি আমাকে সব চ্যাপটারের মোটামুটি ধারণা দিও। তারপর সময় পেলে পড়াশুনাও করবো।
 

পিন্টু বলে ওর বাংলা সাহিত্যের গল্প- ওর রবীন্দ্রনাথ। উর্বশী, বিজয়িনী, জীবন দেবতা, আরও কত কবিতার সারমর্ম। আমি অবাক হয়ে শুনি। আমি বলি আমার বিদ্রোহী কবি নজরুলের কথা। প্রেমের কবি, মানুষের কবি, গানের কবি, বিদ্রোহের কবি নজরুল। নজরুল গীতিও আমার প্রিয় সঙ্গীত। তন্ময় হয়ে শোনে পিন্টু।

    বড় বড় ছুটিগুলোতে বাবা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যান। পিন্টুও যায় নিজের গ্রামে। ইচ্ছা করে চিঠি লিখি। কিন্তু কিসের যেন বাধা। সেজন্য আমরা দুজনেই চিঠি লিখি। কিন্তু পোস্ট করিনা। ছুটি শেষে বদল করে নিই। মনের কথা প্রকাশ করার চমৎকার বাহন চিঠি। যেকথা কোনদিন বলা যায় না তা পত্র মাধ্যমে জানানো সহজতর হয়। যদিও আমরা কখনও সরাসরি ভালবাসা-বাসির কথা ব্যক্ত করিনি। পিন্টু কখনও শালীনতার বাইরে একটি কথাও বলেনি। তবে ঐ যে চিঠি লিখার আনন্দ, সেটাই মনের ভাব প্রকাশের ইঙ্গিত বহন করতো। রোজ ঘুমুতে যাওয়ার আগে একটি পত্র পিন্টুর উদ্দেশ্যে রচনা করা আমার দৈনন্দিন রুটিনে দাঁড়িয়ে গেল। ওদিকে পিন্টুও তাই করে। বললাম, আমরা মহাভারত রচনা করে ফেলবো। পিন্টু হেসে বললো, কাশীরাম দাসের মত তোমার আমার নাম থাকবে কোন এক ইতিহাসে।
   

পিন্টু খুব সুন্দর আবৃত্তি করে। আমিও ছন্দে ছন্দে কথা বলতে ভালবাসি। প্রথম প্রথম আমি ঢাকায় থাকতে চাইতাম না। পিন্টু সেজন্য আমাকে অনেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছে বেড়াবার জন্য। বিশেষ করে বাগানগুলোতে। বলধা গার্ডেনেও গিয়েছি কতবার। তখন মিরপুরের বোটানিকাল গার্ডেন ছিলনা। রমনা পার্ক ছিল আমাদের ঘর-বাড়ি। এসব বাগানে ঘুরতে ঘুরতে ও যে আমাকে কত কবিতা পড়ে শোনাতো, তার ইয়ত্ত্বা নেই।
   

পিন্টুর এম,এ, পরীক্ষা শেষ হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ত্যাগ করে মামার বাসায় ঠাঁই নিল। সেই সময় পরীক্ষার পর হলে অবস্থান করার নিয়ম ছিল না। সকলেই সেই নিয়ম মেনে চলতো।
 

কিছুদিনের মধ্যেই একটা চাকুরী পেল পিন্টু। সংবাদ পত্রে। সংবাদ পর্যালোচনার কাজ। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তবে সকালের দিকে সে ফ্রি থাকে। সেজন্য যেদিন সকালের দিকে আমার ক্লাস থাকতো, সেদিন সে দেখা করতে আসতো। এখন আর বাসস্ট্যান্ডে নয়, কমনরুমের সামনে। সময় কম থাকার দরুন কম কথা হতো। ওকে একটু দেখতে পেলেই যেন আমার প্রাণ শক্তি ফিরে আসে। তবে ছুটির দিনটি পুরোটাই আমরা একসঙ্গে কাটাই। লোকাল গার্জিয়ানের বাসায় যাবার নাম করে আমরা সারাবেলা টোটো করে ঘুরে বেড়াই বাগানে আর রেস্টুরেন্টে। মর্নিং শো দেখি বলাকায়। বাইরে এসে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করি। আবার সিনেমা হলে ঢুকে ম্যাটিনি শো দেখি। বিকেলে রমনা পার্কে এক চক্কর দিয়ে চা-টা খেয়ে হোস্টেলে ফিরি। পিন্টুর সঙ্গে দেখেছিলাম সেই বিখ্যাত সিনেমা ‘ব্রিজ অন দি রিভার কাওয়াই।’
-তোমার মত গার্জিয়ান না থাকলে আমার লেখাপড়া শিকেয় তুলে রাখতে হত।
পিন্টু বললো, সেটা কেমন?
-আমি তো ঢাকায় তিষ্ঠাতে পারতাম না। ছল করে বাড়ি ফিরে যেতাম। আর কখনও এমুখো হতাম না।
-খুব হতো। কারণ হোস্টেলে থাকা তো তোমার নতুন নয়। আর উচ্চ শিক্ষার বাসনা তোমার প্রবল। তাছাড়া আমার জন্য তুমি ঢাকায় আসনি। অন্য মেয়েদের মত তুমিও এতদিন আরও মন দিয়ে বিদ্যা অর্জন করতে। সম্ভবতঃ রেজাল্ট আরও ভাল হতো। এখন বরং আমার জন্য পড়তে পারছোনা ঠিকমত।
-কে বললো পড়তে পারছি না? এর চাইতে ভাল পড়া আমার কোনদিন হবে না। আমি ভাল ছাত্রী নই। কোন প্রকারে উৎরে যাওয়াই আমার লক্ষ্য। পক্ষান্তরে তোমারই খারাপ হচ্ছে আমার জন্য।
-তোমার জন্য আমার ক্ষতি হয়নি। রেজাল্ট ভালই হচ্ছে। পড়ার সময় আমি ঠিকই পড়ি। বেড়াবার সময় ঠিকই বেড়াচ্ছি।
   

আমরা যখন থার্ড ইয়ারে তখন একবার পিকনিকের আয়োজন করা হয়। আমাদের ক্লাসে দু’জন বিবাহিত মেয়ে ছিল। ওরাই উদ্যোক্তা এই বনভোজনের। আমরা কয়েকটি মেয়ে। আর আমাদের পরিচিত কয়েকজন ছেলে অন্য ডিপার্টমেন্টের। তার মধ্যে পিন্টুও একজন। সব মিলে ডজন খানেক। উদ্যোগী মেয়েদের স্বামী, বাবুর্চি ও অন্যান্য সাহায্যকারী লোকজন নিয়ে আমরা ঢাকার সমীপে চন্দ্রা নামক স্থানে অরণ্যে বনভোজনের জন্য যাই। পিকনিক স্পটটি বেশ মনোমুগ্ধকর। বনের ভিতর একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে তৈজসপত্র বের করে আমরা রান্নার কাজে সাহায্য করতে সচেষ্ট হই। ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেললো। চোখে যন্ত্রণা হল। পিন্টু বললো, চল ধোঁয়ার বাইরে একটু ঘুরে আসি। পিন্টুর তো বিপিনের আকর্ষণ আছেই। বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি আমরা। পিন্টু বললো, চল হারিয়ে যাই।

---না আর নয়। আর হারাবার অভিপ্রায় নেই। ---সেবার তো তিন মেয়ে বেশ হারিয়ে গিয়েছিলে। এবার তো আমি আছি সঙ্গে।
কথা শুনে কুণ্ঠিত বোধ করলাম। সেবার পথ হারানো যথার্থ ছিল। তোমার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। এবার? এবার আর কোন নবকুমারের দর্শন লাভের বাসনা নেই। তবে হ্যাঁ, তোমার হয়ত বা কোন কপাল কুন্ডলার দেখা দৈবাৎ মিলে যেতে পারে।
আড়চোখে পিন্টুকে দেখলাম। ও মিটি মিটি হাসছে।

---অন্য কোন কপাল কুন্ডলার এত সাহস তোমার ধার ঘেঁষে।
কথা বলতে বলতে বেশ দূরে চলে আসি। হঠাৎ আমি থমকে দাঁড়াই। এবার ফিরে চল। আর এক কদমও সামনে যাবোনা। বারে বারে ধান খেতে আসা ঘুঘুরা ফাঁদে পড়ে।
চলে এলাম আমরা বনভোজনস্থলের কাছাকাছি। এক প্রকান্ড বৃক্ষ ভূমি হতে মাত্র দু'ফুট উঁচুতে তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বড় বড় শাখা তিনটি তিনদিকে প্রসারিত। বেশ লম্বা, চওড়া, চতুর্দিকে বি¯তৃত অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, পত্র পল্লবে সজ্জিত। দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য বটে। প্রেমিক প্রেমিকার জন্য নিবিড় ছায়াবেষ্টিত কুঞ্জ তৈরী করে রেখেছে স্বয়ং প্রকৃতি দেবী। আমরা দুজনে দুটি ডালে চড়ে বসলাম। আমার শাখাটিতে কয়েকটি সরু ডাল থাকাতে আমার উপবেশনের সুবিধা হল। পিন্টুর শাখাটি আকারে চওড়া। সে অর্ধ শায়িত হলো। আশ্চর্য্য দৃশ্য। মনে হল যেন আমরা স্বর্গের উদ্যানে আদম-হাওয়া। ‘অনাদি কালের স্রোতে ভাসা, মোরা দুটি প্রাণ।’ অবারিত সুখ-শান্তি যেন সীমাহীন তন্ময়তা লাভ করেছে। আমাদের দুজনেই আনন্দের আতিশয্যে বাকরুদ্ধ! কোন বাক্য প্রষ্ফুটিত হল না কারো মুখে। ভাল লাগার ফলণ্ডধারা নিরন্তর বয়ে চললো অন্তসলিলা তটিনীর মত। এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। পিন্টুর ও তাই। নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হঠাৎ গেয়ে উঠলো পিন্টু, ধীরে লয়ে,


“সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাধা ঝুলনা,
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো, আমার মনের প্রলাপ জড়ানো....।”
 

ওর কণ্ঠ মাধুরিমায় চমকিত হলাম। এত চমৎকার গায় সে। বললাম, সুন্দর তুমি অন্তরে বাহিরে। আমার শত জনমের ভাগ্য পিন্টু! তোমাকে এমন করে পাওয়া। আমার জীবন ধন্য, মরণ ধন্য। হেসে বললাম, 'তোমার জন্য বার বার আসবো ফিরে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এই বাংলায়। মানুষের বেশে, শালিকের বেশে নয়।’
 

এবার সে অন্য বারের মত দুষ্টুমী করে উত্তর দিল না। নরম সুরে বললো, 'এ অনুভূতি তোমার কি একার শিউলি? সেই যেদিন প্রথম তোমায় দেখেছিলাম, সেদিন হতে আমারও তোমার মত ভাবনা। মনের পর্দায় সে ছবিটি আজও অম্লান হয়ে আছে। যদি দেখাতে পারতাম, দেখতে, কত যত্ন করে, কত আদরে তোমাকে সাজিয়ে রেখেছি। বিধির বিধান বিশ্বাস কর শিউলি?’
 

আমি কোন জবাব দিইনি। আগে এ বিষয়ে চিন্তা করিনি। এখন করি। বিস্ময় মানি। তোমার আমার দৈব সাক্ষাত- এমন নাটকীয় ভাবে। পিন্টু ভাবাবেগে আপ্লুত কণ্ঠে বলে, 'আমাকে মনে রাখবে তো শিউলি? আনমনে বলতে থাকে ভুলে যাবে নাতো কোনদিন? যেমন অকস্মাৎ দেখা; তেমনি একদিন হারিয়ে যাবেনা তো জীবন থেকে? তোমাকে কেন যে এমন করে পেলাম? আমার অন্তরের গভীরতম প্রদেশে কোথায় যেন একটা শংকা লুকিয়ে আছে। চির বিরহের একটি কাঁটা বিঁধে আছে। তোমায় বোঝাতে পারবোনা শিউলি, আমার এ অনুভূতি! তুমি হয়তো ভাবছো আমি একটা উন্মাদ! সাহিত্যের ছাত্র, ভাবুক প্রকৃতির। অবাস্তবকে প্রশ্রয় দিই অকারণে।’
 

পিন্টুর এত কথা শুনে আমার বুকের ভিতরে অপূর্ব আবেগের সঞ্চার হল। বেদনায় বেদনায় আমার বাসনার শিখা নীল হয়ে গেল। বললাম, ‘পিন্টু, এসব কথা থাক। আমার খুব কষ্ট হয়। হৃদয় সরোবরে উচ্ছ্বাস জাগে। সইতে পারিনা। আশার কথা বল, আনন্দের কথা বল, দুজনের জীবনের দীর্ঘ স্থিতির কথা বল। আমরা কোন অন্যায় করছিনা, পাপ করছিনা। কেন আমরা এমন স্বর্গীয় সুখ থেকে বঞ্চিত হবো?’
কথা বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে গেল। সেজন্য চুপ করে রইলাম। পিন্টুও নীরব।
খানিকক্ষণ পর পিন্টু বললো, ‘আমার একটি কথা রাখবে শিউলি?’
---কি কথা বলেই দেখ না, রাখি কিনা।
--- যদি না রাখ তবে আমার খুব কষ্ট হবে।
--- তাড়াতাড়ি বল। আমার ধৈর্য কম, জান তো?
--- শকুন্তলা পড়েছ?
--- সাহিত্যের ছাত্রী নই। তাই বলে কি এতই মূর্খ আমি যে তোমাদের কবি কালিদাসের সুপ্রসিদ্ধ ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ কাহিনী জানবো না?
এই উক্তির কোন প্রকার গুরুত্ব না দিয়ে সে বললো, আমি তোমার কাছ থেকে এমন একটা জিনিস চাই, যা আমার সঙ্গে থাকবে চিরকাল।
--- কেন, আমি থাকবোনা তোমার কাছে?
--- নিশ্চয়ই থাকবে।
--- তবে?
--- তবে আর কি? এই তো ঢাকায় গিয়ে আমরা যার যার আস্তানায় চলে যাবো। তখন?
--- আচ্ছা তখনকার জন্য একটি অভিজ্ঞান চাই, এইতো? ঠিক আছে। গ্র্যান্টেড।
আমি তখনই আমার হাতের অঙ্গুরীয়টির উপর দৃষ্টি রাখি। মা গড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার জন্মদিনে। নামের আদ্যক্ষর এস্ লেখা মীনা করা স্বর্ণের আংটি। বড় হয়ে যেন পড়তে পারি, সেজন্য বড় করে বানানো। এখনও আমার অনামিকায় বসেনা। মধ্যমায় পরিধান করি। মাকে বলি, মা, এত বড় করে এটা তৈরী করিয়েছেন যে, কোনকালেই অনামিকায় পরতে পারবোনা। আমিতো রীতিমত বড় হয়েছি। মা বলেন, স্বাস্থ্য ভাল হলে ঠিকই লাগবে। পরতে তো পারছ, এত ভাবনা কিসের?
আমি তক্ষুণি সেই অনামিকার অলংকারটি খুলে ফেললাম। খুব কারুকার্য মন্ডিত মনে হল সেটি। একটু থেমে পিন্টুকে বললাম, ‘চোখ বন্ধ করে হাত পাত।’
--- এখনই? কোথায় কি ধনরত্ন পেলে?
--- চোখ বন্ধ করতো? নয়ত উড়ে যাবে নিমেষেই।
ও চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালো। আংটিটি ওর হাতে দিলাম। ও চোখ খুললো। অবাক হয়ে বললো, এ কি? এ যে তোমার মায়ের দেয়া প্রিয় আংটি!
--- তাতে কি? প্রিয়জনকে প্রিয় জিনিসই দিতে হয়। এটাই সর্বোত্তম অভিজ্ঞান।
পিন্টু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর হেসে বললো, ‘তোমার হাত খালি দেখাচ্ছে। পরিয়ে দাও, আমার হাতে।’
--- ‘হাত বাড়াও।’ দক্ষিণ হস্ত উল্টো করে প্রসারিত করলো। আমি ওকে স্পর্শ না করে আংটিটি পরিয়ে দিলাম। মনে হলো তাতে সে একটু ক্ষুন্ন হয়েছে। তবুও খুশী হল। চোখের কোলে অশ্রুর ঝিলিক দেখা দিল। বললো, 'শকুন্তলার গল্পের মত হবে না আশা করি। ভালবাসা দুষ্মন্তদের বিলাস। তারা দিব্যি ভুলে যায়। শকুন্তলারা ভোলেনা। ভালবেসে জীবন উৎসর্গ করবার জন্য তাদের জন্ম হয়।’
 

আংটিটি ঘুরিয়ে অনামিকায় লাগালো। তারপর পুনরায় বৃক্ষ শাখায় চড়ে শায়িত হল। অন্য শাখাটিকে আমি। সহসা কোন কথা খুঁজে পেলাম না। পিন্টু নীরব। এইভাবে অতিবাহিত হল কতক্ষণ জানিনা। হঠাৎ কে যেন আমার চোখ চেপে ধরলে। দেখি তিন যুগল। তাদের একজন আমার চোখ, অন্যজন পিন্টুর চোখ চেপে ধরেছে। ভয় কাতর কণ্ঠে বললাম, ভাগ্যিস তোমরা, দস্যু তষ্কর নয়। এত ভয় পেয়েছিলাম যে, চিৎকার করে উঠেছিলাম!
ওরা বললো, তোমাদেরকে দীর্ঘক্ষণ না দেখতে পেয়ে আমরা, তোমার ভাষায়, তিন যুগল বেরিয়ে পড়ি অনুসন্ধানে। সারা বন চষে ফেললাম। তুবও তোমাদের দেখা নেই। শেষে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসছিলাম। পথে পড়লো এই প্রেমের কুঞ্জ। কৌতুহল বশতঃ ভিতরে প্রবেশ করি। শুনতে পাই মৃদু প্রেম গুঞ্জন, পাখ-পাখালীদের কূজনের সাথে ওঠা-নামা করছে দ্রুতলয়ে। সতর্ক হয়ে চলে আসি তোমাদের সমীপে। দেখতে পাই এক অপরূপ দৃশ্য। অচীন দেশের রাজপুত্র, রাজকন্যাকে নিয়ে বিশ্রাম করছে। পঙ্খীরাজ ঘোড়াটি যেন অদূরেই বাঁধা। একজন কাব্য করে বললো,


‘কপোত-কপোতি শয়ান নিম্ন বৃক্ষডালে,
বিধাতা রচিলা গীত চন্দ্রার জঙ্গলে।’


ওদেরকে কবিত্বে ভর করেছে। ওরা কাব্যিক আলাপ-প্রলাপ বকতে শুরু করে দিল। লতাগুল্মে ঘেরা এই স্থান। কত মনোহর। অপরূপ এই বৃক্ষ। বিধাতা সৃষ্টি করেছেন কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য। দেখ এর গায়ে কতজনা তাদের দুজনার নাম গাছের বাকল কেটে উৎকীর্ণ করে রেখে গিয়েছে। তাদের ভালবাসার সাক্ষী এই প্রাচীন মহীরূহ!
 

আমরা চকিতে বৃক্ষডাল হতে অবতরণ করে অধোবদনে দাঁড়ালাম। ওরা ছয় জন খিল খিল করে হেসে উঠলো। বনের পাখীরা যেন কল-কাকলী থামিয়ে ওদের হাসি শুনলো। শুষ্ক পত্র-পল্লবে মর্মর ধ্বনি উত্থিত হল। এক অনির্বচনীয় আনন্দ ধারা আমাদের সকলের আত্মাকে সুখ সিক্ত করে দিয়ে গেল।
 

স্থানটি এত সুন্দর! সবাই অন্তর্যামীর রসবোধের প্রশংসা করতে লাগলো। ওরা বললো, গল্প করে ক্ষুধা নিবারণ করা যাবে না। চল এবার, বনে ভোজন করে রসনা তৃপ্ত করি। নইলে কাব্য কাব্য ভাবটি অন্তর্হিত হয়ে যাবে। তারপর বলতে হবে, কি এত গল্প তোমাদের? আমরাও প্রেম করি। কই, তোমাদের মত এত লুকিয়ে লুকিয়ে নয়তো? তোমাদের গল্পের নিশ্চয়ই কোন বিশেষত্ব আছে, যা আমাদেরকে শোনাতেই হবে। উত্তরে পিন্টুর ঐ ভুবন ভুলানো হাসি। যা দেখলে সবার প্রাণ জুড়ায়।


        চলে এলাম পিকনিক স্পটে। সকলের স্নেহমাখা অভিযোগ, ওহে বাছাধন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমাদেরকে ফেলে আমরা তো কত কি খেয়ে ফেললাম।
আমাদের ক্লাসমেট জ্যোতির্ময়ী, যার তত্ত্বাবধানে এই পিকনিক, তার হাতের রান্না অপূর্ব! ফুল কপি সহযোগে বড় কইমাছ রান্নার স্বাদ আজও ভুলি নাই।
ভোজন শেষে ফটোগ্রাফি হল। জোড়ায় জোড়ায়, গ্রুপে, ছাগল ছানার সঙ্গে, পার্শ্ববর্তী জনপদ থেকে তামাসা দেখতে আসা বাচ্চাদের সঙ্গে। সেসব ফটো আজও আছে। স্মৃতি অম্লান। পুরানো দিনের ঘটনা সব স্পষ্ট মনে করিয়ে দেয়।
 

অপরাহ্নে পড়ন্ত বেলা। এবার ফেরার পালা। চলে এলাম ঢাকায়। এখন আমি মেইন ছাত্রী হলের (যার নাম 'উইমেন্স হল') আবাসিক ছাত্রী। হলে পৌঁছে দিয়ে গেল পিন্টু। সাথী মেয়েরা বললো, শিউলি, তোমার পিন্টু অপূর্ব। যেমন বুদ্ধি তেমন ব্যক্তিত্ব। আমাদের ক্লাসের ছেলেরা ওর ভূয়সী প্রশংসা করে। এরকম ছেলে নাকি বিরল। ওর লেখা তো আমরাও পড়ি। যেমন ভাষার সাবলীলতা তেমন দেশপ্রেম। ওতো ছদ্ম নামে লেখে। ওর নাম খদ্যোত-নিশার আঁধারে আলোক সন্নিবিষ্ট জোনাকি। আরেকজন মন্তব্য করলো, ওর লেখা মানুষের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে। তুমি খুব ভাগ্যবতী। এমন একজনের অন্তরকে স্পর্শ করতে পেরেছ।
 

পরের দিন পিন্টু বললো, চল নিউ মার্কেটে। একটি জুয়েলারি দোকানে ঢুকে আমাকে একটি অঙ্গুরীয় পছন্দ করতে বললো। আমি দেখে-শুনে এফ্ (F) লেখা একটি আংটি পছন্দ করলাম। ডিজাইনটি ভারি সুন্দর। ওটাও মীনাকরা। পিন্টু সেটি খরিদ করে নিল। বললাম, ‘পরিয়ে দাও। ‘আমি তো অচ্ছ্যুৎ- হরিজন।’ বুঝতে পারলাম আমার সেবারকার ব্যবহার সে বিস্মৃত হয়নি। শির নীচু করে হাত বাড়িয়ে দিলাম। সন্তর্পণে পরিয়ে দিল আমার ডান হাতের অনামিকায়। আমি হাতের মুঠি বন্ধ করে হাত ঘুরিয়ে আংটিটি দেখালাম। পিন্টু বললো, 'অপূর্ব! এত সুন্দর দৃশ্য আর কখনও দেখিনি। কে যে কার অলংকার সেটা গবেষণার বিষয়।’ লজ্জা পেলাম। হাত লুকিয়ে ফেললাম শাড়ীর অঞ্চলে।
 

সেই থেকে সেই অভিজ্ঞান আমার অনামিকায় শোভা পাচ্ছে। পিন্টুও কোনদিন খোলেনি আমার স্মৃতি চিহ্নটি।
 

পরের সপ্তাহের পিন্টুর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। মাকে দেখা দিয়ে আসে মাসে একবার। যেহেতু চাকুরী করে, সেহেতু সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি যায়। তাছাড়া বাকি উইক এন্ডগুলো আমরা এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। রমনা পার্ক যেন আমাদের আপন ঘর। পার্কের গাছপালা, ঘাস, লতাপাতা, ফড়িং, প্রজাপতি, সকলেই যেন আমাদের চেনে। আর রেস্টুরেন্টের লোকদের তো কথাই নেই। যদিও আজ দুই হাজার সালের রমনা পার্কের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সময়কার অবাধ বিচরণ আজ একদিনও কল্পনা করা যায়না।
        বাড়ি হতে ফিরে এসে পিন্টু বললো, ‘বাড়িতে একটি শিউলি ফুলের চারা লাগিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। চারাটি লাগিয়ে মাকে বলেছিলাম, মা, চারাটি যেন বেঁচে থাকে। যত্ন করে রাখবেন। মা আমার, শক্ত বেষ্টনী দিয়ে ছাগলের গ্রাস থেকে গাছটিকে রক্ষা করে সার পানি দিয়ে দিব্যি বড় করে তুলেছেন। ভেবেছিলাম তোমাকে বলবোনা। যখন দেখবে তখন জানতে পারবে। কিন্তু না বলে পারলাম না। কারণ তোমার গাছে ফুল ফুটেছে! প্রচুর ফুল! বাড়ির দেউরীতে অর্থাৎ গেইটের কাছেই গাছটি। তোমারই মত। লাজনম্র অথচ ঋজু অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন আমাকে কিছু কথা বলতে চায়। আমি বুঝতে পারি ওর হৃদয়ের কথা। উত্তরে বলি আমিও ভালবাসি তোমায়। তুমি আমার আত্মার পরমাত্মীয়। সত্যি শিউলি, কি যে ভাল লাগে গাছটিকে। প্রতিদিন প্রত্যুষে অজস্র ফুল পড়ে তাকে তরুণী তরুটির নীচে। দূর্বাঘাস শ্যামল ভেলভেটের ন্যায় বিছানো। তার উপর সাদা সুবাসিত পুষ্পরাশি, মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। ইচ্ছে করে তোমার জন্য মালা গাঁথি। ফুলের বৃন্ত কমলা রঙের। কবি নজরুল রঙধনু হতে লাল রং এনে প্রিয়ার পায়ে আলতা পরিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছে, শেফালী বৃন্তের কমলা রংয়ে তোমার পাদপদ্ম রঞ্জিত করি। বিব্রত বোধ করলাম। বললাম, না না, এসব কথা বলোনা। এসব কথা থাক। বেশী হয়ে যাচ্ছে।
        বাড়িতে সকলের দৃষ্টি ঐ শিউলি ফুলের দিকে। আমার বৃহৎ পরিবারের ভাই বোনেরা তোমাকে দেখেছে। তোমার কথা ওরা সবাই জানে। সকলে মিলে ঐ ফুল গাছটিকে যত্ন করে। তুমি যাবে শিউলি আমাদের বাড়ীতে?
চকিত হরিণীর মত দৃষ্টিপাত করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও আবার বললো, চল না যাই একবার। যাবে না?
--- ‘কি ভাববে লোকে?’ দুষ্টু হাসি হেসে বললো, ‘ভাববে মেয়েটির খুব বুদ্ধি। সেজন্য বিয়ে না করেও শ্বশুর বাড়ি যায়।’
দুহাতে মুখ ঢাকলাম আমি।


        সময় চলে যায় নদীর স্রোতে প্রায়। আমি এম.এ.ফাইনাল ইয়ারে। পিন্টু কয়েক দিনের ছুটি নিলো। বাবার সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার পথে ময়মনসিংহ গেলাম। গিয়ে দেখি আমার মা সেখানে আছেন। পিন্টুও হাজির। সে নাকি আমাদের সকলকে দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়িতে নদীর ওপারে সেই দশমাইল দূরে। অন্তর আমার উথাল পাথাল করে উঠলো। কি করে যাই আমি সেই অচীনপুরে। একেবারে অপরিচিতা হলে কথা ছিলনা। পিন্টুর আর আমার মেলামেশা কারো অজানা নয়। পড়লাম মহাসংকটে। চাচীকে অনুরোধ করলাম আমাকে বাসায় রেখে যাওয়ার জন্য। বাসা একেবারে খালি রেখে যাওয়া ঠিক নয়।
 

কেউ বাসায় নেই, তোমাকে কে দেখবে? তাছাড়া আমরা হয়ত বা দিনে দিনে ফেরৎ আসতে পারি। এত সংকোচের কি আছে? চল, চল আমাদের সঙ্গে। কোন ক্ষতি হবেনা তোমার। আমরা দেখে শুনে রাখবো তোমাকে।
পিন্টু আমার আশে পাশেও আসেনি। পরদিন সকালে আমরা রওনা হলাম সদলবলে। পৌঁছালাম দুপুর নাগাদ। প্রথমে ব্রহ্মপুত্র নদ। নৌকায় বিরাট নদী অতিক্রম করা। পাশে বিস্তীর্ণ কাশফুলের বন। কবিতার কথা স্মরণে আসে।

 
‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া।’
 

গরুর গাড়ি চড়ার শখ ছিল। কেন জানি না, ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে আমাদের এলাকায়, গরুর গাড়ি একেবারেই ছিলনা। সুতরাং খুশী হলাম সে সুযোগ পেয়ে। দুই জোড়া গরু দুটো গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চাকার ক্যাচর ক্যাচর শব্দ। মানুষের পায়ের চলার গতির চেয়ে অধিক গতি সম্পন্ন নয়। খুব মজা লাগছিল। দুই পাশে টিয়া রংয়ের আমন ধান দিগন্ত জোড়া। তার মাঝে টিয়া পাখিরা খেলা করছে। মন আনন্দে নেচে উঠলো। সংকোচের বিহ্বলতায় তা প্রকাশ করতে পারিনি। পাছে লোকে কিছু বলে। কারণ আমি যাচ্ছি পিন্টুদের বাড়ি। যেখানে আমার এভাবে যাওয়া শোভন নয়।
 

পিন্টুদের বাড়ি খুব বড়। গম গম করছে মানুষ। বড় আটচালা, চৌচালা ঘর। বিশাল উঠান। বার দুয়ার দীঘি। শাপলা, লাল পদ্ম ফোটে ভোরের দিকে। সব যেন ছবির মত। বাড়ির লোকজন পরিশ্রমী। সব গোছানো; পরিষ্কার। আগোছালো কিছুই নেই। ফুলের গাছ, ফলের গাছ প্রচুর। শাক-সবজি মাচায় দোল খাচ্ছে। মনে পড়লো এই নিবিড় বৃক্ষলতার পরিবেশে পিন্টুর জন্ম। সেজন্য প্রকৃতির জন্য সে গভীর টান অনুভব করে। ছোট বেলায় নাকি সে গাছপালার সঙ্গে সময় কাটাতো। বাড়ির মেয়েরা আমাকে পাশের বাড়ীতে নিয়ে গেল। এত সহজ সরল তারা। কি করে যে অন্তরের স্নেহ-মমতা আমাদেরকে দেখাবে ভেবে কূল পায়না।
 

পরদিন সেই হৈমন্তী ঊষায় পিন্টু এলো সেই শেফালী গাছটির নীচে। বাড়ির সদর দরজার পাশেই দেখি ফুল কুড়াচ্ছে ছোট ছেলের মত। ছোট্ট সাজি ভরে তুলেছে। আমাদের দেখে হেসে ফেললো। হাত বাড়িয়ে দিল ফুলের সাজি সহ। বললো, ধর, মালা গেঁথে নাও। ওর বোন ফুলগুলো নিল। এ বাড়িতে আসার পর পিন্টুর সঙ্গে এই আমার প্রথম দেখা। অতিথি আপ্যায়নের সর্বপ্রকার ব্যবস্থাপনায় সে বড়ই ব্যস্ত। পিন্টু ক্যামেরা নিয়ে এলো। ফুলের সাজি সহ নানা রকম পোজে ছবি তোলা হল। ওর বোনদের সঙ্গে ওর মাকেও ধরে নিয়ে এলো। মায়ের পাশে আমাকে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হল শিউলি গাছটির নীচে।
 

ওখান থেকে ফিরে এসে দেখি নাস্তার বিপুল আয়োজন। হরেক-রকম পিঠা পুলি, পায়েস, নারকেল, নাম নাজানা সু-স্বাদু প্রচুর খাদ্য বস্তু। সদর, অন্তঃপুরে পৃথক ব্যবস্থা। এমন সময় ক্ষেত-খামার দেখে ফিরে এলেন পিন্টুর পিতা। লম্বা, চওড়া গৌর বর্ণ রাশভারি ভদ্রলোক। পায়ে পামসু, হাতে পিতল বাঁধানো সুদৃশ্য যষ্টি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। গায়ে একটি ঘিয়া রংয়ের শাল জড়ানো। কাটছাট দাড়ি। দেখে মনে হল দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর যেন। গম্ভীর স্নেহার্দ্র কণ্ঠে আমাকেই ডাকলেন, আসতো মা, আমার কাছে আস। মাথায় হাত রেখে বললেন, আমার বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে?
 

কথা বলার শক্তি ছিলনা। ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। বললেন, সব দেখে শুনে নাও। সব তোমার। আমরা তোমার শুভাগমনের পথ চেয়ে আছি।
 

ভাবলাম এঁদের এত স্নেহ-মমতা আমি কোথায় রাখি? কেমন করে শোধ দেবো এই ভালবাসার ঋণ! মনে মনে প্রার্থনা করি, হে প্রভু, শক্তি দিও যেন সংসারের সুখ-শান্তি আমাকে ঘিরে আবর্তন করে। আমি যেন পিন্টুর উপযুক্ত জীবন সাথী হই। আমি সুখ চাই, শান্তি চাই, চাই আলোকিত জীবন-সকলের সাথে।
 

পিন্টুরা কেবল সচ্ছলই নন, আলোক প্রাপ্তও বটে। পিন্টুর পিতা ব্রিটিশ আমলে ইংলিশ মিডিয়ামে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অকস্মাৎ পিতৃবিয়োগের দরুণ লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। তারপর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে ভাই-বোনদের লেখা-পড়া, বিয়ে শাদি, ইত্যাদি পারিবারিক দায়িত্ব সম্পাদন করতে। সবার শেষে তিনি সংসারী হয়েছিলেন। সেজন্য সংসারের কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও নিজের ছেলে-মেয়েরা ছোট অর্থাৎ অন্যান্যদের তুলনায় বয়সে কম। সব ভাইদের সংসার পৃথক করে দিয়েছেন। তিনি বাড়িতে সকলের আপনজন। তাদের বৃহৎ পরিবারে এখনও কলহ-বিবাদ নেই।
 

বেলা দ্বিপ্রহরে গো-যান এসে দাঁড়ালো আঙ্গিনায়। বাড়ির বাইরে এসে সকলে বিদায় দিল আমাদেরকে। পিন্টুর মা শিউলি গাছটির নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন। যতক্ষণ আমাদের বহর তার দৃষ্টির বাইরে চলে না যায়, ততক্ষণ তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মনে মনে দোয়া পাঠ করলেন।
 

ছুটি শেষ হল আমাদের। এক শিউলি ঝরা প্রভাতে বাড়ি থেকে রওয়ানা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখনও রবিবার আসতে পাঁচদিন বাকি। দীর্ঘ সময় পিন্টুকে না দেখে আমি অধীর হলাম। অবশেষে বিরহের অবসান ঘটে রবিবার সকালে। পিন্টুর দর্শন মিললো। মনে হল কতকাল তাকে দেখিনি। জল এলো চোখে। একটু সময় নিয়ে ভিজিটারস রুমে ঢুকলাম। কোন কথা এলোনা মুখে। কারণ ওদের বাড়ির আতিথ্য আমার মর্ম মূলে নাড়া দিয়েছে। আমি এখন অন্যলোকের মানুষ। এতদিন ভবিষ্যৎ চিন্তা করিনি। এখন যেন ভবিষ্যৎ এক বিরাট দায়িত্বপূর্ণ অবয়ব ধারণ করেছে মনোভূমে। শঙ্কিত বোধ করছি। কিজানি কেমন হবে আমার সংসার জীবন সকলের মনের আশা পূরণ করতে পারবো তো?
 

একটা ব্যাপার আমার কাছে খুবই স্ট্রাইকিং লাগছে। সেটা হল, আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগতভাবে জীবন সঙ্গী পছন্দ এবং গ্রহণ করা এক গর্হিত অপরাধ। ছেলেমেয়েরা মেলামেশা করে, এরকম সংবাদ শুনে গার্জিয়ানরা মারমুখী হন। নানা অত্যাচার, অপমান আর দুর্ব্যবহার করে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। অথচ আমাদের বেলায় তেমন কিছুই দেখছিনা। আমার বাবা কিভাবে এসব ঘটনা গ্রহণ করবেন, আমার খুব চিন্তা ছিল।
কি করে যে সকলেই এসব ব্যাপার জেনেছেন এবং কেউ আমাদেরকে ধমকালেন না- এসব ভেবে অবাক হই। পিন্টুর বাবা নাকি বলেছেন, ‘আমাদের পিন্টু কোন অন্যায় অশোভন কাজ করতে পারেনা। এ বিশ্বাস আমার আছে, থাকবেও চিরকাল। সে আদর্শবান ছেলে। আদর্শের জন্য ন্যায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে।’
 

ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল। ঢাকায় থাকবার জায়গা নেই। সেজন্য বাড়ি চলে এলাম। চাচা বললেন, গ্রামে বসে না থেকে শহরে এসে একটা চাকুরী কর। স্কুলে কাজ কর। ফল বের হলে কলেজে চাকুরী নিও।
 

সানন্দে গ্রহণ করলাম চাচার প্রস্তাব। চাকুরীও পেলাম। পিন্টু এখন সপ্তাহান্তে ময়মনসিংহে আসে। একদিন থেকে চলে যায়। কখনও বাড়িতেও যায়।
এবার পূজার ছুটিতে প্ল্যান করলাম চাচীর সঙ্গে তার বোনের বাড়ি খুলনায় বেড়াতে যাবো, স্টিমারে করে। জীবনে কখনও স্টীমারে চড়া হয়নি। সকলে মিলে ঢাকায় পিন্টুর মামার বাড়ি গেলাম। তার পরের দিন সদর ঘাটে গিয়ে ‘রকেটে’ চড়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয়। সেজন্য পিন্টুর পক্ষে আমাদেরকে স্টিমারে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
বেশ কয়েকদিন বেড়িয়ে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি, কপোতাক্ষ নদ, পিকনিক স্পট, ‘কত মনোহর ধাম, কত মনোহর দৃশ্য’ দেখে ঢাকায় ফিরে এলাম। একদিন বিশ্রাম নিয়ে সদলবলে চলে এলাম ময়মনসিংহে। সেদিনই বিকেলে এসে পৌঁছালো পিন্টু। ও গিয়েছিলো বাড়িতে। রাতের ট্রেনে সে ঢাকায় যাবে। সকালে বিশ্রাম নিয়ে হাজির হবে অফিসে।
 

এক মজার গল্প শোনালো পিন্টু। যেদিন আমরা স্টিমার ঘাটে যাই, পিন্টু যেতে পারেনি আমাদের সঙ্গে। সেটা ছিল বিকেলের যাত্রা। পিন্টু সাংবাদিক অর্থাৎ সংবাদপত্রে কাজ করে। কাজের চাপ ছিল অত্যাধিক। কিজানি কি মনে হয়েছে তার। খুব দ্রুত দায়িত্ব সম্পাদন করে সে ছুটে গিয়েছিলো সদর ঘাটে। আমাকে এক নজর দেখবে বলে। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে যখন ঘাটে পৌঁছালো, তখন আমাদেরকে বহনকারী জলযান ‘রকেট’ কূল ত্যাগ করে অগ্রসরমান। সে মর্মাহত, নিরুপায়, একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে ছিল। যদি একবার আমাকে দেখা যায় কেবিনের বাতায়নপাশে। কিন্তু হায়! সব আশা বিফল হল।
 

পিন্টু বললো, ‘কেন যে আমি এভাবে গিয়েছিলাম জানিনা। কেন যে স্টিমার ধরতে না পেরে এমন কাতর হলাম, তাও জানিনা। এত ছটফট করতে লাগলাম যে, তোমাকে কি করে বোঝাবো।
--- আর বোঝাতে হবে না। তোমার আবার কষ্ট হবে।
---না বলতে দাও। আমার মনে হয়, প্রথম যেদিন তোমাকে ঢাকায় রেখে আমি বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন তোমার যেমন লেগেছিল, আমারও সেদিন তেমনই লেগেছিল।
---সদর ঘাট থেকে ফিরে এসে আর অফিসে যাইনি। রমনা পার্কে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় যাই। মামী ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে পিন্টু? খারাপ কিছু ঘটেনি তো অফিসে? বললাম, শরীর ভাল লাগছেনা। মামী অনেক যত্ন নিলেন। কারণ তিনি জানেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তাল। আর আমি এসবের সঙ্গে জড়িত।
 

সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খুব বিপদজনক। কারণ ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসাবে সরকার গঠনের অধিকার লাভ করেছে। কিন্তু ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন তার দল কোন প্রকারেই বিরোধী দলের আসনে বসবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন এম.পি. যদি পূর্ব পাকিস্তানে যায় তবে তার পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। এরকম আপোষহীন অন্যায় মনোভাবের কারণে দেশের রাজনৈতিক আকাশ তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল। দেশের ছাত্রজনতা জেগে উঠেছে, প্রতিবাদ করছে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকলকে ধৈর্য্যরে সঙ্গে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের সর্বত্র পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে।

পিন্টু সাংবাদিক। দেশের সব সংবাদ তার নখদর্পণে। রাজনৈতিক অস্থিরতার খবর তারা সবার আগেই পেয়ে যায়। কিন্তু সব সংবাদ তো ছাপাবার উপায় নেই। সাংবাদিকরা পড়েছেন উভয় সংকটে। পিন্টুর মনের উপর খুব চাপ। প্রকৃত অবস্থা খুবই গুরুতর। পিন্টু এখন আর আগের মত হাসি-খুশী নেই। গম্ভীর, অন্যমনস্ক। হাসতে যেন ভুলে গিয়েছে।
 

আমি খুলনা হতে ফিরে এসে চাচার বাসায় স্কুল খোলার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তার কিছুদিন পরই মেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বাড়ি যাই গ্রামে। শীতকালীন ছুটি। এবার যে ঢাকায় পিন্টুর সঙ্গে দেখা হল, অন্যবারের মত সে আমাকে এক গুচ্ছ চিঠি দেয়নি। ওর মন ভাল নেই। আমি তা জানি। বাড়ীতে থাকাকালীন সময়ে ডাকে একটি মাত্র চিঠি পেয়েছিলাম। চিঠিতে লিখেছে ‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে একটি কাজ করেছিলাম। কিন্তু ডাক বিভাগের যা অব্যবস্থা তাতে বিষয়টি আগেভাগেই ফাঁস করে দিতে হচ্ছে। আমি তোমাকে রিডারস্ ডাইজেস্ট এর গ্রাহক করে দিয়েছি। এটি হল তোমার জন্য আমার নিউ ইয়ারের উপহার। ভেবেছিলাম সুদৃশ্য মোড়কে প্রথম সংখ্যাটি পেলে তুমি অবাক হবে। কিন্তু জানাতে হল। তোমাদের পোস্ট-মাস্টারকে আগে-ভাগেই বলে রেখো যেন খোয়া না যায়। দেখা যাক এখন কি হয়!
 

আরেকটি কথা। তোমাদের গ্রামের একটি ছেলে চাকুরীর জন্য অফিসে এসেছিলো। হঠাৎ তোমাদের গ্রামের নামটি আমার কানে এলো। চকিতে চেয়ে দেখি সে একজন প্রার্থী। তৎক্ষনাত বললাম ঐ ছেলেটিকে চাকুরীতে বহাল করতে। তার নামও আমার জানা হয়নি। তোমাদের গ্রামের নাম শুনেই তাকে চাকুরীটা দেওয়া হল। যদিও বড় চাকুরী নয়। এখন দেখা হলেই একজন আগ্রহ ভরে সালাম দেয়। মনে হয় এটা সেই ছেলে।
 

‘সেদিন কানু কহে রাই’ নামক একটি নাটক রেডিওতে প্রচারিত হল। মনে পড়লো তোমার সেই মধুপুরের জঙ্গলে আটকে যাওয়ার কথা। নাটকটির সাথে একটি মিল খুঁজে পাই। সেদিনকার ঘটনা বার বার মনের পর্দায় ঘুরতে থাকে। খারাপ লাগছিলো খুব! কেমন খারাপ তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবোনা। মনে হচ্ছিল তুমি কোথায়, কত দূরে! কেন পাশে নেই? শিউলি, খুব ক্লান্ত আমি। আর বইতে পারছিনা যেন! তুমি কবে আসবে? আমার বাবাকে বলেছি সব ঠিক করে বিবাহের দিন তারিখ ধার্য্য করার জন্য। কারণ দেশ এক অনিবার্য দুর্গতির দিকে ধাবমান। সেজন্য তুমি আর দেরী করোনা। তুমি কাছে থাকলে সব কষ্ট, দুর্যোগ সইতে পারবো।
মার্চের প্রথম দিন আমার পছন্দ। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়। নব পত্র-পল্লবে গাছের শাখা-প্রশাখা সজ্জিত। ফুলে, কুসুমে বাগান মৌ মৌ করছে। প্রকৃতি যেন নতুন সাজ ধারণ করে অভিসারে যাবে বলে। চারিদিকে আনন্দের বান ডেকে যায়। সে রকম একটি বাসন্তী ঊষায় আমরা জেগে উঠে পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখবো। জীবনের প্রথম পদক্ষেপ, দ্বিতীয় পদক্ষেপ করে করে অনাগত ভবিষ্যতের যাত্রাপথে একে অপরের সঙ্গী হব।
        চেষ্টা করো ঢাকায় আসতে, অনেকদিন দেখা নেই তোমার সঙ্গে। আজ সারাক্ষণ একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে। কাছে থাকলে তোমাকে কতবার যেন শুনাতাম!

A bell is no bell, till you ring,
A song is no song, till you sing,
And love in thy heart is no love
Till you give it away.

আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
                                                    ইতি। পিন্টু তোমার।


এই চিঠিটি পেয়েছিলাম। পেয়েই মন-প্রাণ ছুটে গেল ঢাকায়। বাবাকে বললাম, ঢাকায় নিয়ে চলেন আমাকে। অন্ততঃ দু’দিনের জন্য হলেও। অমত করেননি তিনি। তবে তাঁর সময় ছিলনা বলে আমার ছোট ভাইকে সংগে দিয়ে আমায় ঢাকায় পাঠালেন। বলা বাহুল্য, পিন্টুর মামার বাসায়। পিন্টু অফিস থেকে বেশ রাত করে ফেরে। আমাকে দেখে চমকে উঠে। দারুণ খুশীতে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলো।

মামী হেসে বলেন, মর্ডান জামানা। রাখ-ঢাক বলে কিছু নেই। পিন্টু বললো, সবই আগের মত আছে মামী। কেবল আমাদের সময় নেই এত সব ফরমালিটি রক্ষা করবার। সময় খুব কম দেখছেন তো? বাসার সকলে হাসতে লাগলো। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হলো।
পরদিন ভোরে দেখা আবার। পিন্টু বললো, ‘তুমি এলে, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো মনে।' খুব দুঃসময় আমাদের সাংবাদিকদের। দেশের কি হবে সে চিন্তায় আমরা মুহ্যমান। ভয়ঙ্কর সময় এসেছে আমাদের সামনে। কিভাবে সমাধান আসবে জানিনা। মনে হচ্ছে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। তারপর উদাস দৃষ্টি তুলে আপনমনে বললো, পদ্মা, মেঘনা বহন করবে দেশপ্রাণ বাঙ্গালীর রুধির ধারা। থাক, ওসব কথা।

বাড়ীতে তোমার শিউলি গাছটায় কত না-জানি ফুল ফুটেছে। ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে দেখে আসি। কল্পনায় সব সময় দেখি। সবুজ মখমলের ঘাসের উপর কমলা বৃন্তে শুভ্র শেফালী হাসছে। কারো কোমল হস্তের স্পর্শের অপেক্ষায়। ও গাছটি কিন্তু তোমার। যত্ন করে রেখো, আমার মা যেমন করে রাখেন।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকালে নাস্তার পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে বলাকা সিনেমা হলে। মর্নিং শোতে দেখলাম দি ব্রিজ অন দি রিভার কাওয়াই ছবিটি। অভিভূত হলাম ছবিটি দেখে। বড় কষ্টের। এত শ্রম, এত সময়, এত ধৈর্য্যের বিনিময়ে সেতু তৈরী করা হল, তা বিশেষ প্রয়োজনে এক নিমিষেই ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হল নিজেদের হাতেই।
        সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে। লাঞ্চ করে আবার সিনেমা হলে। ম্যাটিনি শো দেখে বিকেলে গিয়ে হাজির হই রমনাপার্কে। আমাদের তীর্থস্থান। দিক বিদিক ঘুরে বেড়ালাম উদ্যানে। গাছপালা, ফুলপাতা, এমনকি রংবেরংয়ের প্রজাপতিরা, মনে হয় আমাদেরকে চিনতে পারলো। স্বাগত জানালো। আমাদেরকে ঘিরে নাচতে লাগলো।
একটি নারকেল গাছের নীচের বসবার স্থান নির্ধারণ করলাম। লেক নামটি সরোবরকে মানায়। এখানে সেরকম কিছু নয়। বরং জলাশয় বলা চলে। গভীরতা খুব কম যদিও। পানি স্বচ্ছ। মাছের দর্শন মেলে। ধীর গতিতে তারা সাঁতার কাটছে পানির নীচে। কখনও পানির উপরেও আসছে। মনোহর দৃশ্য। আমাদের পাশেই গন্ধরাজের ঝোপ। পিন্টুর পছন্দ খুব। বললাম, সাদা ফুল তোমার খুব পছন্দ দেখছি। শুধু সাদাই নয় সুবাস যুক্ত বটে।
--- শুভ্রতা, পবিত্রতার কথা বলে।
--- শুভ্রতা বিরহের কথা বলে। এত পবিত্রতা, এত শুদ্ধতা- এসব দিয়ে কি হবে?
--- কি হবে জানিনা। তবে হয় অনেক কিছুই। হৃদয়ের বন্ধন শুদ্ধ হয়, দৃঢ় হয়। আস্থা অমলিন হয়। পারস্পরিক বিশ্বাস অটুট হয়।
--- বললাম, থাক শক্ত কথা। বরং গান শোনাও। অনেকদিন তোমার গান শোনা হয়নি।
--- তুমি আমাকে গায়ক বানিয়ে ফেলবে নাকি।
--- গায়ক হওয়া খারাপ কথা নয়। আর যদি আমার জন্য হও, তবে তো আমারই গৌরব।
--- পিন্টু বললো, কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীত নয়। অন্য একটি গান। আমার ভীষণ প্রিয়। তোমারও ভাল লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। বিরহের গান।
--- বিরহের গান আমার ভাল লাগতে পারেই না। বিরহের গান অন্তরকে ভারী করে তুলে। তোমার সঙ্গে আমার দেখাই হয় না। মন সব সময় সিক্ত হয়ে থাকে। আমার যে কেমন কাটে তা তুমি ধারণাই করতে পারবেনা। আজ তুমি আনন্দের গান গাও পিন্টু! আমাকে আনন্দ দান করে ধন্য কর। অন্য কিছু নয়।
--- আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র ও গান শুরু করে। একটি হিন্দি গান। ও যেন আমার কথাগুলো শুনতে পায়নি।

 
“মেরি ইয়াদমে তুম-না, আঁসু বাহানা,
না জিকো জ্বালানা, মুঝে ভুলে যা না,...
জুদা মেরি মন্জিল, জুদা তেরি রাহে,
মিলেঙ্গি না, আব তেরি, মেরি নিগাহে
মুঝে তেরি দুনিয়াছে, হ্যায় দূর যানা
না জিকো জ্বালানা, মুঝে ভুল যানা।----
মেরি ইয়াদ মে..।”
 

গান থেমে গেল। নিষেধ অমান্য করে আমার পোড়া আঁখির কোল বেয়ে জলের জোয়ার এলো। কান্না লুকিয়ে রাখা আমার স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। উচ্ছ্বাসিত ক্রন্দন সবেগে আমার দেহমন আচ্ছন্ন করে ফেললো। পিন্টুর চোখেও অশ্রু। তবে আমার মত ভঙ্গুর নয় সে। আবেগ দমন করতে পারে। স্বভাবে শান্ত সে। মননে দৃঢ়। আর আমি? স্বভাবে চঞ্চল, ধৈর্যহীন। অবলম্বনহীন লতার ন্যায় কেবলই ভূতলে পতিত হই।
 

পিন্টু আমাকে সান্ত্বনা দেবার প্রয়াস পায়। আমার ইচ্ছে করে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদি। আমি জানি পিন্টুর ইচ্ছাও তাই। কিন্তু আমি যে শুরু করে থেকে ওর সঙ্গে এক ইঞ্চি চওড়া প্রাচীর তুলে রেখেছি। ওর আর আমার মাঝে একটু দূরত্ব রক্ষা করে চলেছি। ও আমাকে প্রায়ই বলে, আমি কি এতই অচ্ছুৎ! একেবারে হরিজন! দুয়ারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো চিরকাল? উত্তরে আমার মুখে কথা ফোটে না। রক্তিমাভায় উদ্ভাসিত হয় আমার গন্ডদেশ। পিন্টু বলে, 'অপূর্ব! একটি গালের তিলের জন্য কবি হাফিজ লিখে দিতে চেয়েছিলেন সমরখন্দ আর বুখারা নগরী। আর আমি? নাদান, অযোগ্য! এমন একটি ডালিম রাঙা কপোলের জন্য, এমন একটি লাজুক মিষ্টি হাসির জন্য, কিছুই দিতে পারিনা। আমার সাহিত্য চর্চার কোন অর্থ হয় না। কবি সাহিত্যিকদের বচন ধার করে তার প্রশস্তি গাইবো, তাও পারিনা। এক অনির্বচনীয় দৃশ্য তুমি রচনা করেছ শিউলি! আমি অভিভূত! মুগ্ধ! আমার অন্তরের না বলা বাণী তোমার অন্তরে গ্রহণ কর!
 

আর কিছুক্ষণ পর পিন্টু বললো, চল একটু ঘুরে আসি। এদিক ওদিক চক্কর দিলাম। কথা বলতে পারিনি আর। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। পিন্টু অন্য দু-একটি প্রসঙ্গ টানলো। তা স্থায়ী হলনা।
 

পার্কে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। বললাম, এ গান তুমি কোথায় পেয়েছ? কবে শিখেছ? কোনদিন তো গাওনি? এত দুঃখের, এত বিরহের গান কেন গাইলে? আনমনা হয়ে বললাম, কে লিখেছে এমন গান? অভিমানে আহত কোন এক বিরহীর হৃদয় নিংড়ানো ব্যথার বারতা! নিষ্ঠুর অবহেলার আঘাতে জর্জরিত আত্মার মর্মান্তিক ব্যাকুলতা! লেখক কত না জানি ব্যথা পেয়েছেন! যার জন্য তার কলমের ডগায় এমন বাণী এসে জড়ো হয়েছে! এ গান যে বেদনার গান, ভালবাসার গান, মমতার গান, অভিমানের গান। কে সুর আরোপ করেছেন এমন একটি গানের? তার অন্তরেও কি ভালবাসার আঘাতে ঝড় উঠেছিল? নইলে এত কান্নাভরা সুর তিনি কোথায় পেলেন? কেই বা কণ্ঠ দিলেন এমন একটি সুরে? কার গায়কীতে উদ্বেল হল শত বিরহীর আশান্ত অন্তর! এ তো কেবল গান নয়, সঙ্গীত! সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। বিরহ সঙ্গীত।
পিন্টু বললো, আমি তো এত জানি না। তবে কণ্ঠ দিয়েছেন তালাত মাহমুদ। এইটুকু জানি। বললাম, আগে কখনও শুনিনি। আর কখনও গেয়ো না এই গান। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। ভালবাসার বিচ্ছিন্নতা সহ্য করতে পারিনা আমি। কেন মানুষের জীবনে বিচ্ছেদ আসে?
পিন্টু বললো, যেখানে প্রেম থাকবে, সেখানে বিরহ থাকবে। বিরহ তো প্রেমের প্রাণ। তারপর থেমে বললো, কান্না যদি নাই পাবে, ভালবাসা তো হারিয়ে যাবে। এ গানটির জন্য আজকের বিকেলটি আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভালবাসার জন্য তোমার আজকের এই বেদনা একদিন সুখের স্মৃতি হয়ে আমাদেরকে আনন্দ দেবে।
 

রেস্টুরেন্টের বাইরে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। সেখানে বসে চা-টা খেয়ে বাসায় ফিরে এলাম। সকলে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। আগের মত আর আনন্দের গল্প নয়। ঘুরে ফিরে কেবলই দেশের পরিস্থিতির গল্প এলো।

এক সপ্তাহ থাকার কথা বলেছিলেন আমার বাবা। সকালের দিকে ঘুরে বেড়াই নানান বাগানে। জিজ্ঞেস করলাম, মধুপুরের সেই বটমূলে আর যাওনা? বললো, তুমি তো আর সেখানে নেই। কেন যাবো? কুড়িয়ে পেয়েছি মানিক-রতন, সেই বৃক্ষের তলে, হয়ত আমি সেথায় যেতাম তোমায় পাবো বলে। এটা তো আমার সৌভাগ্য। যদি না যেতাম ওখানে তবে তোমাকে পেতাম কোথায়?
--- চল আবার যাই। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে।
--- এবার তো আর পথ হারাবার ভয় নেই। আবার বললো, বছরে অন্ততঃ একবার আমরা সেখানে যাবো। ওটাই তো আমাদের তীর্থ স্থান।
পরদিন পিন্টু বিকেলেই বাসায় ফেরে। ‘অতি কষ্টে কাজ শেষ করে এলাম। আর দু’দিন বিকেলে বাসায় ফিরবো তোমার জন্য। তুমি চলে যাওয়ার পর আবার কাজে ডুব দিব।’
পার্কের রেস্টুরেন্টে চা খাবো বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। চা খেয়ে পৌঁছালাম গিয়ে আমাদের গতকালের স্থানটিতে। সবুজ ঘাসের গালিচায় উপবেশন করলাম। পিন্টু বললো, ‘আজ তোমার গান শুনবো।’
--- তোমার মত বিরহের গান আমার জানা নেই।
--- বিরহের গানইতো অন্তরকে স্পর্শ করে। 'Our sweetest songs are those, that tells us saddest thought.' যার অর্থ হচ্ছে,

‘হৃদয় বীণায় বাজে, সেই সুর সুমধুর,
দুখের সাগরে ভেসে গেছে যার সুখের মোহনপুর।।’

 

--- বাহ, খুব সুন্দর অনুবাদ করেছো তো। খুব চমৎকার। তোমার জন্য তবে একটি নজরুল গীতি গাই।


‘জনম জনম তব তরে কাঁদিব/যতই হানিবে হেলা, ততই সাধিব.......।’


পিন্টুর উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা, খুব সুন্দর, খুব সুন্দর উচ্চারিত হল।


    আরো কয়েকবার ঘুরলাম বাগানে। বললাম, চল এবার বাড়ি যাই। বললো, পাখ পাখালিরা এখনও আনন্দ মেলায় গান করছে। ওরা যখন নীড়ে ফিরবে, আমরা তখন বাসায় ফিরবো।
সপ্তাহ শেষে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার যেন প্রাণের ব্যাকুলতা খুব বেশী। এত লম্বা সময় কখনও পিন্টুর কাছাকাছি থাকিনি। বাড়ি এসে শুনলাম শীতের শেষেই বিয়ের দিন ধার্য্য হয়েছে। পয়লা মার্চ পান-চিনি অর্থাৎ এনগেজমেন্ট। বাবা বলেছেন, এ অনুষ্ঠানটি আমাদের গ্রামের বাড়িতে হবে। যাতে গ্রামের সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে। পিন্টুর বাবা বলেছিলেন আক্দ্ করিয়ে দিতে। আমার বাবা রাজি হননি। তিনি বলেন, বিয়ে আর তুলে নেওয়া একদিনে হলে ভাল হয়। সুতরাং আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
 

শীত অতীত হল। এটা ছিল ১৯৭১ সাল। সারাদেশ রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত। সকল নাগরিক যেন কিসের আশংকায় উদ্বিগ্ন। পিন্টুর সময় নেই। কি করে সে অনুষ্ঠানে আসবে সেই চিন্তা এখন সবার। অবশেষে মৌখিক ছুটি নিয়ে সে সোজা চলে এলো এলো আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আনন্দ মুখর হল আমাদের গৃহপ্রাঙ্গন। প্রচুর খানাপিনা, হাসি, আহলাদের ভিতর দিয়ে দিনটি কেটে গেল। পিন্টুর পিতা খুব সুন্দর আর দামী একটি আংটি আমাকে পরিয়ে দিলেন। আশীর্বাদ করলেন মাথায় করতল রেখে, অন্তর থেকে। সাঙ্গ হল আনন্দ মেলা। পিন্টু ঐদিনই রাতের গাড়িতে ঢাকায় চলে গেল।
 

৮ই ফাল্গুন (২১ শে ফেব্রুয়ারি) ছিল পিন্টুর জন্মদিন। জন্ম মাসে নাকি বিয়ে করতে নেই। সেরকমই একটি প্রথা প্রচলিত আছে তাদের পরিবারে। তাই পয়লা মার্চের অনুষ্ঠানে স্থির হলো ২৬শে মার্চ সবদিক থেকে উপযুক্ত দিবস, বিয়ের জন্য। সেই মোতাবেক উভয় পক্ষই বিয়ের প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করে। চাচী আমার বিয়ের তৈজস পত্র, অলংকার, শাড়ি- সব কিছু ক্রয় করেন। বাজার ঘুরে ঘুরে। শাড়ি আর গহনার জন্য আমার পছন্দের গুরুত্ব দিচ্ছিলেন বেশী। বললেন, ‘জীবনের সর্বোত্তম অনুষ্ঠান তোমার। সুতরাং আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা তোমার ভাল লাগে, তাই তুমি নাও। তোমার বাবা বলেছেন, তোমার মনে যেন কোন আক্ষেপ না থাকে।’ মনে মনে ভাবলাম, আমার বাবা এত ভাল কেন? অন্য মেয়েদের বাবা কত কড়া। হোস্টেলে দেখেছি অনেক মেয়ে আছে যারা বাঘের সামনে পড়তে পারবে, তবুও বাবার সামনে পড়তে চায়না। এত উদার মনের মানুষ আমার বাবা। আমার ছোট অনেক ভাই-বোন। আমি বড়। তাও কন্যা। তিনি তবুও আমার সুখের জন্য কোন কার্পণ্য করেন নি। নয়নযুগল আর্দ্র হল আমার। কল্পনায় পিতার বক্ষে মাথা ঠেকালাম।
 

দেশে দারুণ হৈ চৈ। রাজনৈতিক অস্থিরতা। ৭ই মার্চ রেস্ কোর্সের ময়দানে শেখ মুজিবের জনসভা। সারা শহরের লোক সকাল হতেই জড়ো হতে শুরু করে। লোকে লোকারণ্য মাঠ। তিলধারনের ঠাঁই নেই। সেই ঐতিহাসিক বিপুল সমাবেশে শেখ মুজিবর রহমান, বাঙ্গালীর দীর্ঘকালের বঞ্চনার ইতিহাস বর্ণনা করলেন। শেষে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
 

বক্তৃতার সমর্থনে লক্ষ লক্ষ জনতা যেন মন্ত্রবলে দীক্ষিত হলো। তারা মুক্তি সংগ্রামের জন্য উত্তেজিত হলো। তাদের মনোবল ছিল কঠিন ইস্পাতের মত। লক্ষ বাঙ্গালীর প্রাণ সেদিন সমুদ্রের গর্জনের ন্যায় ফুঁসে উঠেছিল, অত্যাচারী অবিবেচক পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে। সেদিন থেকে প্রতিটি বাঙ্গালী জেগে উঠে। এবং যার পক্ষে যা করা সম্ভব তাই নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এক ঐশ্বরিক শক্তিতে মানুষ বলীয়ান হয়। তাদের মনে হতে থাকে, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি, বুঝে নিবে দুর্বৃত্ত।’
 

পিন্টু ইতিমধ্যে একবার বাড়ী যায়। পথে আমার সঙ্গে দেখা করে যায় ময়মনসিংহে। বড়ই বিষণ্ণ মুখ। করুণ চেহারা। বলে, বড় দুঃসময় আমাদের মাতৃভূমির, আমাদের নাগরিকদের। যেসব খবর আমাদের কাছে আসছে, তাতে ভয়ানক রক্তক্ষয় হবে। আমি ভেবেছিলাম ও আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে। কিছুই বললো না। আমিও সে রকম কোন কথা ব্যক্ত করতে পারলাম না।
 

পিন্টুকে বিদায় দিবার জন্য ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে গেলাম। ট্রেন ছেড়ে গেল। সাথে সাথে হেঁটে গেলাম কিছুদূর। গতি বৃদ্ধি পেলো ট্রেনের। দাঁড়িয়ে রইলাম শূন্য প্ল্যাটফরমে। ডানহাত খানি উল্টে দৃষ্টিপাত করলাম দুটি অঙ্গুরীয়ের দিকে। জ্বল জ্বল করছে। খাঁটি সোনার তৈরী। একটি পিন্টুর অভিজ্ঞান। আরেকটি তার পিতার স্বীকৃতির চিহ্ন স্বরূপ। ফিরে এলাম বাসায়। অজানা আশংকায় বক্ষ দুরু দুরু।
 

শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণে সমস্ত বাঙ্গালী যেন অলৌকিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। সারা দেশে পাকিস্তান সরকারকে বর্জন করা হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে ছাত্র জনতার।
 

পূর্ব বাংলায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর দল এসে হাজির হয়েছে ঢাকায়। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। আসলে সমস্যা নিরসনের জন্য তারা ঢাকায় আসেনি। পাকিস্তানে বসে সেখানকার তথাকথিত রথী মহারথীরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বাঙ্গালীদেরকে কোন ক্রমেই ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। বাঙ্গালীরা দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ নাগরিক। সুতরাং এদেরকে নিধন করতে হবে। তার জন্য সেনাবাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদের প্রয়োজন। সেজন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, খাদ্য, অন্যান্য সামগ্রী প্রেরণের জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন। এই ‘সময়টুকু’ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কুচক্রীরা বাঙ্গালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জাতীয় পরিষদ গঠনের আলোচনার বাহানা নিয়ে ঢাকায় আসে। নির্ভিক নেতা শেখ মুজিব তা আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’
 

এদিকে বিয়ের কার্ড ছাপা হল পিন্টুর পছন্দ অনুযায়ী। শেফালী ফুলের গাছের নীচে কনে মনোরম ভঙ্গিতে বসে আছে। চারপাশে ছড়িয়ে সবুজ ঘাসের উপর সাদা শিউলি ফুল। দুই হাতে মেহেদীর কারুকাজ। চম্পক অনামিকায় থাকবে একটি আংটি।
 

দেশে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তার মাঝে বিয়ের আয়োজন চলতে লাগলো। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিয়ের লগ্ন নিটকবর্তী হল। বিয়েটা চাচার বাসায় হবে। আমি শহরে চলে এলাম ভাইবোনসহ। মা-বাবা ও অন্যান্যরা বিয়ের দিন সকালে চলে আসবে। রাস্তা খুব খারাপ। তবুও মাত্র ঘন্টা দুয়েকের জার্নি গ্রাম থেকে শহরে।
 

সেদিন পঁচিশে মার্চ সকালের ট্রেনে পিন্টু ঢাকা ত্যাগ করলো। ছুটিতে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। মৌখিক ছুটি নিয়ে সে চলে এসেছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের পরদিন যেমন করে হোক সে ঢাকায় চলে আসবে।
 

দুপুরের দিকে বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় আত্মনিমগ্ন হয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবনা কেবল আগামীকালের। জীবনের পট পরিবর্তনের দিন। পিন্টুর তরীতে নতুন দিগন্তে পাল উড়াবো। তারপর শুরু হবে অন্য এক জীবন। আমার জীবন সুখের হবে। পিন্টু খুব ভাল, আমিও মন্দ নই। পিন্টুর মত একজন পাশে থাকলে কোন দুঃখ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। হঠাৎ তন্দ্রায় চোখের পাতা মুদিত হলো। কেন যেন চোখ খুলতে হলো। দেখি সেই মধু মুখ স্মিত হাস্যে দন্ডায়মান ‘আমার আঁখির আগে’। দরজার চৌকাঠে দু’হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পিন্টু। জেগে আছি নাকি স্বপ্ন দেখছি, বুঝতে পারছিনা। উঠে বসলাম। তবুও মনে হচ্ছে পিন্টু। ভাবের বিহ্বলতায় মৃয়মান আমি। হৃদপিন্ডের আলিন্দ-নিলয়ে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হল। তবুও কথা ফুটলোনা ওষ্ঠাধরে। পিন্টু বললো, ‘চিনতে পারছনা?’
হঠাৎ লজ্জায় রক্তিম হলো আমার কপোল। সামলে নিয়ে বললাম, ‘ভিতরে আসবে, নাকি দাঁড়িয়েই থাকবে চৌকাঠ ধরে?’
--- ‘না, এখনি বাড়ি যাচ্ছি। এলাম দর্শন দিতে। পাছে তুমি ভাববে বিয়ের আসরে আমি অ্যাবসেন্ট! বাড়ি যাওয়ার পথে হাজিরা দিয়ে গেলাম। কাল আসবো ঠিকই। বলে ফিরে যেতে উদ্যত হল।’
--- ‘যাচ্ছ কোথায়? ভিতরে এসে বস, প্লিজ!’ কাছে এসে বসলো চেয়ারে। কোন কথা বলতে পারলোনা। আমিও কথা খুঁজে পাচ্ছি না। বললাম, ‘কথা বল।’
বললো, ‘কি বলবো? সব কথা এসে শেষ হল শেষে, তোমার দুখানি নয়নে....।’
এমন সময় চাচী ছুটে এলেন। ‘কই, পিন্টু নাকি কখন এলে? কেমন আছ?’ নানা প্রশ্নে ভরিয়ে তুললেন। চাচা এলেন। জানতে চাইলেন, ঢাকার খবর। ‘ঢাকার খবর খুবই খারাপ। যে কোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে তাতে সন্দেহ নেই।’ হঠাৎ সকলেই গম্ভীর হয়ে পড়লো।
চাচী জলদি করে খাবার নিয়ে এলেন পিন্টুর জন্য। তারপর বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। সেখানে সকলে তোমার পথ চেয়ে আছেন।
 

পিন্টু যাওয়ার সময় আমার দিকে কাতর দৃষ্টি হেনে মাথা দুলিয়ে, হাত তুলে বিদায় নিল। আমি আগের জায়গাতে স্থানুর মত বসে রইলাম।
 

ওদিকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো সমভিব্যাহারে আলোচনার নামে এক প্রহসন নাটকের মহড়া দিতে থাকলো। ততদিনে পশ্চিম পাকিস্তান হতে অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ এসে পৌঁছে গেছে চট্রগ্রামে। বাঙ্গালী খালাসীরা সেগুলো খালাস করতে অসম্মতি জানালো। তাসত্ত্বেও বাংলাদশে গণ হত্যার নীলনক্সা কার্যকর করবার অবস্থায় ওরা পৌঁছায়। ২৫শে মার্চ রাত্রের প্রথম প্রহরে ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো ওয়াগায়রা অতর্কিতে ঢাকা ত্যাগ করলো। যাবার পূর্ব মুহূর্তে হুকুম দিয়ে গেল সেনাবাহিনীর সর্দার জেনারেল টিক্কা খানকে, বাঙ্গালীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করবার। নাম শুনেই সম্যক উপলব্ধি করা যায় টিক্কা খান কি চিজ! তবুও এক লাইন বলতেই হয়, সে ছিল অশিক্ষিত, বর্বর। মানুষের কায়া ধারণকারী এক জন্তু। তার ভাইয়েরা বড়লোকদের কুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। নৃশংস কাজের উপযুক্ত মনে করেই তাকে সেনাবাহিনীর কর্ণধার হিসাবে নিযুক্তি দান করা হয়। সে বাংলার মাটি হাত নিয়ে বলেছিল, জওয়ানদের উদ্দেশ্যে, ‘হামে মিট্টি চাহিয়ে, আদমি নেহি।’ আমরা এদেশের ভূমি চাই, মানুষ চাইনা।
 

সুতরাং সশস্ত্র আর্মি ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো ঢাকা নগরীর ঘুমন্ত জনতার উপর। গোলাগুলির আঘাতের বিকট শব্দ শুনে জেগে উঠল নগরবাসী। কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো অনেকেই। পথে ঘাটে, হাটে-বাজারে, বাড়িতে, মসজিদে, মন্দিরে, সর্বত্র শুরু হল হত্যাযজ্ঞের তান্ডব লীলা। উন্মত্ত দৈত্য ধ্বংস লীলায় মত্ত হল। সারা শহর মৃত্যু পুরীতে পরিণত হল।
        পিন্টুর মনের অবস্থা খুব খারাপ। দারুণ ত্রাসে সে ছট ফট করছে। মধ্যরাতে শুয়ে শুয়ে সে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছে। এমন সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওর হিন্দি সমাচার কানে এলো। স্থির হয়ে শোনার চেষ্টা করল খবর। প্রধান খবর ছিলো, ‘পূর্বি বাঙ্গালমে ভারি জানি নুকসান হো রাহা হ্যায়।’ ------। সেখানকার সেনাবাহিনী নির্বিচারে নরহত্যা করছে। ঢাকার বাসা-বাড়ি, পথঘাট, রাস্তায় রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে।
        পিন্টুর কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল। লাফ দিয়ে উঠে ওর বাবাকে ডাকলো। সকলেই জেগে উঠলো। সারা বিশ্বের রেডিও স্টেশান ধরবার চেষ্টা করতে লাগলো। সব কয়টি স্টেশান ঢাকার গণহত্যার সংবাদ প্রচারে ব্যস্ত। আর কোন খবর নেই যেন। পিন্টু বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সকলে নির্বাক। নিঃশব্দে রেডিওতে কান পাতলো। কারো মুখে শব্দ নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা স্তব্ধ হয়ে রইল।
            ভোরে পিন্টুর বাবা সকলের পরামর্শ অনুযায়ী লোক পাঠালেন ময়মনসিংহ শহরে। আজ বরযাত্রী নিয়ে আসা সম্ভব নয়। অবস্থার উন্নতি হলে পরে বিয়ের দিন স্থির করা হবে। আর শহরের অবস্থা কি তা জানার জন্য লোক দুটিকে নির্দেশ দিলেন। এদিকে চাচার পাশের বাসার পরীক্ষার্থী ছেলে রাতে পড়ে আর অনুচ্চ আওয়াজে অল ইন্ডিয়া রেডিওর গান শোনে। হঠাৎ তার কানে এলো একটি সংবাদ। পূর্ব পাকিস্তানে জেনোসাইড করছে সেনাবাহিনী। আর্মি লেলিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করেছে। তার আর্ত চিৎকারে তাদের বাসার সকলে জেগে উঠলো। আমার চাচারা ও আমরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। বারবার একই সংবাদ শুনতে লাগলাম। অবস্থা খুব গুরুতর। তাই বলে গণহত্যা? রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে রাত পোহালো। সারা শহর যেন মৃতের পুরী। মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে।
            গ্রামেও মানুষের জানতে বাকী নেই। যদিও রেডিওর সংখ্যা খুব কম ছিল। আমাদের বাড়িতে ছিল একটি মাত্র। সকালের সব খবর শোনেন আমার পিতা। কোলকাতার সংবাদ শুনে তিনি চমকে উঠেন। অন্যান্যদের ডেকে খবর শোনালেন। বললেন, তোমরা সবাই বাড়িতে থাক। আমি দুতিনজন লোক নিয়ে শহরে যাই। সেখানে কি হচ্ছে দেখে আসি।
            তারা শহরে এলেন খুব ভয়ে ভয়ে। এসে শুনলেন, সব সমাচার। বললেন এমন দিনে বিয়ে হতে পারেনা। পরে ভালদিন দেখে দিনক্ষণ স্থির করা যাবে। পিন্টুদের বাড়ি হতে আগত লোকদের সঙ্গে আমার পিতার দেখা হল। বাবা বলেন দিলেন, পিন্টু যেন কোন ক্রমেই এখন ঢাকায় না যায়। পিন্টুদের লোক তৎক্ষণাত ফিরে গিয়েছিলো। বাবা আমাদের সকলকে সঙ্গে করে গ্রামে ফিরে এলেন। ঢাকায় চলতে লাগলো উন্মত্ত সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ। উল্লাসের সঙ্গে তারা মানুষ শিকারে ব্যস্ত। প্রতিদিন সকালে ওরা বেরিয়ে পড়তো শিকারে। ভোরে যারা মসজিদে যায়, কিংবা বাইরে যায়, তাদেরকে খুন করে ওই পিশাচেরা খুব আনন্দ পেতো। নাস্তার টেবিলে খুশীতে চিৎকার করে বলতো কে কতজন বাঙগালকে পর পারে দাখেল করে এসেছে।
কেঁদে কেঁদে এক সময় চোখের জল শুকিয়ে গেল আমার। দেখলাম কান্না আমার নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য। দেশের জন্য। আত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। মনে পড়লো প্রিয় নেতা শেখ মুজিবরের বজ্রকণ্ঠের গর্জন। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ সারা দেশবাসী আমারই মত একই মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলো।
            কোলকাতা, বিবিসির সংবাদে শুনে গা শিউরে উঠে। খবর ভয়াবহ। শতাব্দীর শেষভাগে এসে, সভ্যতার চরম উৎকর্ষের সময়, এমন বর্বরতা কল্পনা করা যায় না। এই বর্বরগুলো আবার নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে গর্ব বোধ করে।
            আক্রমণের আতংক কাটিয়ে উঠে কয়েকদিনের মধ্যে পিন্টু পালিয়ে যায় ঢাকায়। খুব সন্তর্পণে পথ চলে। ঢাকা যেন এক মৃত নগরী। প্রাণের স্পন্দন নেই। আর্মির গাড়ির আর মারণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর শব্দ ব্যতীত আর কোন শব্দ নেই। পিন্টু পৌঁছালো মামার বাসায়। তখন সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র। বাসার বারান্দায় উঠে কড়া নাড়ে প্রচন্ড উত্তেজনায়। চারিদিক সুনসান। কোথাও জনমানবের শব্দ নেই। দরজা খুলতে এলোনা কেউ। হঠাৎ লক্ষ্য করে দুটি তালা ঝুলছে একই কড়ায়। বুকটা কেঁপে উঠলো। কোথায় গেলেন তাঁরা? নাকি ধরে নিয়ে গিয়েছে সিপাইরা? দরজায় মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো পিন্টু। সহসা মনে হল এখানে থাকা ঠিক নয়। এমন সময় গাড়ির চাকার ঘরঘর আওয়াজ শুনে সে একলাফে বাসার পিছন দিকে ছুটে গেলো। সেখানে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে এলো। অন্ধকারে কে যেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। পিন্টু চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘মামা?’ মামা তাকে জড়িয়ে ধরলেন। টেনে নিয়ে গেলেন ঘরে। নি¯প্রদীপ গৃহ। সকলেই উদগত অশ্র“ দমনে ব্যস্ত। ‘কি করে বাঁচবো পথ খুঁজে পাচ্ছিনা।’ তাদের বাড়িওয়ালা পাশের বাড়িতে থাকেন। তাকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। বাড়ির অন্যান্যরা দরজায় তালা দিয়ে সম্ভবতঃ গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে। সেটা তাদের নিজের গ্রাম নয়। অন্যপাশের বাসার মালিকের ভাই এ পর্যন্ত বাসায় ফেরেনি। বড় ছেলেরা বাড়ি ছেড়েছে ইতিমধ্যে। ওরা বাড়ি যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায়।
            পিন্টু বললো, ‘কালই বেরিয়ে পড়তে হবে। আর্মির হুকুমে ট্রেন চলছে। বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। রাতটা যদি বেঁচে যাই তবে কালই সকালে বেরিয়ে পড়বো। কিছু জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিন’।
            তারা বললেন, ‘অল্প-স্বল্প সবই গুছানো আছে।’ পরদিন ওরা বেরিয়ে পড়লো। সাবধানে চলে গেল স্টেশনে। তারপর ট্রেনে ময়মনসিংহ চলে এলো। মেয়েরা সব বোরখা পুরুষরা সব সাধারণ পোশাকে। দীনহীন বেশে গিয়ে পৌঁছালো একেবারে গ্রামের বাড়িতে। যাওয়ার পথে চাচার বাসায় ঢুঁ মেরে গেল পিন্টু। বলে গেল ওরা সকলে ভাল আছেন। চাচারা যেন শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান।
বিপদ ছিল তাদের বেশী যারা চাকুরী করেন। অফিসে অনুপস্থিত থাকলে শুধু চাকুরীই যাবে না আরো বহুবিধ বিপদের সম্ভাবনা আছে।
            পিন্টুর গ্রামের যাওয়ার সংবাদ শুনে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। ঢাকায় সে অন্যান্য সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছে। অনেককে পায়নি। যাদের পেয়েছে তারা প্রাণটা হাতে নিয়ে কাজকর্ম চালাচ্ছে। প্রকৃত সংবাদ ছাপাতে দিচ্ছে না। সংবাদের জগৎ সম্পূর্ণ সেনা সদরের নিয়ন্ত্রণাধীন।
            এভাবে কেটে গেল এপ্রিল মাস। মার খেয়ে খেয়ে বাঙ্গালী জাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। সব যুবক তরুণ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেলো। কারণ দেশে থাকলে তারা কেউ বাঁচতে পারবে না। ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে। সুতরাং দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করাই শ্রেয় বলে তারা মনে করছে।
            এরকম একদিন সন্ধ্যায় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। পিন্টু এসে হাজির আমাদের গ্রামের বাড়িতে। পিন্টু এসেছে শুনে বুকের পাষাণ ভার নেমে গেল। ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দে লাফিয়ে উঠলো হৃৎপিন্ড। পিন্টু ঘরে ঢুকলো ঝড়ের বেগে। ওকে দেখে আমি চিনতেই পারলাম না। মাথা ভর্তি লম্বা চুল, অবিন্যস্ত। শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি উ™£ান্ত। কোমরে চওড়া বেল্ট। সাধারণ প্যান্ট, শার্ট। এ যেন আমাদের পিন্টু নয়, অন্য কেউ। তাকিয়ে রইলাম অবাক দৃষ্টি মেলে। সকলে তাকে ঘিরে ধরেছে। নানা প্রশ্ন করছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, এতদিন কোথায় ছিলে? স্থির দৃষ্টি হেনে তাকিলে রইল সে। উত্তর পেয়ে গেলাম মনে মনে। পিন্টু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এতক্ষণে ওর চেহারা, বেশ ভূষার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হল। পিন্টু সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বললো, আমি যে আপনাদের বাড়িতে এসেছি, এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে। আপনাদের ভয়ানক বিপদ হবে। ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবেন না যেন।
            তারপর সে যা বিবৃত করলো তার সারমর্ম হল সে এপ্রিল মাসেই যুদ্ধে গিয়েছে। ট্রেনিং নিয়েছে ভারতে। ফিরে এসেছে দেশের অভ্যন্তরে। কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছে। ক্ষয়ক্ষতি সহ সাফল্য অর্জন করেছে বলা যায়। তবে যুদ্ধের বর্ণনা যা দিল তা ভয়ঙ্কর। সঙ্গীরা কয়েকজন শেষ ইতিমধ্যে। ভয়ে ত্রাসে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিভাবে তরুণ যোদ্ধারা দেশকে বাঁচাবার জন্য অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ দিচ্ছে, তার বিবরণ শুনে আমরা স্তব্ধ হলাম।
            'বাড়ি গিয়েছিলাম। মা বাবার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। মা বললেন, তুমি আমার একমাত্র পুত্র! উত্তর দিতে পারিনি। মনে মনে বললাম, যাদের একাধিক পুত্র আছে তাদের মাতৃস্নেহ সমান ধারায় প্রবাহিত। আপনাদের সঙ্গে দেখা করে গেলাম। জানিনা যুদ্ধ কতদিন চলবে! মাতৃভূমিকে মুক্ত না করে ছাড়বোনা। আমরা আশাবাদী। আপনারা খুব সতর্ক থাকবেন। সুযোগ পেলে আবার কখনও আসবো।’
            ততক্ষণে আহার্য দ্রব্যাদি তৈরী করা হল পিন্টুর জন্য। মনে হয় খুব ক্ষুধার্ত ছিল সে। খাদ্য গ্রহণ করলো তৃপ্তির সঙ্গে। আমি যেন কেমন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। খাবার শেষে সে আমার ঘরে ঢুকলো। চেয়ারে উপবেশন করলো। হারিকেনের আলো এসে পড়লো ওর মুখে। পিন্টুর এই রূপ দেখে কেবলই আশ্চর্য হলাম। বললাম, কিছু একটা বল। বললো, কি বলবো? সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। মানুষ কেন যুদ্ধ করে আগে জানতাম না। এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। আমি যুদ্ধে গিয়েছি বলে খুশী হওনি, শিউলি? উত্তর এলোনা মুখে। তোমার খুশী হওয়া উচিত। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত স্ত্রী। শুনে কেঁপে উঠলাম, উদগত অশ্রু ঠেলে দিলাম পশ্চাতে। বললো, তোমার কথাই ঠিক। বিয়ের দিন কেমন অ্যাবসেন্ট হয়ে গেলাম। বিধির বিধান। নিরুপায় হয়ে তা করতে হল। আর এমনটি হবে না। ফিরে এসে তোমার কাছেই প্রথম আসবো। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তোমার কাছেই থাকবো। হেসে বললো, না হলে মধুবনের সেই ভয়ঙ্কর জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে?
            পিন্টু আমার সামনে পালংকের উপর এসে বসলো। বললো, যাবার সময় হল। এবার বিদায় দাও। এই বলে দু'হাত আমার স্কন্ধে রেখে কপালে কপাল ঠেকালো। এই প্রথম পিন্টু আমাকে স্পর্শ করলো। আবেগের বিহ্বলতায় বিভোর আমি। কপালে কপাল ঘর্ষণ করে বললো, আসলে বিদায় নিতে আসিনি। এসেছি তোমাকে দেখতে। আবার আসবো। তোমার চুম্বকের আকর্ষণ ত্যাগ করে বেশী দূরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি যে আমার অয়স্কান্ত মনি। বার বার এসে দেশের ভেতরে লড়াই করবো, যাতে স্বাধীনতা লাভের পর তোমার কাছে আসতে বিলম্ব না হয়।
            তুমি এবং তোমরা নিরাপদ থেকো। সদা সতর্ক থেকো। আর প্রার্থনা করো যেন আমরা শীগগীরই জয়ী হই। সময় নেই শিউলি। এবার যেতে দাও। পরম মমতায় ও আমাকে আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করে। এবার অশ্রুর বাঁধ ভাঙ্গলো আমার। পিন্টুর বুকে মুখ রেখে প্রবল কান্নায় আমার হৃদয় উদ্বেলিত হলো। জানিনা কত সময় এভাবে অতিক্রান্ত হল। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন ও বললো, এবার যেতে দাও। ধীরে ধীরে ওর হাতের বাঁধন শিথিল হল। আমাকে বসালো পালঙ্কের উপর। মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল। আমি তবুও ওকে আঁকড়ে ধরে রাখলাম। ও আমার ললাটে একটি স্বর্গীয় চুম্বন এঁকে দিয়ে এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘরে সকলেই বসে বিমর্ষ বদনে। পিন্টুকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো। পিন্টু বললো, আপনারা চোখ-কান খোলা রাখবেন। আমাকে এখন বিদায় দেবার জন্য দেউড়ীর বাইরে আসবেন না। কেউ যেন জানতে না পারে আমি এখানে এসেছিলাম। ঝড়ের বেগে সে গভীর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
            আতংক আর অনিশ্চয়তা নিমেষেই আমাদেরকে গ্রাস করলো। একটি নিশাচর প্যাঁচা কর্কশ স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। আমার মগ্ন চৈতন্যে অশুভ পেচকের ব্যঙ্গধ্বনি সর্বনাশের সংকেত দিল। আমি যেন আকুল পাথারে পথ হারালাম।

 


        সে বার ভারি বর্ষণ হয়েছিলো। তাতে মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। বর্ষা শেষ হল। প্রকৃতি আবার শুষ্করূপ ধারণ করলো। পিন্টু এবার ময়মনসিংহ অঞ্চলে এলো। ও এসব এলাকাতে অপারেশন চালিয়েছে অধিক। ওর ভিতরে যে এক যোদ্ধা ছিল তা আগে কল্পনা করাও দুরূহ ছিল।
 

চাচীরা স্বপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়িতেই। চাচা ছিলেন শহরে। কারণ তাকে চাকুরী রক্ষা করতে হবে। একদিন চাচা এলেন বাড়িতে। সেটা অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। লুকিয়ে একটি চিঠি আমার হাতে দিলেন। খোলা চিঠি ভাঁজ করা। মলিন দুমড়ানো কাগজে লেখা। এ যে, পিন্টুর হাতের লেখা। পড়ন্ত বিকেলে উঠোনের এক কোণে মোড়ায় বসে পড়তে শুরু করলাম। সম্বোধন ব্যতিরেকেই আরম্ভ। তবে সম্ভাষণের স্থানে কয়েটি শিউলি ফুলের ছবি আঁকা। কোন জায়গার বা নামের উল্লেখ নেই চিঠিতে।

 ---সেই ছায়াবীথি তলে যেখানে তোমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত ঘটেছিল আমার, সেখানে শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবছি। সেই বৃক্ষটির শিকড়ে মাথা রেখে শুয়ে আছি, আমরা বেশ ক’জনা। শুষ্ক পত্র-পল্লবে ঢাকা বিছানা। এপাশে ওপাশে মর্মর ধ্বনি তুলছে। সারাদিন অভুক্ত। কয়েকদিন ঘুম নেই। এ জায়গাটি জনপদ থেকে অনেক দূরে। তবে শ্বাপদ সংকুল নয়। সেজন্য একটু সুখ নিদ্রার প্রত্যাশায় এই অরণ্যে এসেছি। আসলে কেন এসেছি জানতো? এ যে আমার তীর্থস্থান। আর কোনদিন এখানে আসতে পারবো কিনা জানিনা। মাথার নীচে হাত রেখে শুয়ে বনানীর আচ্ছাদন ভেদ করে দেখা যাচ্ছে আকাশ। তারা ফুটে রয়েছে যেন কালো সামিয়ানার গায়ে। ঐ তারকাদের মধ্যে যেন আমাদের সঙ্গীদের কারো কারো জ্যোতির্ময় মুখ দেখতে পাচ্ছি। ওদের কত কথা কানে তরঙ্গায়িত হচ্ছে। থাক ওসব কথা। অন্ধকার গাঢ় হলে আমরা, ঐ যে, তোমাকে পথ প্রদর্শনের জন্য, যারা (আদিবাসীরা) আমাকে সহায়তা করেছিলো, তাদের পল্লীতে যাবো। সেখানে খাবার খেয়ে আবার এই আস্তানায় ফিরে এসে বিশ্রাম নেবো। তারপর রাত তিনটায় এখান থেকে চলে যাব।
        দেশের মানুষের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। অতি ক্ষিপ্র গতিতে তারা আমাদের খাবার প্রস্তুত করে দেয়। আবার দ্রুতগতিতে বিদায় করে, পাছে আমাদের কোন বিপদ না ঘটে। সঙ্গে দিয়ে দেয় শুকনো খাদ্য বস্তু, টাকা পয়সা!
        জানিনা কাল কোথায় থাকবো। আজকের মত অবসর কখনও পাইনি। টর্চের আলোয় তোমাকে লিখছি। আমি দেখতে পাচ্ছি মনশ্চক্ষে আমার মা নিষ্পলক নেত্রে অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছেন। তার খোকা কবে ফিরবে? তার খোকার চিন্তায় তার দুচোখের পাতা এক হয় না। তেমনি তোমারও কাটে বিনিদ্র প্রহর। তোমার প্রতীক্ষা যে কবে শেষ হবে কে জানে!
        যদি ফিরে আসি, আবার গান হবে, কবিতা হবে। বিরহের গান আর হবে না। ‘জনম জনম তব তরে কাঁদিব’ --- তুমি আর গাইবে না। ‘মেরি ইয়াদ মে তুম-না আঁসু বাহানা’ আমিও আর গাইবোনা। এর পর গাওয়া হবে কেবল মুক্তির গান, আনন্দের গান, বিজয়ের গান। স্বাধীনতার জন্য যারা দিয়ে গেল প্রাণ-তাদের জয়গান গাইবো চিরকাল। মুক্তিযোদ্ধারা কি করেছে, কি ভাবে করেছে, কি খেয়েছে, কোথায় শুয়েছে-সব, দেশের মানুষকে জানাতে হবে। জীবনকে তুচ্ছ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। দেশকে ভালবেসে, মানুষকে ভালবেসে তারা অসাধ্য সাধন করেছে। কত ঝড়ে জলে ভিজেছে তারা। দিনের পর দিন সেই ভিজে কাপড় তাদের শরীরে শুকিয়েছে। এক পোশাকে তারা কতদিন কাটিয়েছে তারা নিজেও তা জানে না। কত পোকা মাকড়, জোঁকের কামড়ে কত রক্ত ঝরেছে তার খোঁজ কেউ রাখতে পারেনি। আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি সব লিপিবদ্ধ করবো একদিন। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা আমার লেখা থেকে সত্য ঘটনা জানতে পারবে। তারা গর্ববোধ করবে যে তাদের পিতা, পিত্রৃপুরুষেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের অমূল্য প্রাণ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। রক্তাক্ত প্রান্তর পার হয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়ের মালা, সেই নরঘাতকদের থাবা থেকে।
            জীবনের সবকিছু আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। স্টেনগান এখন আমাদের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। খুব আশা যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। সেদিন অস্ত্র ফেলে দিয়ে তোমার হাত ধরবো। ধরে থাকবো চিরকাল।
            দুটি উঁচু শিকড়ের মাঝখানে উপুড় হয়ে শুয়ে টর্চের আলোতে তোমায় লিখছি। কাগজ-কলম যোগাড় করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। লেখার সময় পাইনি। জানিনা, এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে কিনা। হয়ত এ আমার ব্যর্থ প্রয়াস। তুমি ভাল থেকো। অনন্ত ভালবাসাসহ একমুঠো শেফালী ফুলের অঞ্জলি গ্রহণ কর। আর সকলের জন্য গভীর মমতা রেখে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। প্রার্থনা করো যেন আবার ফিরে আসি তোমাদের কাছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সেই দিনটির জন্য।’
পত্রের অন্তে কারো নাম নেই। তিনটি তারকা চিহ্ন আঁকা।

       

        আমার যে কি হয়েছে আজকাল। কথায় কথায় ফেইন্ট হয়ে যাই। মনের বল বৃদ্ধির জন্য প্রতিজ্ঞা করি কত! মনে মনে ভাবি পিন্টু মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। সে আমার কত বড় অহংকার! পরমুহূর্তে আমার অন্তরাত্মা হাহাকার করে ওঠে। প্রদীপের আলোর নীচের অন্ধকারটাকুই চোখে পড়ে। তবুও আশায় বুক বাঁধি। হয়ত পিন্টু ফিরে আসবে একদিন।

সময় চলে যায় মারাত্মক বিপদ আর প্রাণহানির ভেতর দিয়ে। ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একটি দেশ কোন দুর্দান্ত শক্তিশালী দুষ্ট শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হওয়া এত সহজ নয়। তার জন্য কি মূল্য দিতে হয়েছে তা প্রতিটি নাগরিক কম-বেশী জানি।

        দেখতে দেখতে চলে এলো বিজয়ের পরম মুহূর্ত। সারা দেশ বিষাদের মধ্যেও, প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর। রুদ্ধদ্বার খুলে সকলে বাইরে এলো। প্রাণভরে শ্বাস নিলো। তারপর সন্ধান করতে লাগলো তাদের পিতার, পুত্রের, ভ্রাতার। উন্মাদের মত তালাশ করতে লাগলো তাদের বধু, জায়া, ভগ্নি ও কন্যার। কেউ পেল তাদের সন্ধান। কেউ পায়নি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো প্রিয়জনদের ঘরে ফেরার জন্য। অপেক্ষার কোন শেষ নেই। দিন গত হতে লাগলো। অনেকের মত পিন্টুও বাড়ীর দেউড়ী পেরিয়ে উঠানো এসে দাঁড়ালো না। বললো না, এই যে দেখ আমি এসেছি। তবুও, আশা কুহুকিনী। আশা বললো, ধৈর্য ধর। দূরের পথ। আসবে একদিন। হয়ত কোন নাম না জানা চিকিৎসালয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। নয় কোন কয়েদখানায় বন্দী হয়ে আছে। নিরাশ হয়ো না। সে একদিন আসবেই আসবে। সে না এসে পারে না। সে যে পিন্টু! শিউলির ব্যাকুল আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি।

কিন্তু হায়! আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়! তাই ভাবি মনে। হঠাৎ আমার মনে পড়লো আনন্দমোহন কলেজের কয়েকজন ছাত্র ওর সঙ্গে ছিল ভারতের ক্যাম্পে। একসঙ্গে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে। আমি তাদের একজনের সন্ধানে লোক পাঠালাম। কয়েকদিন পর সে অনেক তথ্য নিয়ে ফিরে এলো। ময়মনিসংহের উপকণ্ঠে এক গ্রামে তার বাড়ি। যুদ্ধে একটি পা অকেজো হয়ে পড়েছে। সেজন্য দেশে ফিরতে তার অনেক সময় লেগেছে। সরকার তাকে পূর্ব জার্মানিতে পাঠাবে উন্নততর চিকিৎসার জন্য। সে জানালো পিন্টুর সঙ্গে তার দেখা গত নভেম্বরের মাঝামাঝি। একসঙ্গে একটি অপারেশনে লিপ্ত হয়েছিল জামালপুরের বর্ডারে। তারা জয়ী হয়েছিল সেই লড়াইয়ে। তবে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল যথেষ্ট। তার পায়ে গুলি লাগে। যারা পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে পিন্টুও তাদের মধ্যে একজন। পিন্টুরা তাকে বহন করতে ভারতে নিয়ে যায়। নয়ত আজকে তার বেঁচে থাকার কথা নয়। সে যুদ্ধাহত ছিল বলে পরবর্তী আক্রমণে অংশ নিতে পারেনি। সেই আক্রমণের পুরোভাগে ছিল পিন্টু। সে ছিল অকুতোভয়, অসম সাহসী! সেই অপারেশনে ভীষণ যুদ্ধ হয়। পাঞ্জাবী মিলিটারিদের বিপুল প্রাণহানি ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতি হয়েছিল যথেষ্ট। পিন্টু আর ফেরেনি। সে খবর সে পেয়েছিল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ওদের দলের একজন বেঁচে আছে। পিন্টুর শেষ খবর ওর কাছে থেকেই পাওয়া। এই ছেলেটি পিন্টুকে নাম ধরেই চিনতো। আর পিন্টু যে এর পরিচিত তাও জানতো।

        কয়েকমাস পরের কথা। আমার চাচা আমাকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন। আমার মানসিক ভারসাম্য ছিল না। শূন্য দৃষ্টি মেলে কেবল পিন্টুকে নয়ন সমুখে দেখার বাসনায় আমার চিত্ত বৈকল্য দেখা দেয়। আহার নেই, নিদ্রা নেই,। জীবিত না মৃত, সেই বোধ রহিত আমি।

        এভাবে নাকি কেটেছিল আমার অনেক রজনী, অনেক প্রভাত। শহরের মনোবিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, প্রচন্ড শকে রোগী বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। ধৈর্যের সঙ্গে চিকিৎসা ও সেবা তাকে পুনরুদ্ধার করতে পারে। পিন্টুর স্মৃতিগুলো থেকে তাকে দূরে রাখতে হবে। আনন্দের পরিবেশে তাকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

        আমার আত্মীয়-স্বজনেরা খুব মমতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমাকে মানসিক চিকিৎসা এবং ভাল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমার বিকল হয়ে যাওয়া মনটাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আস্তে আস্তে আমার মুখে হাসি ফোঁটে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হই। বহুদিন আমি হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। কান্নাও ছিল না চোখে, যে আমি কথায় কথায় চোখের পানিতে বুক ভাসাতাম। পিন্টু প্রায়ই বলতো, ‘ওগো কন্যা, তোমার দুচোখে কেন বন্যা? জবাবে মুখ ঢাকতাম শাড়ীর আঁচলে। মাস ছয়েক পর আমি বেশ কথাবার্তা বলতে শুরু করি। তারপর পোশাক-আশাকের কথা মনে পড়লো। চাচাতো বোনেরা প্রতিদিন নব নব সাজে সাজিয়ে দিতো। কপালে টিপ পরিয়ে দিত। টিপ আমার পছন্দ ছিল না। ওটা সাথে সাথে মুছে ফেলতাম। তবুও বলতে পারতাম না যে টিপ দিও না। ওরা বুঝে গিয়েছিলো। ছোটদের গল্পের বই ধারে কাছেই ফেলে রাখতো। মাঝে মাঝে তুলে নিয়ে পড়তাম। এভাবে খবরের কাগজও পড়তে শুরু করেছিলাম। প্রথম প্রথম অর্থ মাথায় ঢুকতো না। পরের দিকে বুঝতে শিখেছিলাম। এভাবে ধীরে ধীরে খাওয়া, শোওয়া, অন্যান্য দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো আয়ত্তে আসে। সুস্থ হতে আমার পুরো একবছর অতিক্রান্ত হল।

        আমি সব কিছু ত্যাগ করেছিলাম। ত্যাগ করিনি কেবল পিন্টুর দেওয়া স্মৃতি --- সেই আংটি যাতে পিন্টুর নামের আদ্যক্ষর মিনা করে লেখা রয়েছে। যখন ঘোর বিস্মৃতিতে তখনও নাকি ঐ অঙ্গুরীয় হাত থেকে খুলতে পারেনি। খুলবে কেমন করে? সে যে আমার পিন্টুর অভিজ্ঞান।

 

        ৭৩ সালের মাঝামাঝি আমি একটি স্কুলে চাকুরী গ্রহণ করি। স্কুলটি শিশুদের জন্য। কয়েকদিনেই বেশ ভাল লাগলো। বাচ্চাদের ইনোসেন্ট মুখগুলো দেখে মন খুশীতে ভরে গেল। তাদেরকে উৎসাহের সাথে শিক্ষাদানের কাজে লেগে গেলাম। তাদের সঙ্গে খেলাধুলায়ও আনন্দ পেতাম। নবজাগরণের ছোঁয়ায় আমি সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠলাম। সকলের মনের ভার লাঘব হল। এই স্কুলের পাশেই হাই স্কুলে চাচা চাকুরির বন্দোবস্ত করে দিলেন। ডাক্তার বললেন, আমি নাকি আরোগ্য লাভ করেছি, বলা যায়।

একদিন পিন্টুর পিতা এলেন আমাকে দেখতে। আগেও নাকি তিনি এবং আরো অনেকে আমাকে দেখতে এসেছেন। আমার স্মরণ নেই। তাঁকে দেখে খুশী হলাম। মনে হলো কোথায় যেন পিন্টুর চেহারার সাথে মিল রয়েছে। আমি তখন বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছি। আগের মতো কান্নাকাটি করি না। তিনি বললেন, ‘চল পিন্টুর মাকে দেখবে। জবাবে বললাম, পূজোর ছুটিতে আসবো।

        গিয়েছিলাম সেবার আশ্বিনে। বাড়ির ফটকে সেই শিউলি গাছটি স্মিতমুখে ফুল সাজিয়ে অভিবাদন জানালো। তরুটির পাদদেশে সেই শ্যামল দুর্বাদল সবুজ মখমলের বিছানা তৈরী করে রেখেছে। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের পাটাতন সরিয়ে। মা কাঁদলেন, আমাকে জড়িয়ে ধরে। সকলে তাকে বারণ করলেন, পাছে আমার আবার যদি কিছু হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি, আমার আর কিছু হবে না। নিয়তি আমাকে আগুনে পুড়ে অন্য ছাঁচে ঢেলে দিয়েছে। আমি এখন অন্য কেউ।

        পরদিন প্রত্যুষে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই শিউলি তলায়। মনে হল পিন্টু এখানে দাঁড়িয়ে। শিশির ভেজা ঘাসে পা রাখলাম। মৃদু শীতল হাওয়া আমার অঙ্গ ঘিরে রাখলো। মনে হলো এ যেন তারই পরশ! সে যেন এখানেই আছে। কতক্ষণ যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম গাছটিকে জড়িয়ে ধরে জানি না। পিন্টুর বোন রিনা, মিনারা এসে আমাকে ঘরে নিয়ে গেল।

        পিন্টুর মা পিন্টুর বিয়ের গহনা বাক্সে বন্ধ করে রেখেছিলেন। বের করে পরালেন আমাকে। বাধা দিইনি। বললেন, ‘এগুলো তোমার। নিয়ে যাও। কিছু বলিনি। পরদিন ফিরে আসার সময় সব গুছিয়ে রেখে দিলাম সেই বাক্সে। রিনা-মিনাকে দিয়ে গেলাম’ --- বললাম ¯œহময়ী সেই মাকে। ওরা আমারও বোন। ওদের কাছে থাকলে আমি খুব খুশী হব।

        বছর দুয়েক স্কুলে চাকুরী করে কলেজে চাকুরী নিলাম। বদলি হলাম সাতক্ষীরায় --- মেয়েদের কলেজে। আমার আর কাছে--দূরের ব্যাপার নেই। চলে গেলাম কর্মস্থলে। দেখলাম, আবহমান বাংলার চিরপরিচিত রূপ। মাঠ-ঘাট, মানুষজন সব যেন চেনা। মনোনিবেশ করলাম মানুষ গড়ার কাজে। বিশেষ করে মেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আমার ছিল। চাকুরী সুবাদে বাংলাদেশের সকল জেলায় আমাকে যেতে হয়েছে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে মাতৃভূমিকে দেখেছি। মানুষকে দেখেছি, প্রকৃতিকে দেখেছি। সব ঠাঁই মোর ঘর হয়েছে --- আশ্রয় পেয়েছি। কিন্তু নিজের ঘর পাইনি কোথাও। যে জায়গায় কেউ বদলী হয়ে যেতে চায় না, সে জায়গায়ও আমি গিয়েছি। ছুটিতে বাড়ি এসেছি। সকলের সাথে সাক্ষাৎ করেছি।

        ঋতু  পরিক্রমায় সময়ের চাকা ঘুরেছে। কখন রূপালী প্রজাপতি আমার কালো চুলে তার পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেল টের পাইনি। পিতা-মাতা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ভাই-বোনেরা স্ব স্ব জীবনে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী বংশধরেরা দাপটের সঙ্গে মানুষ হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত। আমার ছাত্রীরা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। যেখানে যাই আমার পরিচিত মুখ। কেবল শিক্ষকতাই নয়, যেখানে যার যা প্রয়োজন, তাকে সাহায্য সহায়তা করেছি। পরের জন্য আমার কল্যাণের হাত বাড়িয়ে রেখেছি সারাটি জীবন। আমার চাকুরীর মেয়াদ শেষ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাচা-চাচীর সঙ্গে কাটাবো বাকী জীবন। তাদের পুত্র-কন্যারা সব সাত-সাগরের ওপারে বসতি গেড়েছে। ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।

        পিন্টু বলেছিল মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখবে। তা আর হলো না। মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার আমিও। কিন্তু কি লিখবো আমি? আমার তো সেই ভাষা নেই যে, সেই রক্তঝরা দিনগুলোর কথা সঠিকভাবে বর্ণনা করি!

        পিন্টুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই বিজন বনে --- মধুপুর গড়ে। না হলেও পারতো! কিন্তু হয়েছিলো। এ যে আমার নিয়তি, আমার অদৃষ্ট! নিতান্ত নাটকীয়ভাবে আমার জীবনে সুখ এসেছিল, স্বপ্ন এসেছিল। নাটকের মত হল তার অন্তর্ধান। ঘুরিয়ে দিয়ে গেল আমার জীবনের মোড়। পিন্টুর স্মৃতি বহন করেই জীবন কেটে গেল। একটি দিনের জন্যও তাকে ভুলিনি। অবসর মুহূর্তে মনের পর্দায় পিন্টুর আলেখ্য দর্শন আমার নিত্যদিনের কাজ। স্মৃতি রোমন্থন আমার আনন্দের উৎস!

        প্রাপ্তির দিক থেকে আমার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ। সাফল্য আমার প্রতি পদক্ষেপে। মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসা পেয়েছি প্রচুর। অর্থ উপাজর্নও কম করিনি। তবুও কোথায় যেন শূন্যতা। নিভৃত হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে বেদনার রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রতিদিন। বেদনায় বেদনায় নিজেকে কঠিন করে তুলবার প্রয়াস পেয়েছি। পারিনি। কঠিনেরে ভালবাসতে পারিনি।

        পিন্টু সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তবে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ছেলে সে নয়। তার অন্তর ছিল দয়া-মায়ায় পূর্ণ। আহত সহযোদ্ধাকে রণক্ষেত্রে ফেলে সে কখনও পালায়নি। সে অনেকের প্রাণ রক্ষায় সহায়তা করেছে। সেরকমই একটি ঘটনায় তার প্রাণ প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে। শত্রর গুলি ওর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

        পিন্টুর পছন্দের গান মাঝে মাঝে বাজিয়ে শুনি। মন উদাস হয়ে যায়। চোখের জল ঝরে অঝোরে। বাধা দিই না। জনম জনম ধরে তার জন্য কাঁদাই আমার বিধিলিপি। তার পথপানে চেয়ে চেয়ে আমার চোখের আলো কমে এসেছে। মনে পড়ে ওর গাওয়া গানের কলি। মুঝে তেরি দুনিয়াছে, হ্যায় দূর যানা, না জি কো জ্বালানা, মুঝে ভুলে যানা--- মেরি ইয়াদ মে। বড় দরদ দিয়ে গাইতো। গান থেমে গেলে চুপচাপ বসে থাকতো। আমি বলতাম, ‘এ গানটি কেন গাও? আর গেও না। মেলানকলি মুড এনে দেয়। বিষণœতাবোধ জাগ্রত হয়। বিরহের অনুভূতি হৃদয়কে ব্যথিত করে।

        পিন্টুরা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে। দেশের শ্রেষ্ঠ  সন্তান এরা। জীবন বাজি রেখে সকল বন্ধন ছিন্ন করে যুদ্ধে গিয়েছিল। তারা চলে গেছে চিরতরে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে। স্বাধীনতার স্বাদ তারা পায়নি। তারা চলে গেছে সেই উর্দ্ধালোকে--- সেই তারাদের মেলায়!

        অনেক সময় রাতের অন্ধকারে আনমনে তারাদের পানে চেয়ে থাকি। পিন্টু হয়ত আমাকে দেখতে পায়। কল্পনার চোখে দেখি নিবিড় ঘন আঁধারে শ্বেত-শুভ্র বসনা শিউলি আামি, কমলা রংয়ের আঁচলখানি উড়িয়ে হাওয়ায় ভেসে চলেছি সেই নীহারিকালোকে, যেখানে আমার পিন্টু বসত করে। আমি যেন অনন্তকালের যাত্রী। যাত্রা শেষে হয়তো আমি তার দেখা পাব। তার হাতখানি ধরে হাঁটতে থাকবো, যতদিন না আকাশের শেষ সীমানায় পৌঁছাই।

 

------------------- 

 সমাপ্ত

©  লেখক

 

 

 

লেখক পরিচিতি - ফিরোজা হারুন


জন্মঃ জানুয়ারি ১, ১৯৪৪, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার হরিরামপুর গ্রামে। স্নেহময় পিতা জনাব আব্দুস সোবহান বিশ্বাস ও মাতা জুবাইদা খাতুনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা।

শিক্ষাঃ ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তারপর টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ হতে বি.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এম. এ. সমাপ্ত করে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ফর উইমেন থেকে বি. এড. ডিগ্রী অর্জন এবং ঢাকায় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে যোগদান।

এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জননী ফিরোজা হারুনের সাহিত্য অঙ্গনের অগ্রযাত্রার মূলে প্রের
ণা যুগিয়েছে তাঁর স্বামী ডাঃ মোহাম্মদ হারুন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'জীবনেরে কে রাখিতে পারে' সাপ্তাহিক রোববারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের পর ১৯৯৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আর আন্তর্জালে প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে। দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস ২০০০ সালে 'সুখের লাগিয়া'। ২০০৮ এ প্রকাশিত হয়েছে আরো ছয়টি গ্রন্থ। কিশোর সংকলন -মেঘরাজা রোদরাজা, কাব্য সংকলন-নিশি লোর, উপন্যাস-প্রতীক্ষা, তিন পুরুষের গল্প, স্মৃতির দুয়ারে এবং গল্প ও প্রবন্ধ সংকলন-ছিন্ন বীণার তার। বড়গল্প জবান বন্দি আন্তর্জালে প্রকাশিত হয় ২০০৯-এ।

লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সমাজকল্যাণ মূলক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর মায়ের স্মৃতিস্মরণে একটি প্রাইমারি স্কুল তাঁরই নিজ গ্রামে।