ধারাবাহিক উপন্যাস

পর্ব-১

 

 

 

 

আজ লেখকের পরীক্ষা। সারাদিন কাজের মধ্যে থেকে মনেই ছিলনা লেখক এক গুরু দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলেন আজ থেকে বছর দুয়েক আগে আর আজ তার চরম পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে! আজই দুপুরে স্পীড পোস্টে এসেছে খামটা। সারাদিন কাজের ফাঁকে এতসব মনে পড়েনি।
 
রাত এখন একটা। ডিনারের পর সেই রাত সাড়ে দশটা থেকে বেশ অনেকবার পড়েছে খামের মধ্যে সুন্দর হাতের লেখায় সাজানো সেই অধরা মাধুরী মধুরার রচনাবলী যা তাঁর কাছে মাধুকরী। কি করবে এখন এই লেখাগুলো নিয়ে লেখক!
ঠিক কি ভাবে শুরু করবে ভাবছে সুবুদ্ধি। সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মা। পঞ্চাশোর্ধ এক যুবক। একজন প্রোথিতযশা মানুষ। ব্যাঙ্গালোর শহরে তিনি এক সন্মানিত ব্যাক্তি। বানিজ্যিক ও শিক্ষাসমাজে তাঁর কদর বেশ উঁচুতলায় হয়ে থাকে। তিনি একাধারে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট পেশাদার, সাহিত্যপ্রেমিক লেখক, একাগ্রচিত্ত শিক্ষক, ঘরোয়া রাঁধুনী, পেশাদার অভিনেতা ও আবৃত্তিকার এবং সর্বোপরি এক কবি যা তাঁকে অনেকের ভালবাসায় ভরিয়ে রাখে। সেই ভালবাসার মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষ সমবর্তমান। আর গাড়ী নিয়ে হাইওয়েতে ১২০-১৪০ এর কাঁটা না দেখলে তিনি ঠিক মনে করেননা যে গাড়ী চালিয়েছেন। সেই তিনি এখন বসে বসে ভাবছেন এই অ-ধরা কে কি করে ধরা যায়, তার অব্যক্ত কথাকে কি করে প্রাণ দেওয়া যায়?
 
এই লেখা লিখতে গিয়ে মানবজমিনের শুভবুদ্ধি সুবুদ্ধির সামনে কিছু প্রশ্ন রেখেছে। সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে প্রায় তিন ঘন্টা কেটে গেছে। লেখা শুরু হয়নি। সুবুদ্ধি চেষ্টা করে একজন স্বচ্ছ মনের মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখতে। তার নিকট ও দূরে অনেক বন্ধুত্বের আশীর্বাদের ঘেরায় সে থাকতে ভালবাসে। থাকেও। সে কোনও কাজ করার আগে ভাবে – ‘এটা কি ভাল কারও জন্যেও?’ বা ‘এটা কি ক্ষতিকারক কারও জন্যেও?' এই প্রশ্নদ্বয়ের উত্তরই তার পাথেয়। সুবুদ্ধি কারও ক্ষতি করতে পারে একথা কেউ বলেনি আজও। কেউ ভেবেছে কিনা তাঁর জানা নেই। কিন্তু কোনও অন্যায়ের দৃঢ প্রতিবাদ করার জন্য সে প্রায়ই অপ্রিয় হয়ে থাকে। তাতে তার কিছু যায় আসেনা। সে যখন পেশাদারী জমিতে দাঁড়িয়ে শেখায় বা পড়ায় তখন সবাই অবাক হয়ে ভাবে কি করে একজন মানুষ কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই তিন দিন বা চার দিন ধরে একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়িয়ে যান এবং তা’ বেশ মনযোগ দিয়ে সবাই শেখেন। সুবুদ্ধি নিজে খুবই আধুনিক মনের মানুষ কিন্তু পড়ানোর সময় এই কম্পিউটার, প্রজেক্টার বা আরও নানাবিধ যন্ত্রাদির ব্যবহার তাঁর মনঃপুত নয়। ওতে নাকি একাগ্রতার ঘাটতি হয়। এই নিয়ে নবপ্রজন্মের সাথে একটা নির্বাক বিবাদ আছে। তাঁর ধারণা যন্ত্রপাতি মানুষের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি। সুবুদ্ধি আজ খুব খুশী আবার কেমন যেন অন্যমনস্ক। ঠিক কি চলছে তাঁর  মনের মধ্যে বোঝা মুশকিল।
 
আজ অধরার প্রথম চিঠি এসেছে স্পিড পোস্টে। মিসেস অধরা চৌধুরী। বিয়ের আগে অধরা দাশগুপ্ত ছিলেন। অধরা কে সুবুদ্ধি আজও দেখেনি। কিন্তু তাকে তিনি চেনেন তার নিজের মনের আয়নায় – খুবই স্বচ্ছভাবে – তাঁর হাতের রেখার মতই অধরা তাঁর কাছে স্বচ্ছ। অধরার সাথে আলাপ ইন্টারনেট ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে। সুবুদ্ধির স্ত্রীও জানেন নাগপুর আর ব্যাঙ্গালোরের মাঝে এক মানস-সেতুর ভিতপুজো হয়েছে দু’বছর আগে। বন্ধুত্বের কি কোনও ভৌগলিক সীমা টানা যায়? প্রথম দিকে খুবই হালকা এক পরিচয় ছিল অধরার সাথে। অধরা বিবাহিতা, ষোড়শী কন্যার মাতা, তার স্বামী নাগপুরে বিশাল এক বিদেশী ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অধরা খুব ভাল গান গায়। উস্তাদ নিছাবর আলী খানের ছাত্রী। বেশ কিছুদিন পন্ডিত সুজয় চক্রবর্তির কাছেও তালিম নিয়েছেন। টেলিফোনে দু'এক কলি শুনেই সুবুদ্ধি বুঝেছিল এই প্রতিভা খুন্তি নেড়ে আর ফরমায়েশি সাজগোজ করেই জীবন শেষ করে দিচ্ছে। পরিচয়ের পর বেশ কিছু দিন যাবার পরে সুবুদ্ধি বেশ গার্ডিয়ান এর মত কথা বলার জায়গায় পৌঁছে যায়। কি করে? সেটাই হল সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মার ব্যক্তিত্বের প্রভাব। অধরার স্বামী বিক্রম চৌধুরীর সাথেও পরিচয় হয়েছে সুবুদ্ধির। বেশ রসিক মানুষ। উনি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে ছিলেন জীবনের শুরুতে। জীবনের সব সুখ উপাদানে তার রোজনামচা সাজানো। খুব মিশুকে মানুষ। তবে বেশ মেজাজী মানুষ। চ্যাটে বা টেলিফোনে কথা বলে সুবুদ্ধি একটা ছবি তৈরী করেছে বিক্রম ও অধরার। বিক্রম খুব দাপুটে স্বামী। প্রথমে এক বর ছিল। এখন কি সে দুটো বর (বর্ব্বর)? কথাটা ভেবেই হাসল সুবুদ্ধি। অধরা যথার্থ সুন্দরী, বিদুষী ও গুণী মহিলা।
 
অধরা বা সুবুদ্ধি কেউই কোনও দিন উন্মুক্ত হয়ে এগিয়ে না এলেও এটা বুঝে নিতে ওদের কোনও অসুবিধা হয়নি যে ওরা একে অপরের প্রতি এক নিঃস্বার্থ ভালবাসা অনুভব করে। তাদের মধ্যে এক অব্যক্ত মানসিক আদান প্রদান আছে। কিন্তু আজও কেউ কাউকে দেখেনি। সেই আকুল তাগিদ অনুভব করলেও প্রকাশ করেনি কেউই। এমনকি ছবি আদান প্রদানও হয়নি। এক প্রাপ্তমনস্ক অনুভবের ঘেরাটোপের মধ্যে       দু’জন বাস করে। অধরা হল মানস প্রেমিকা আর সুবুদ্ধি? সে কি বুদ্ধি দিয়ে ভালবাসে? নাকি তার ভালবাসা অব্যক্ত? কবি সে। তার মন পদ্মপাতায় ধরা জলে অধরার মুখ দেখে। এই সব প্রশ্নের ঝড়ে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে বসে বসে ভাবছে – কি করা উচিত এখন? লিখতে উব্ধুদ্ধ করেছিল যখন তখন কি তাহলে সুবুদ্ধি ধরেই নিয়েছিল যে অধরা লিখবেনা?
 
সুবুদ্ধি বিবাহিত। তার একটি ঊনিশ বছরের ফুটফুটে মেয়ে আছে – শুভশ্রী। তাঁর স্ত্রী তপশ্রী আই এ এস অফিসার। প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার সেক্রেটারী। ওঁরা দূরে দূরেই কাটিয়েছে জীবনের অনেকটা সময়। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা বলে উড়ন্ত পরিবার। তপশ্রী যদিও ব্যঙ্গালোরে পোস্টেড কিন্তু প্রায়ই দিল্লি যেতে হয় ওঁকে। অধরা ইংলিশে এম-এ করার পর মাস্টার অফ ল’ করে আজ ১৭ বছর ধরে সংসার নামক খাঁচায় বেশ সাজানো গোছানো পাখীটি। ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিল কেন ও কি ভাবে? দুজনের জীবন চরিত এক্কেবারে আলাদা। চুম্বকের ধর্ম্ম – দুই বিপরীত মেরু একে অপরকে টানে – তাই কি? কি করে না দেখে না ছবি আদান প্রদান করে না সামনা সামনি কথা বলে এত কাছে আসা যায়? সুবুদ্ধি ভেবে চলে।
 
অধরাকে বাইরে কোনও কাজ করতে দিতে ওর স্বামী নারাজ। অধরা গুণবতী সহধর্মিনী হয়েই আছে তবু বিক্রম কি ভাবে কে জানে? অধরা যদি বাইরে যায় তাহলে কি সে বিক্রমকে ত্যাগ করবে না কি অন্য কারও প্রেমে ডগমগ হয়ে বিক্রমের প্রতি অনীহা প্রকাশ করবে? বিক্রমের মধ্যে একজন অনিশ্চিত বা অসুরক্ষিত পুরুষ বাস করে কি? তাই বুঝি সে অধরাকে তার সম্পত্তি মনে করে। এই সবকথা অধরা সরাসরি না বললেও কথায় কথায় ও অধরার জীবনের রোজনামচা থেকে বেশ ভাল বোঝে সুবুদ্ধি। কিন্তু তাঁর শিক্ষা ও রুচি তাকে বাদ সাধে। তাই এই নিয়ে কোনও কথা সরাসরি অধরা বা বিক্রমের সঙ্গে সে কখনও বলেনি। কিন্তু ওদের মধ্যে একটা গভীর বন্ধুত্বের সেতু গড়ে উঠেছে এই দু'বছরে। সুবুদ্ধি ভাবে বিক্রম কি করে একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এই রকম এক প্রতিভার ভান্ডারকে নিজের দাপটে ঢেকে রেখেছে! অধরা কেন গান গায়না? অধরা কেন বিক্রমকে এত ভয় পায়? অধরা কেন এই সব কথা লেখেনা? এই সব প্রশ্ন সুবুদ্ধিকে আবার ছুঁয়ে গেল। পর পর প্রশ্ন আসছে মনে।
 
স্বামী চিন্ময়ানন্দজীর একটা কথা মনে পড়ে গেল সুবুদ্ধির, 'কাউকে অন্ধকার গহীন বন থেকে তুলে আলো দেখিয়ে রাজপথে এনে দাঁড় করানো তোমার কাজ হতে পারেনা যদি না তুমি তাঁর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন সকালের নব আলোকে তার সাথে পথ চলতে পার।' আজ অধরা যা করে দেখিয়েছে তার পরে সুবুদ্ধি কে তার সঙ্গে অনেক লম্বা পথ যেতে হবে। সে কি পারবে? আসলে সুবুদ্ধিই বলে বলে অধরা কে আবার হারমনিয়াম ধরিয়েছে। আর যা করাতে পেরেছে তা দেখে সুবুদ্ধি নিজেই হতবাক! সে প্রায়ই টেলিফোনে বা নেটফোনে অধরাকে অণুপ্রানিত করার চেষ্টা করেছে সে যাতে লেখে। লিখলে মনের বিকাশ ঘটে। সুবুদ্ধির মনে হত লিখলে হয়ত অধরার মধ্যে যে অপুর্ণতার চাপা দুঃখ আছে তার থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পারবে। সুবুদ্ধির এই গার্ডিয়ানসুলভ আচরণ অধরার যে বেশ ভাল লাগে তা হাবে ভাবে প্রকাশ করে অধরা। কথায় না প্রকাশ করে আজ তা কলমের ঝরণা ধারায় ভাসিয়ে দিয়ে পাঠিয়েছে সুবুদ্ধির কাছে।
 
অনেক দিন আগে একদিন ফোনে সুবুদ্ধি বলেছিল – ‘তুমি লেখ’। অধরাকে সে তুমিই বলে। অধরা অনুমতি দেয়নি বলেছিল এটা তার দাবী যে সুবুদ্ধি তাকে ‘তুমি’ বলেই যেন সম্বোধন করেন। অধরা সুবুদ্ধির থেকে প্রায় বার বছরের ছোট। 'তোমার যা মনে চায় তাই লেখ। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ যা খুশী।' আর অধরা তখন ওর খিলখিলে ঝরণা ধারায় স্নান করে উঠেছিল, হাসিতে লুটিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘কি? আমি লিখলে পরে শিক্ষিত লোকেরা মূর্খ হয়ে পড়বেন।' সুবুদ্ধির কথা অধরার মনে ধরেনি অনেক দিন পর্যন্ত। এই নিয়ে এর মাঝে আর খুব একটা কথাও হয়নি। আসলে সুবুদ্ধির দৈনন্দিন জীবনে এই সব ভাবার সময় খুবই কম সেটা অধরা বা বিক্রম এমনকি ওদের মেয়ে তিতুনও জানে। অন্যান্য সবাই জানে। এর মধ্যে মাঝে সাঝে কথা হত কিন্তু সেটা খুবই সাধারণ।


আজ এই স্পীডপোস্টের খাম এসে সব ওলটপালট করে দিয়েছে। ঠিক ওলটপালট নয় সুবুদ্ধি ঠিক করে উঠতে পারছেনা কি করে এই সব সৃষ্টির কদর করবে! এ যেন নবজাত শিশু অসাধারণ রচনা করেছে আর পিতৃপ্রতিম কেউ অবাক হয়ে দেখছে সেই সৃস্টি আর ভাবছে এর পর কি? অধরা গত কয়েক মাস ধরে যা সব লিখেছে সে’সব খামে করে পাঠিয়ে দিয়েছে সুবুদ্ধিকে। সে কি চায় যে সুবুদ্ধি তার লেখাগুলো প্রকাশ করুক? সঙ্গে একটা চিঠি। এই চিঠি প্রকাশ করলে অধরার ভাবনাকে অনাদর করা হবে কিনা তাও বুঝে উঠতে পারছেনা সুবুদ্ধি। লেখাগুলো সরাসরি সুবুদ্ধির ওয়েবজিনে ও পত্রিকাতে প্রকাশ করা যেতেই পারে। সুবুদ্ধি এক বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক যার কাগুজে প্রকাশনাও বেশ জনপ্রিয় বাঙ্গালী পাঠক মহলে। সুবুদ্ধির সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সেই কিশোর বয়স থেকেই। দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, বইমেলা পত্রিকা, কফি হাউস প্রকাশনা, পুর্নাংগ পত্রিকা আর আজকের ওয়েবজিন এই সবেই বেশ স্বচ্ছন্দ সুবুদ্ধি – তার একটা মূল কারণ হল সে খুব খোলামেলা মনের ছাত্র। সে সাহিত্য চর্চা করে কোনও বানিজ্যিক অভিপ্রায়ে নয়।
 
কিন্তু অধরা কি তার অনুমতি দেবে তার লেখা ছাপানোর? অনেক ভেবে পরের দিন সকালে সুবুদ্ধি অধরাকে ফোন করল। অধরা সুবুদ্ধির ফোন পেয়ে খুব খুশী হল কিন্তু সেই খুশী নিমেষে মিলিয়ে গেল যখন জানল যে সুবুদ্ধি তার লেখাগুলো ছাপাবার অনুমতি চাইতে ফোন করেছে। অধরা শুধু এক কথায় জবাব দিল, 'সেটা আপনার ওপরই ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু আপনি এত দ্বিধাগ্রস্ত কেন? এর উত্তর আমি দেবনা, এই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।'র পর আর কোনও কথা হয়নি। সাময়িক নীরবতার পর ফোনটা রেখে দিয়েছিল সুবুদ্ধি। সারাদিন অফিসে বসে, কাজের মধ্যে, ড্রাইভ করতে করতে অনেক ভেবে সুবুদ্ধি ঠিক করে ফেলে যে অধরার সৃষ্টি ঠিক যেমন ভাবে এসেছে ঠিক সেই ভাবেই প্রকাশ করবেন। এমনকি অধরার চিঠিও।

 


 

অধরার চিঠি

আমার আরাধ্য সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মা সমীপেষু,
 
কেমন আছেন? আশা করি আপনার সব ভাল চলছে ও সবাই ভাল আছেন।
 
আজ এই চিঠির মাধ্যমে আমি আমার কিছু লেখা ও আমার কয়েকটি ছবি পাঠালাম। ছবি পাঠালাম অনামন্ত্রিত হয়েই। আমার মনে হল যার লেখা পড়ছেন তাকে দেখতে কেমন তাও জানা থাকা ভাল। তিনটি ছবিই কয়েক বছর আগের। বোধ হয় ২০০১ এ তোলা গুজরাটের দ্বারকায়। ছবিগুলো আকারে একটু ছোট কিন্তু যে অধরাকে আপনি দেখেননি কিন্তু চেনেন তাকে বুঝে নেওয়ার পক্ষে বোধহয় যথেষ্ট। পারবেন না আপনি অধরাকে বুঝে নিতে? ভেবেছিলাম যদি কোনওদিন নাগপুরে আসেন তো তবে এইসব আপনার হাতেই তুলে দেব কিন্তু সেই সৌভাগ্য কি অধরার কখনও হবে? জানি না। ওই যে লিখেছি ‘পাখীর বিধি বাম’ সেটাই কেমন সত্যি হয়ে গেল।
 
আপনি কাজে কর্মে অতীতে নাগপুরে এসেছেন শুনেছি কিন্তু তখন আপনি অধরাকে আবার সতের বছর পরে গান গাইতে বা জীবনে প্রথম তাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করতে তার জীবনে ছিলেননা। আজও কি আপনি তার জীবনে আছেন? জানিনা। আমি একটু পাগলী আছি – তাই আমার সব কথা ধরবেন না দয়া করে। ‘জানিনা’ বলা আমার মুদ্রাদোষ নয় কিন্তু। কথাটা লিখেই নীরবে হাসলাম। আসলে আমার ভাগ্য এই রকমই। আমার জীবনে সব ভাল হয় দেরীতে হয়েছে বা সেই ভাল পরিণতিতে জীবিত হয়ে ওঠেনি। যাই হোক। অধরা মনেপ্রাণে আপনার ভক্ত ও আপনার মত একজন সন্মানীয় মানুষকে সামনে থেকে দেখার বা তাঁর সংস্পর্শে আসার অপেক্ষায় থাকবে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আপনিই অনেকদিন আগে বলেছিলেন পৃথিবীতে সব যোগাযোগ ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়ে থাকে। আমিও তা বিশ্বাস করি। তাই আশা রাখি একদিন আমার পরম আরাধ্য মানুষটিকে কাছে পাব।
 
আপনাকে জানাই, অধরা আপনার সু-বুদ্ধির নির্দেশে আবার জেগে উঠছে। সে গান গাইছে। লিখছে। এই সবের কৃতিত্ব সেই মহান মানুষের যাকে সে এই চিঠি লিখছে। আমার লেখাগুলো আপনার সাহিত্যিক নজরে উত্তীর্ন হবেনা জানি কিন্তু আমি আমার মন প্রাণ সঁপে এই রচনা গুলি সৃস্টি করেছি। লিখেছি শুধু আপনার অনুপ্রেরণাকে আমার পাথেয় করে। তাই এই লেখার পরিণতি কি হবে তা সম্পূর্ণ আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম। আপনি যে ভাবে চাইবেন এই লেখার পরিবর্তন বা অবলুপ্তি ঘটাতে পারেন, অধরা তাতেই ধন্য হবে।
 
আমি এই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা যে আমি এত কিছু লিখেছি। আপনার সু-বুদ্ধি আমার জীবনে ও মননে যুক্ত না হলে এই অসম্ভব বাস্তব হতনা। আমি লেখার জগতের সভ্য নই। আমার সব ভুল ত্রুটি শোধন করে নেবেন বা এই লেখাকে সম্পূর্ণভাবে নির্দ্বিধায় ত্যাগ করবেন।
 
সাদর সন্মানান্তে,
অধরা
 
 

চিঠিটার মধ্যে এত ভালবাসা ও সন্মান অকাতরে বিলিয়েছে অধরা যে সুবুদ্ধির বলতে ইচ্ছে হল অধরাকে, 'এত বেশী কি আমার প্রাপ্য?' কিন্তু চুপ করেই রইল। কারণ সকালের ফোনের কথা এখনও বেশ মনে আছে তাঁর। অধরার লেখা গুলো খুব সাজানো গোছানো খাতায় বা ডায়েরীতে লেখা নয়। যখন যেমন কাগজ হাতের কাছে পেয়েছে তাতেই লিখেছে বলে মনে হয় কিন্তু প্রাণ দিয়ে লিখেছে। সেই পান্ডুলিপি এখন সুবুদ্ধির হাতের তলায় সযত্নে রাখা।

 

 

 

 

পর্ব-২

 

 

 

অধরার চিঠি বেশ কয়েকবার পড়েও সুবুদ্ধি তাকে ঠিক বুঝতে পেরেছেন কিনা তাই নিয়ে তার নিজের সংশয় কাটছেনা। চুপ করে বসে বসে ভাবে অতঃপর কি করণীয়।এই ভাবতে ভাবতে সুবুদ্ধির চোখ গেল অধরার লেখা একটি কবিতার পাতায়। বেশ কয়েকবার পড়ে ভাবলেন এই কবিতায় অধরাকে বেশ ধরা যায়।

 

অন্তরীনা সুনামী
 
যেই সন্ধায় প্রথম তোমায় দেখি
অনুভূতির পুঁথিমালা বুকের মধ্যে গাঁথি
বাঁকা চাঁদ সেদিন উদার আলো ঢেলেছিল
 অশান্ত অন্তরের মৃগনাভি মাতিয়ে রেখেছিল
মন ছিলনা মনের ঘরে
প্রতীক্ষা শুধু তোমারই তরে
বিন কাজলে মোর সলাজ আঁখি সদা টান টান
মনের ঘরে দমকা হাওয়া শ্বাসরুদ্ধ আঁধির তুফান
ফুলের তোড়ার সুগন্ধ নিয়ে যখন তুমি এলে
 ঝড় তোলা সম্ভাষনে ও উদ্দাম আড়চোখে দেখে নিলে
এক লহমায় দু’জোড়া দৃষ্টি বিনিময়
ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি হয়ে আছে অক্ষয়
আমার সাজান কপোলে বিন্দু বিন্দু শ্বেত, তুমি জল চেয়েছিলে
তন্বী স্ফটিকাধার হাতে আমি, তুমি তৃষ্ণা মেটাতে এগিয়ে এলে
তখন অন্তরেতে ঝর ঝর ঝরিছে ক্ষরিতা বারিধারা
তোমার হাতের একটু ছোঁওয়ায় আমি যে পাগলপারা
অন্তরে দহন মনে তোলপাড় তবু ছিলে সংযত
এই তো তুমি শুধু তুমি আমার তুমি তোমারই মত
নানান কথার ভিড়ে না হারিয়ে দেখছিলে আমায় আড়ে আড়ে
বুঝেছিলে কি তখন এ’মন বেঁধেছে সুর তোমারই মনের তারে
অন্ধকারে এক মুহূর্তে হঠাত কাছে দুটি মন
ভাসিয়ে ছিল উষ্ণতায় তোমার আলিঙ্গন
সেই ঝড় আজও চলছে, যায়নি থামি
সযতনে লালিতা মোর অন্তরীনা সুনামী।
 

অধরা কি নিজেকে অসম্পূর্ণা মনে করে? তাই এত আন্দোলিতা সে? কার ছবি অন্তরে নিয়ে এই লেখা! এই কবিতা যেন এক চলচ্চিত্র! ফ্রেম বাই ফ্রেম এই কবিতা যে লিখতে পারে সে এর আগে কখনও লেখেনি কেন? কেন সে একচল্লিশটি বসন্ত বর্ষা বা শীত পার করে দিয়েছে হেলায়? অধরা শুধু ভাল লেখিকা নন এক ভাবুক কবিও - কেন এই ছাই চাপা আগুনকে কেউ একটু খুঁচিয়ে দেয়নি কেউ? প্রশ্নটা মনে আসতেই সুবুদ্ধির দুটো কথা মনে হল।
 
প্রথমতঃ অধরার মত এরকম আরও কত প্রতিভা আছে যাঁদের সঠিক সময়ে একটু হাত ধরে এগিয়ে দেওয়া হয়না পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। আমাদের দেশে ব্যাপারটা আরও প্রকট। তাঁদের সবাইকে যদিও সুবুদ্ধি চেনেনা কিন্তু সুবুদ্ধি সেই মানুষ নয়, যে কেবল দায় দায়িত্বের জাবেদা খাতা নিয়েই জীবন যাপন করে।সে মনে করে রিচার্ড বাখ এর জনাথন লিভিংস্টোন সীগাল এর মত জীবন যাপন করা উচিত – এক সামান্য সামুদ্রিক চিল ভেবেছিল সব পাখীরই আকাশে ওড়া উচিত ওড়ার আনন্দ নেবার জন্য। পাখীদের শুধু গৃধ্নুর ক্ষুদা নিবৃত্তি করার জন্য ওড়া নয়। জনাথন তাই করেছিল। সুবুদ্ধি ভাবল শুরুটা অধরাকে দিয়েই হোক।
 
দ্বিতীয়তঃ এক প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার বোধ কি কাজ করছে মনের মধ্যে যে সে অধরার কথা তুলে ধরতে পারছে? তার জন্য কিছু করতে পারছে বলে? কার কাছে সে অধরাকে তুলে ধরেছে? না। কিচ্ছু পারেনি সে এখনও। অধরার জীবনে কোনও পরিবর্তন হবেনা এই লেখা ছেপে বেরোলেও। এই লেখা তো এক তত্ত্ব। এই লেখা লিখলে অধরার জীবনে কোনও তারতম্য ঘটবেনা। তক্ষুনি সেই বোধ থেকে মুক্ত হয়ে সে আবারও ভাবল, অনেক সময় চলে গেছে, এবার কিছু করা যাক! এরই মধ্যে আরেক রবিবারের সকাল কেটে গেল সুবুদ্ধির। সুবুদ্ধি কি প্রেমে পড়ল এই পঞ্চাশের উঠোনে দাঁড়িয়ে? ভেবেই মনে মনে হাসল।না না একে শুধু প্রেমে পড়া বললে নিজের ও অধরার অনুভূতির প্রতি অন্যায় করা হবে। সাংসারিক জগতের দৈনন্দিন লেনদেনের সম্পর্ক যে এটা নয় তা সুবুদ্ধি জানে। তবে জীবনে প্রথম এই অনুভূতি হল বা হচ্ছে তার।
 
স্ত্রী তপশ্রীকেও সে পেয়েছিল সাত বছরের একমুখী প্রেমের বহতার পরে। তপশ্রী তখন জীবনের এক বাঁকে, এক মোহনায় দাঁড়িয়ে । সাত বছর ধরে সুবুদ্ধির প্রেম ছিল সতেজ ও সপ্রাণ কিন্তু একমুখী। আজও কি ওদের প্রেম একমুখী? না বোধহয়। আসলে শ্রী ঠিক প্রকাশ করতে পারেনা বা চায়না। সে নীরবে প্রেমের আনন্দ নিতে চায়।তা নিক না। তাকে তো সুবুদ্ধি ভালবাসে সেই ভাবেই যে ভাবে সেই ১৯৭৭ এর নাটকের রিহার্সাল রুমে প্রথম দেখে ভালবেসে ফেলেছিল। প্রথম দর্শনের প্রেমই সত্য,আর সব হাতছানি মিথ্যে হয়েই দাঁড়ায়। সুবুদ্ধির মনে হল।
 
শ্রী খুব ভাল কত্থক নাচত। সে আর আজ সম্ভব নয়। শরীর ভারী হয়েছে। স্লিপ ডিস্কের ব্যথা মাঝে মাঝেই চাড়া দেয়। ও কি করে উঠে দাঁড়াল ২০০১ এর ১১ই জানুয়ারীর পর সে এক মাত্র ঈশ্বর জানেন আর জানে সুবুদ্ধি আর ওদের কন্যা সুভশ্রী,সুভা। টানা চার মাস কাঠের পাটাতনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল ওকে। ওর মধ্যে এক অদম্য বাঁচার স্পৃহা আছে যা সুবুদ্ধির সাথে খুব মেলে। শ্রীকে আবার গান গাওয়া শুরু করাতেও অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এখনও হাল ছাড়েনি সুবুদ্ধি। শ্রী এখন মাঝে মাঝে গান গায়। মাঝে মাঝে সময় পেলে পুরোনো গুরুর কাছে যায়। তাঁর বয়স হয়েছে কিন্তু শ্রীকে সময় দেন তিনি। শ্রী শুধু শ্রীময়ী নয় ওর রূপ ওর চোখের গভীরে আর মনটা খুব মিষ্টি সুন্দর। সত্যিই খুব ভাল গায় শ্রী এত অযত্নে সত্বেও। ও যখন গান গায় তখন গলা সংগ দেয় ওর ইচ্ছাকে। অন্য সময় কাক চীলও ভয় পায় ওদের বাড়ীর ছাদে বসতে।
 
অধরার গলা ভীষ মিষ্টি ও সুরেলা তবে তুলনা করার কোনও অবকাশ নেই। শ্রী শ্রীই। ওর কোনও দ্বিতীয় নেই। শ্রী অদ্বিতীয়া। শ্রী কে সুবুদ্ধি প্রায়ই বলে তুমি সাতটা খুন করে এসে যদি একটা গান শোনাও তাহলে সবচেয়ে কড়া বিচারকও তোমাকে মাফ করে দেবেন। বলেই দুজনে হাসে।সে হাসি স্বীকৃতির। আজকাল দুজনে নিজেদের জন্য সময় পায়না একেবারে কিন্তু কোথায় যেন এক অটুট বন্ধন অনুভব করে সুবুদ্ধি তপশ্রীর সাথে আর তা বেশ সযতনে সাজিয়ে রেখেছে উত্তর প্রবীণ মনের মাঝে। শ্রী হল গিয়ে সুবুদ্ধির একাধারে স্ত্রী, মা, কন্যা, বন্ধু ও প্রেয়সী যে বলে কম কিন্তু উপোভোগ করে অনেক বেশী আর সুবুদ্ধির এটা বেশ ভাল লাগে। শ্রী’র তুতো দাদা গণাদা ভাল বলে, ‘পাইছিলি এই একটা বান্দরেরে যার সব কিছু হইলি গিয়া তুই’ আর শ্রী মুখ টিপে হাসে। আবার সাথে সাথে গণাদা সুবুদ্ধিকে বলে, 'তুমি মনু কপালে হাত বুলাও – এই রকম একটা সহধর্ম্মিনী তুমি আগামী সাত জনমেও পাইবানা।' গণাদা হলেন গিয়ে বরিশালীয়া বাঙ্গাল ভাষার বিশ্বপ্রচারক।খুব মিষ্টি করে বলেনও। গণাদা আসলে ওদের দুজনকেই খুব ভাল বাসেন। সুবুদ্ধির প্রানের চেয়েও প্রিয় কন্যা সুভা মায়ের প্রায় সবটুকু সময় নিয়ে নেয় আর সারাদিন কাজের পর সংসারের নানান ঝামেলা সামলাবার পর শ্রীকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেখলেই সুবুদ্ধির বেশ ভাল লাগে। সেই ভাল লাগাই কি ভালবাসা? হয়ত।
 
অধরা যেন সুবুদ্ধির মানস শিল্পী। অধরাকে না দেখে সে তাকে বন্ধুত্বের আধারে সাজিয়েছে। মনে মনে বলে, অধরা যেন তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে আর তাতে যদি সুবুদ্ধির কোনও ভূমিকা থাকে তাহলে সে নিজেও খুব খুশী হবে। অধরা কি করে সুবুদ্ধির এতটা কাছে চলে এল তা নিয়ে ভাবার সময় নয় এটা।এখন অধরার মননের প্রকৃত প্রকাশ করাই তার একমাত্র কাজ। অধরাকে জলে নামানো গেছে এই ভালটুকুকে সে ঈশ্বরের দান বলে মনে করছে। এখন অধরার সৃষ্টিকে সে লালন করার গুরুদায়িত্বকে সুবুদ্ধি মাথায় তুলে নিয়েছে। অধরা কে? জানতে চান? তবে, অধরার গল্প পড়ুন।

 
 


বর্ণময় অন্তরালে


প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে শৈশবকে পেছনে ফেলে ক্রমশঃ এই আমিতে পরিণত হয়েছি। আমি কলকাতা শহরের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে জন্মেছিলাম আমার মা বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে। আমার বাবা তমোনাশ দাশগুপ্ত আর আমার মা সহেলি দাশগুপ্ত। আমি তাঁদের এত আদরের ছিলাম যা কোনও রাজকন্যারও ঈর্ষার কারণ হতে পারে। কি পাইনি আমি? যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। প্রকাশ করিনি কিন্তু আমি তাই পেয়ে গেছি তাঁদের কাছ থেকে। আর সেই আমি, সেই আমি আজ সতের বছর আমার স্বামী ও আমার একমাত্র সন্তানের সাথে আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক জীবন যাপন করি যার মধ্যে কোনও কিছুর অভাব চর্ম্মচক্ষে ধরা পড়বেনা কিন্তু আমি জানি আমি কি অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘর করি। তাই বোধ হয় আমি অধরা। আমাকে ধরা যায়না। একেক সময় মনে হয় এই আমি কি আসল আমি? আমার জীবনের প্রথম তেইশ বছর আর পরের সতের বছর একেবারে উত্তর দক্ষিণের মতই আলাদা। আমি যে কবে শেষ প্রাণ খুলে হেসেছি মনে নেই। শেষ কবে আমি আমার মত করে জীবনের স্বাদ নিয়েছি মনে নেই। কবে যে শেষ গান গেয়ে নিজেকে ‘যখনই চেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি’ মনে পড়েনা। কবে যে শেষ আমি হাসতে হাসতে মাটিতে বা খড়ের গাদায় বা গোলা ঘরের মাথায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণ খুলে গান গেয়েছি তাও মনে নেই। গোলাঘরের খড়ের চাল বা সবুজ ঘাসে ভরা মাটী আমার প্রিয় বিলাস ভূমি। আমার প্রাণের কথা ছিল এইরকম যা আমি সত্যি বলেই মনে করতাম, আজও করি কি? জানিনা। মনে পড়ে আমি ভাবতাম,

 


‘জীবনের স্বাদ হল অলৌকিক সত্য চিরন্তন
এই মন ভেঙ্গে দেবে সময়ের সঙ্কীর্ণ বন্ধন
কত যে স্বপ্ন দেখি মনের চিদাকাশে
ডানা দাও হে ঈশ্বর উড়ে যাই দূরাকাশে
গন্ডীতে আবদ্ধ প্রাণী প্রাণ যেন ক্ষুদ্র বাসনা
এই ছবি দেখে দেখে ঝাপসা হয়েছে মনের আয়না’
 


থাক সে কথা।
 
থাক বলেই আমি চলে গেলাম আমার সেই ছোট্টবেলায়, কত হবে তখন আমার বয়েস, পাঁচ বছর বা তারও কম। আমার বাবার বন্ধু স্নেহাংশুকাকুদের লেক গার্ডেন্সের বাড়ির দোতলার বারান্দায়। বাবা স্নেহাংশু কাকুকে ছোটকু বলে ডাকতেন আর কাকু বাবাকে কর্মনাশা বলে। বাবা যদি আড্ডায় আসেন তবে সব কাজকর্ম পন্ড। কাকুদের সেই বারান্দায় অন্তাক্ষরী প্রতিযোগিতা, গানের রিহার্সাল, বাজি পোড়ানো, হোলির রঙ দিয়ে দেওয়াল এবং মুখাবয়ব রাঙ্গিয়ে দেওয়া আরও কত কি। কাকুর দুই মেয়েই আমাদের স্কুলে পড়ত, কিন্তু দুজনেই আমার স্কুলের দিদি তবে খুব বন্ধুর মত দিদি। কিন্তু কি ভাল যে ছিল সেও সব দিন গুলি। শুক্তিদি, সিতিদি শেহাংশুকাকুর দুই মেয়ে। সিতিদি বড়। শেহাংশু কাকুর দাদার মেয়ে সুলতা, সেও আমার দিদি। সেও পড়ত আমাদের স্কুলে। আর আমি সবার ছোট। বেশ আবদেরে মেনী ছিলাম আমি দিদিদের কাছে আবার দস্যিপনার জন্যে ওরা সবাই আমাকে একটু সমঝে চলত। না না আসলে ভালবেসে প্রশ্রয় দিত। কাকুর ছোট বোন তিতি পিসির মেয়ে, তুতু।তাকে আমি কি অত্যাচারই না করেছি। তুতু আমার থেকে পাঁচ, ছয় বছরের ছোট। আমি দিদি। তুতু আমাকে রীতিমত ভয় পেত। ওকে আমি খুব ভালবাসতাম আবার পেটাতামও মাঝে সাঝে। তুতুর ছোট বোন বুলি, সে তখনও জন্মায়নি। তাকে তাই খুব একটা কব্জা করতে পারিনি। তবে সে আমাকে বেশ বড় দিদি হিসেবে দেখত পরবর্তীকালে। বেশ ছিল সেই দিনগুলি। খেলাধুলো হত, দস্যিপনা হত আবার কত কি খাওয়া হত একসাথে। শীতের দিনে কাকু বা বাবা ফ্লুরিস থেকে কেক বা জলযোগ থেকে সিঙ্গাড়া আর পয়োধি এনে আমাদের ট্রিট দিতেন। লেক মার্কেটের জলযোগ কি এখনও আছে? জানিনা। তখনকার দিনের কোক দিয়ে আমাদের পার্টি হত। বাবা ও কাকু অবশ্য কোকের সাথে আরও কিছু মিশিয়ে নিতেন। আমরা সবাই মিলে যে কি আনন্দে সেই সব মুহূর্ত কাটাতাম!

 

 

 

 

পর্ব-৩

 

 

 

অধরার গল্প, বর্ণময় অন্তরালে, এই লেখা পড়ে সুবুদ্ধির মনে হয় এক অসম্পূর্ণা লেখিকা কত কি বলতে চাইছে কিন্তু কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে তার প্রকাশ। অধরার গল্প আগে কি বলছে...
 
কি আনন্দেই সেই সব দিনগুলো কাটত, ভাবলে এখনও তরতাজা লাগে। মন চনমন করে ওঠে। খুব মিস করি সেই সব দিনগুলি।
 
স্নেহাংশু কাকুর স্ত্রী দীপ্তি কাকিমা নীরবে সবার সেবা করে যেতেন। কি সুন্দরীই না ছিলেন কাকিমা। কাকু বলতেন বাবাকে ‘সেই কবে ঈছামতী নদীর ধারে ইটিন্ডাঘাট থেকে সুন্দরীকে বৌ করে এনেছিলেন আমার বাবু আর আমি হয়ে গেছি সুন্দরীর সামনে কাবু।' কাকু খুব রসিক মানুষ ছিলেন। কাকুর একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারও ছিল কাকীমার রূপ নিয়ে। ভীষণ হুল্লোড়ে মানুষ ছিলেন তিনি। মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে হটাত চলে গেলেন। তাও আমি জেনেছি লোকমুখে, অনেক পরে। গত সতের বছর ধরে আমার সাথে কেউতো আর যোগাযোগ রাখেনা। কাকীমার নীরব সেবা আর আমার মায়ের গান। আসর জমে উঠত। মা সেই আসরে কেন্দ্রমনি হয়ে বসে খোলা গলায় তারানা বা ঠুংরি গাইতেন। কখনও বা রবীন্দ্র সংগীত। আর সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত। আমার মা ঈশ্বরের আরেক অনাবিল সৃস্টি। তিনি যে কি পারেন আর কি পারেননা সে তিনিই জানেন। আমি আমার মাকে আজও বুঝতে পারিনি। কেন? মেয়েরা তো মায়ের পাদপ্রদীপে বড় হয়। তাঁকে ঘিরে থাকে ধ্রুপদী সংগীত যেন তাঁর আয়া হয়ে ছিল সেই সব দিনগুলোতে। এখনও আছে কি? এখন কেমন গলার অবস্থা মায়ের? জানিনা। আমার মায়ের সাথে আমার কথা বা দেখা সাক্ষাত নেই আজ সতের বছর।
 
আমি কাকুর বাড়িতে গিয়ে বেশ মজা করতাম। কাকুর বাড়ির বুলটেরিয়ার সারমেয় ‘ট্যাগী’ কে নিয়ে ধুলোয় লুটোপুটি খেতাম। ট্যাগী কে নাকি সারাদিন বেঁধে রাখতে হত কারন সে ভীষণ হিংস্র বলে আর আমি তাকে নিয়ে যা তা করতাম। আমি আজও ভাবি ওর নাম কি সারাদিন ‘ট্যাগড’ মানে বাঁধা থাকত বলে কি  ‘ট্যাগী’ রাখা হয়েছিল? নামকরণ তো সেই ছোট্ট বেলায় হয়েছিল। তখনও কি ‘ট্যাগী’ হিংস্র ছিল? আমি তো ওর মধ্যে কোনওদিন হিংসার রেশমাত্র দেখতে পাইনি কোনদিনও। ট্যাগীকে বশ করে ফেলেছিলাম বলে আমার দিদিরা আমাকে বেশ সমীহ করে চলত। ওদের বাড়িতে আরেক জার্মান শেফার্ড সারমেয়ী, এলশেসিয়ান, পিঙ্কি ছিল। সে ছিল শুক্তিদির খুব আদরের। অন্যান্য সকলেরও। পিঙ্কি নারী আর ট্যাগী পুরুষ। পিঙ্কি থাকত দোতলার ঘরের মধ্যে সবার মাঝে আর ট্যাগী নিচের পাম্পের ঘরের পাশে টিনের চালায় যেখানে বর্ষাকালে টিনের চালের ফুটো দিয়ে জল পড়ত। ওদের দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক রাখা হয়েছিল! ওদের দুজনের মধ্যে মিলন ঘটাবার কোনও চেষ্টা হয়নি! কিন্তু পিঙ্কি ট্যাগীকে দেখলেই কেমন উত্তাল হয়ে যেত। আর গলায় চেন বাঁধা ট্যাগী দেখত পিঙ্কিকে। কি করুণ যে সেই মুখ খানি তা আমি আজও ভুলতে পারিনি।
 
সিতি, শুক্তি, সুলুদির (সুলতা) এক পিসতুত দাদা ছিল। প্রসুনদা। তখন কত হবে বছর সতের বয়স বড় জোর তার। তাকে আড়ালে পশুদা বলে ডাকতাম। সে ছিল দস্যুপনায় আমার গুরু। সে কিন্তু জানতনা যে তার এক শিষ্যা আছে আমার মধ্যে। লেকগার্ডেন্সের বাড়ীর পেছনের বাগানের খেজুর গাছে চড়ে হাঁড়ি থেকে রস চুমুক দিয়ে খাওয়া ছেলে। বোলতার কামড়ে মুখ ফুলিয়ে ঘরে ফিরে সবার সামনে ঘুরে বেড়ানো এসব খুবই সাধারণ ব্যাপার। যেন কিছুই হয়নি। আমি তার ভক্ত হয়ে ওঠার অনেক কারণের মধ্যে এগুলো ছিল কিছু কারণ। শুনেছি খেলতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে নিজেই চলে যেত হাসপাতালে মাথা সেলাই করাতে। সে ট্যাগীকে নিয়ে লোফালুফি করত। তার সামনে তাকে পশুদা বলে ডাকার সাহস আমার ছিলনা। পেছনেই, কারন কি রাশভারী লোক ঐটুকু বয়েসেই বাব্বা। ‘পশু’ আমার আদরের ডাক ছিল। পশুদা কি তা জানত? জানিনা তবে তার চোখে আমি এক তীব্র শীতল ভালবাসার সুর্মা দেখেছি অনেকবার। সেটা আর কেউ জানতনা। আজও জানে কি কেউ? জানিনা। আমার তাকে খুব ভালও লাগত। আমার প্রথম হিরো। মাঝে মাঝে নীরবে এক ঝলক দেখেই চলে যেত তিনতলায় বড়মামার ঘরে আর আমার ভেতরে যেন কি একটা হত তখন বলে বোঝান যাবেনা। লেখাতো দূরের কথা। পশুদা যে কোথায় হারিয়ে গেল! জীবনের দুই তৃতীয়াংশ পেরিয়ে এসে আজ মনে হয় পশুদা, আমার হারান প্রেম, কি ফিরে এসেছে? কে জানে। না না তা কি করে হবে প্রসুন গুহ কি করে... আমার আরাধ্য... কিন্তু এত মিল কি করে হয় তবে? জানিনা।
 
একদিন স্নেহাংশুকাকুর দোতলার বারান্দা থেকে একটা সাজানো একটা কেয়ারী করা ছোট্ট কিন্তু ভারী টব ছুঁড়ে মারলাম এক চলন্ত ট্যক্সির ওপর আর ঐ ট্যাক্সির মালিক ছিলেন স্বয়ং স্নেহাংশু কাকু। কাকুর অনেকগুলো ট্যাক্সি চলত কলকাতায়। সাইড বিজনেস ছিল তার। তিনি তখন শ’ওয়ালেশ কোম্পানীর বড় সাহেব। এখনও ভাসে চোখের সামনে। ট্যাক্সির সামনের কাঁচ ফেটে চৌচির। ডাব্লু বি টি ৫২৮৯। কপাল ফাটিয়ে মালিকেরই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আসামী হল এক ছোট্ট মেয়ে যার নাম অধরা। মৌতুসি। আমার বাবা ওই নামেই ডাকতেন আমাকে। তখন আমার সাত বছর বয়স। দিদিদের বকা আর কাকুর গম্ভীর মুখ আজও মনে আছে। সুলুদির বাবা মানে কাকুর দাদা, জেঠু ছিলেন কলকাতা পুলিশের ডিসিপি। তিনি এসে আমায় কোলে তুলে নিতেই অনেকটা ঠান্ডা হয়েছিল আবহাওয়া কিন্তু বাবা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বাড়ি এসেই আমাকে কি বকা। সেদিন বাড়ি ফিরে বাবা আমায় প্রবল বকেছিলেন। সেই প্রথম ও সেই শেষ। খুব কেঁদে ছিলাম আমি। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আদুরি দুলালি অধরা মৌতুসি ছিলাম আমি।
 
আজ সতের বছর আমার বাবা মা আমার মুখ দেখেননি। আমিও তাদের সামনে যাইনি। সেইসব দিনগুলো আজও কেন এত ভাল লাগে! আমি আদুরী আবার খুব ডাকাবুকো। সত্যিই আমি খুব ডানপিটে ছিলাম। আমার রোমান্টিক ভাবনা গুলো সেই সাত বছর বয়স থেকেই। মনে আছে কাকুর ছোট বোন তিতি পিসির বর নারু কাকু। পিসির বর কাকু কারণ নারু কাকু অর্থাৎ নরেশ ভৌমিক ছিলেন আমার বাবার ছোট্ট বেলার বন্ধুও। সেই নারু কাকু অর্থাৎ তুতুর বাবার সোনারপুরের কাছে মালঞ্চ বলে এক জায়গায় একটা বাগানবাড়ি ছিল। সেখানে যেদিন প্রথম পিকনিকে যাই তখন আমার বয়স সাত বছর। বড়দিনের ছুটিতে। খুব ঠান্ডা তখন। সারাদিন সবাই সবার চোখের সামনেই তাই আলাদা করে কেউ কারও খোঁজও রাখেনি। প্রচুর আনন্দ হয়েছে। শীতের সন্ধ্যে নেমেছে আর আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি তখন নারু কাকুদের গোলাঘরের মাথায় উঠে চিত হয়ে শুয়ে আকাশকে আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরে গান গাইছি। কি গান? ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।'  আমি খুব ছোট্টবেলা থেকে গান গাই। আমার মায়ের দান। আজও চরম অবহেলা সত্ত্বেও আমার গলায় সুর খোলে। শেষে বুড়ো মালী ইয়াকুব আলী আমায় খুঁজে আনেন। তবে বাবা সেদিন আমাকে খুঁজে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন আর মা তখন এক্কেবারে চুপ। আজ সতের বছর বাবা আমায় না দেখে কি করে আছেন!
 
আমার রোমান্টিক আচার আচরণের আরও অনেক কাহিনী আছে। আমি আজন্ম রোমান্টিক। এখনও আছি তবে তার প্রকাশ নেই। সে কেবল আমি জানি। বিক্রম তো কোনওদিন বুঝলোনা এই রোমান্টিক অধরাকে। কেন? কে জানে? বিক্রমের জীবনে অনেক নারী এসেছে। তাদের কথা কিছু আমি বিক্রমের মুখ থেকেই শুনেছি। কিছু ওর দিদিবাহিনীর মুখে। আর আমার দেখা অনেক কিছু যা আমি মনে রাখতে চাইনা বা ওর নেটের অসংখ্য বান্ধবীর মেলায় আমি এটা জানি বিক্রম বেশ এক রমণীয় চরিত্র। তবে? অনেক পেলে কি মানুষ সুন্দরের মূল্য দিতে ভুলে যায়। আমি এই একচল্লিশের দুয়ারে পা রেখেও বুঝি কত পুরুষ আমার থেকে ছোট বা বড় সব বয়েসের পুরুষ আমার সাথে কথা বলতে বা আমার কাছে আসতে কত বাহানাই না করে। হাসি পায় তাদের বোকামি দেখে। আমি অধরা। আমাকে ধরা যায়না। আমিতো বিক্রমের কাছে ধরা দিয়েছিলাম। বিক্রম তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল একদিন। আমিই ছিলাম সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির আশ্রয় তার কাছে। বিক্রম আমাকে কি মনে করে? আমি কি তার জীবনে আসা অনেক নারীর মধ্যে একজন? আমার রোমান্টিসিজম কি এতই দুর্বোধ্য? আমার স্বামী এই সতের বছরের সাথীকে কেন তার অন্তঃসলিলা রূপকে চিনলনা? আমি জানি আমার সেই রোমান্টিক প্রকাশ বড় হবার পরে ঠিক সেই ভাবে আর ঘটেনি। আমি ঠিক প্রেম করিনি কখনও। তা কি ঘটবে কখনও? কবে ঘটবে? জানিনা। ঘটবে কি আদৌ? জানিনা। অধরা কবে ধরা দেবে সেই পুরুষের সামনে যে তার এই পাগলী দস্যিমেয়ের রূপের মধ্যে এক নিবিড় প্রেমিকাকে খুঁজে নেবে। আমি প্রেমে অশান্ত হতে চাই কিন্তু আমি রাধাঁর পরে খাওয়া আবার খাবার পরে রাধাঁর জীবনে আটকে আছি সেই ১৯৯০ এর মে মাস থেকে। অথচ আমার সব আছে। রূপ আছে, রুচি আছে, গুণ আছে, গান আছে, সূক্ষ্ম চেতনা আছে সর্বোপরি আমার ভেতরে এক নারীসত্ত্বা আছে যে সব সীমা ছাড়িয়ে সব কিছু হারিয়ে প্রেমে পড়তে চায় – যার কাছে চৈত্রের গোধূলী বেলায় বৃষ্টির পরের রামধনুর সাত রঙের আবেদন বা সেই লাস্যময়ী আকাশের আলোয় এক রঙ্গিন প্রজাপতির পেছনে নিঃশব্দে ছুটে যাওয়ার মধ্যে নিজের প্রেমিকা রূপ খুঁজে পাওয়া এক অমূল্য অনুভূতি। সেইসব অমূল্য অনুভভূতিকে কেউ কি সত্যিই ছুঁতে পারব? জানিনা। জানি না বলা আমার মুদ্রাদোষ নয় তবে আমি প্রায়ই এই কথা বলে থাকি স্বতস্ফূর্ত ভাবে। কেন বলি? জানিনা। আমি বিয়ে করেছিলাম। আমার স্বামী আছে। বিক্রম চৌধুরী, আমার মেয়ে আছে তবে আমি কেন এসব কথা বলছি? তাই না? থাক সে কথা।
 
শৈশব বড় সুন্দর। বাবা মায়ের আদর, ঠাকুমার স্নেহমিশ্রিত নীরব প্রশ্রয়, পাড়া প্রতিবেশিদের আহ্লাদ ও সহনশীলতা সব মিলিয়ে খুব সুন্দর ছিল সেই সব দিনগুলো। আমার দস্যিপনার বহর দেখে ঠাকুমা বলতেন ছেলে বানাতে গিয়ে ভগবান নাকি আমাকে মেয়ে বানিয়েছিলেন। কথাটা খুব মিথ্যে ছিলনা। ছেলেবেলার খেলার সাথীদের অনেকেই হয়ত আজও আমার শান্ত স্বভাবের নিদর্শন বয়ে নিয়ে চলেছে তাদের অঙ্গে। দস্যি এই আমি তবুও যে কত মানুষের স্নেহধন্য হয়েছি তা বলার নয়। আমার বেশ মনে আছে। তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ হবে। সুদূর আফগানিস্থান থেকে আমাদের বাড়িতে এক কাবুলিওয়ালা আসত। রবিঠাকুর তখন যদি জীবিত থাকতেন তাহলে হয়ত...
 

 

 

 

পর্ব-৪

 

 

 

সুবুদ্ধি অধরার লেখা পত্রগুচ্ছ পড়ছে আর অবাক হয়ে ভাবছে একি নতুন খেলা ঈশ্বর শুরু করালেন তাঁকে দিয়ে! যদি এই ছিল মনে কেন ঈশ্বর তাকে এতদিন দূরে রেখেছিলেন! এ কেমন খেলা ঈশ্বরের? অধরা লিখে চলেছে তার হাত ধরে? অধরা সত্য তবু সে নিজে লেখেনা! অধরার কথা বলতেই হবে কারণ তার জীবনের ফোয়ারার বদ্ধ মুখ খুলেছে দীর্ঘ সতের বছর পরে। সে আজ উন্মুক্ত হতে চাইছে।

 

ধরা সত্যিই থাকে এক বর্ণময় অন্তরালে...
 

খানচাচার সাথে আমার ছোট্টবেলার সেই দিনগুলির কথা আমাকে কেমন যেন অবশ করে দেয়। আমার পড়া ও সচক্ষে দেখা কাবুলিওয়ালার মধ্যে মিল আছে বললে কম বলা হয়, এক্কেবারে হুবুহু এক। যদিও শেষের দিকে নতুন সংজোযন হয়েছে যা আসল কাবুলিওয়ালায় ছিলনা। এই সংযোজন হতে পারে রবিঠাকুর যদি জানতেন তাহলে হয়ত কাবুলিওয়ালা পার্ট টু লিখে ফেলার ভাবনা তাঁর মাথায় উঁকি দিয়ে যেত। সত্যি কথা বলতে কি আমার জীবনে রবিঠাকুরের সেই রচনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল। সেই বৃদ্ধ কাবুলিওয়ালার ভালবাসার প্রকাশ ছিল নীরব। কিসমিস, আখরোট ইত্যাদি ঝুলিতে ভরে একগাল হেসে সেই সৌম্য সুদর্শন মানুষটি যখন এসে দাঁড়াত, মনে হত, সে যেন আমার কতকালের চেনা। ভাষা ধর্ম্ম সমাজ কোথাও কোনও মিল নেই, তিনি আমার কেউ নন, আসতেন এদেশে ব্যবসা করতে আর এসেই আমার জন্যে কত কি বের করতেন এক এক করে তার ঝোলা থেকে। পরম স্নেহে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কত কথা বলতেন, আদর করতেন আজ তা অনেকটাই বিস্মৃতির অতলে কিন্তু আমি আজও সেই অনুভূতিকে ছুঁতে পারি। তাঁরও এক কন্যা সন্তান ছিল যার কথা আমি জেনেছি খান সাহেবের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবার পর। আমি কি স্বার্থপর ছিলাম শুধুই নিয়েছি সেই হতভাগ্য পিতার কাছ থেকে, কোনওদিন জানার চেষ্টাও করিনি তার কি আছে, কে আছে – তারা কোথায় থাকে! সব জেনেছিলাম বড় হয়ে। পিতৃস্নেহের রূপ বোধহয় সব দেশেই এক ও অভিন্ন। কাবুলীওয়ালা খান চাচা আর আমার বাবার স্নেহ ভালবাসার মধ্যে আমি কোনও রূপগত পার্থক্য খুঁজে পাইনি কোনদিন।
 
খান চাচার যাতায়াত তখন প্রায় প্রতিমাসে একবার। কখনও বা দু-তিন বারও হত। সেই সময় বাবার খুব খারাপ ধরনের বসন্ত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের দৌলতে আজ এই রোগ তেমন কোনও সমস্যাই নয় কিন্তু তখন বেশ চিন্তার কারণ ছিল এই রোগ। তখন আমার বাবার ঘরে যাওয়া নিষেধ ছিল। আমি খুব অনুভব করতে পারতাম বাবার কি কষ্ট হত আর মন খারাপ করে বসে থাকতাম। আমার সেই ছোট্ট শিশু মন বাবার কষ্টকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করত আর আমার দু’চোখ জলে ভরে যেত। খান চাচা সেটা বুঝতেন। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কত ভাল ভাল কথা বলতেন, পিতৃস্নেহের নিয়ন্ত্রিত বর্ষণ হত। নিয়ন্ত্রিত কারণ আমার পিসি কাবুলিওয়ালার এই আদর আস্কারাকে ভাল চোখে দেখতেন না। সেই সময় আমার পিসি জামশেদপুর থেকে এসে থেকেছিলেন আমাদের বাড়িতে বাবার শুশ্রুষা করার জন্য। পিসি নিঃসন্তান আর পিসেমশাই খুব ভাল মানুষ। আমার কষ্ট পিসেমশাইয়ের কাছে এক্কেবারেই গ্রহণযোগ্য হতনা। প্রকাশ করে ফেলতেন তিনি। আমার বাবার মতন ছিলেন তিনি। তিনিই পিসিকে পাঠিয়ে দেন বাবার বসন্ত হয়েছে শুনে। পিসি খান সাহেবকে খুব একটা ভাল চোখে দেখতেননা। এই পিসিই আবার খান সাহেবের আনা জরিবুটি সেদ্ধ করে তার জল দিয়ে বাবাকে স্পঞ্জ করিয়ে দিতেন বেশ নিষ্ঠাভরে। আপত্তি তো করতেনই না বরং দাদার জন্য কিছু করতে পারছেন এই ভেবে বেশ সন্তুষ্ট বোধ করতেন। কিন্তু সেই আরোগ্যের জড়িবুটি এনে দিচ্ছেন যিনি সেই কাবুলিওয়ালাকে তিনি অপছন্দ করতেন। মানুষ কত বিচিত্র আচরণ করে মানুষ নিজেই জানে কি? জানিনা।
 
আমাকে যখন কাবুলিওয়ালা খান সাহেব আস্কারা দিয়ে এটা ওটা দিতেন তখন বাবা বলতেন, ‘এই মেয়েকে আর বাড়াবেন না খান সাহেব। এই মেয়ের যে কি হবে। কার ঘরে যাবে। কে তাকে এত আস্কারা দেবে?’ খান চাচা দাঁড়ির ফাঁকে শুধু হাসতেন। সেই হাসি কি আমার জীবনে পেছন থেকে এক দীর্ঘস্থায়ী নীরব কান্না হয়ে রয়ে গেল চিরকাল? কে জানে? সত্যি বলছি আমি জানিনা... আমি আজ আর কিছুই পরিষ্কার করে দেখতে পাইনা... আমি জানিনা খান চাচার আসা কেন বন্ধ হল? খান চাচার কি হল, কিছুই জানিনা। আমার জীবনে সেই কাবুলিওয়ালার স্মৃতির টান যে কত তা আজ লিখতে বসে বেশ অনুভব করছি। আমার দুইগাল বেয়ে উষ্ণ লোনা নামছে। আমার গলা বুজে আসছে। কিছু কি বলতে চাই আমি? জানিনা। খান চাচার ছোট্ট মেয়েটি বাঁচেনি দুরারোগ্য লিউকোমিয়ার ছোবল থেকে যা আমি জেনেছিলাম ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়। সেদিন থেকে বেশ কয়েকদিন আমি ঠিক মত ঘুমোইনি, খাইনি। তার পর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়েছিল। স্বাভাবিক হয়েছিল কি?
 


ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় আমি রীতিমত তরুণী ও তন্বী। আমার আগুনে রূপ আমার মায়ের দান। ছেলেরা আমার কাছে আসার জন্য কেমন যেন হ্যাংলামো করত, আমার একদম ভাল লাগত না। মনে আছে, ক্লাস ইলেভেন থেকে ট্যুয়েল্ভে যাবার বার্ষিক পরীক্ষায় আমি বেশ ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। বাড়ি এসে মাকে বলতেই মা আমাকে খুব আদর করলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিলেন যে আমি অনেক দিন নতুন কিছু আঁকিনি। আমি সেদিন স্কুল থেকে ফিরে একা একা গড়িয়াহাট মার্কেটে গিয়েছিলাম কিছু আঁকার সামগ্রী কিনতে আর সেখানেই খান চাচার এক জাতভাই এর দাক্ষিণ্যে আমার আব্রু বজায় রইল। দোকান থেকে বেরিয়েছি – দেখি বছর তিরিশের একটি লোক কিছু অশালীন কথা বলে আর আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। ঠিক তখন এক বৃদ্ধ কাবুলিওয়ালা এসে পাশে দাঁড়াল আর বলল, ‘বেটি চল তুমি আমার সাথে বাঢ়ি যাবে?’  কথাটা বেশ জোরেই বলেছিল সে আর তাতেই কাজ হল। সেই লোকটি এক্কেবারে হাওয়া। তারপর আমার পাশেপাশে পাহারাদার এর মত নীরবে হেঁটে এল সেই কাবুলিওয়ালা একেবারে আমাদের ফার্ণ রোডের বাড়ির দরজা পর্যন্ত। সে আমার কাবুলিওয়ালা খানচাচা নয় কিন্তু কে যেন তাঁকে পাঠিয়েদিলেন আমাকে রক্ষা করার জন্য। সেই রাতে ডিনার টেবলে শুনলাম বাবা মাকে বলছেন, খান চাচার কথা। বাবাও ঘটনার অনেক পরে জেনেছিলেন যে খান চাচার মেয়ে মেহেজবীন আর নেই। মেহেজবীন মারা যায় আমি যখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি। আর আমি তা জানতে পারলাম আমার স্কুল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, পাঁচ বছর পরে। কেন? জানিনা। এর পর খান চাচার আর কোনও খবর বাবা পাননি। আমিও না। আজ আমার কি হল? লিখতে বসে কলম থেমে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে আমার সতের বছরেরও বেশী সময় ধরে জমে থাকা কান্না। আমাকে আজ খান চাচার জন্য কাঁদতে দাও। আমার জীবিত বাবার জন্য কাঁদতে দাও যিনি আমাকে তাঁর প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন। না না এখনও ভালবাসেন তিনি। তিনি কি করে এই সতের বছর ধরে তার মৌতুসিকে না দেখে, তার সাথে কথা না বলে আছেন! বাবা কোর্ট থেকে ফিরলে আমার ভেতর কেমন একটা অসীম আনন্দ হত। আমিই বা কি করে বেঁচে আছি তাঁকে না দেখে! জানিনা।
 
আমার বিয়ে হয়েছিল। কি রকম সেই বিয়ে? তা নিয়ে অনেকের অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু কেউই কিছু বলে বা করে উঠতে পারেননি। থানা পুলিশ করেও কিছু করে উঠতে পারেননি। তাই অনেক অভিযোগ। না কি অভিসম্পাত কুড়িয়ে নিয়েছিলাম না বুঝেই? কিন্তু আমার কি আর কোনও উপায় ছিল এই বিয়ে না করে! আমি নিজেকে বলি চড়িয়েছিলাম যাঁর সন্মানের আব্রু রাখতে তিনিই আমার মুখদর্শন করেননি আজ সতের বছর। আজও মনে আছে আমার বিয়ের সময় আমার বাবা খবর পেয়ে একবারের জন্য আসতে চেয়ে ছিলেন আমাকে দেখতে কিন্তু আমার মা, হ্যাঁ আমার মা তাঁর মাথার দিব্বি দিয়ে তাঁকে আটকে ছিলেন। আমার পিতৃসম সাধুমামা বাবাকে আনতে গিয়েছিলেন কিন্তু মা তাঁকে আসতে দেননি। সাধুমামা মায়ের কোনও ভাই নন। তিনি ছিলেন আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার। আমাদের বাড়ির অবিচ্ছেদ্য সভ্য। সাধুমামা আমাকে যে কি ভালবাসতেন! অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এই সাধুমামা। কতরকমের হাতের কাজ জানতেন তা বলে শেষ করা যাবেনা। আমার জন্য কত খেলনা তৈরী করে আনতেন। তার সব কিছু নিজের হাতে বানাতেন তিনি। আমাকে নিয়ে লেকের মাঠে খেলতে নিয়ে যেতেন। আই-এল-এস-এস সাঁতার কাটতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা তাও সেই সাধুমামা। সাধুমামা এই কদিন আগে মারা গেলেন মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে আর আমি কিছুই করতে পারিনি তখন। জানলাম উড়ো খবরের মত। আমি কি কেবল নিয়েছি তাঁর থেকে? কিছুই তো দিতে পারিনি সাধুমামাকে।
 
আমার বিয়ে হয়েছিল বিক্রমের সাথে। এক ঝড়ের গতিতে সব ঘটেছিল। মা কেন বোঝেননি যে বিক্রমকে বিয়ে করা ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিলনা। না আমি কোনও সাময়িক ভুলের মাশুল হিসেবে বিক্রমকে বিয়ে করিনি। আমার সম্ভ্রম আমার সংযম আমাকে কোনও দিন আক্ষেপ করতে দেয়নি। কিন্তু তবুও আমি বিক্রমকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার কোনও উপায় ছিলনা। ততদিনে বিক্রমের আমাদের বাড়ীতে আসা যাওয়ার প্রায় আট বছর হয়ে গেছে। আসলে বিক্রম আমার কাছে সবকথা খুলে বলেছিল আমাদের বিয়ের ঠিক আগে, প্রায় ছ'মাস ধরে। এই ছ’মাসে বিক্রম ও মায়ের দ্বিপ্রাহরিক আড্ডা ও গল্পগুজব সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিক্রম আমার কাছে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করত আর মা, সেটা যাতে না হয়, তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতেন। ধীরে ধীরে বিক্রম আমার মায়ের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। আমি কেন বিক্রমকে বিয়ে করেছিলাম, মা কি তা জানতেন না? বেশ জানতেন। তার থেকে ভাল আর কেউ জানতনা যে আমি কেন বিক্রমকে বিয়ে করেছিলাম।

আসলে বিক্রমকে ঘিরে মা কেমন যেন এক অসহ্য আবরণের মধ্যে থেকে গেলেন। সেই অসহ্য দুর্বোধ্যতার ধোঁয়াশাকে অপরিবর্তিত রাখতে মা যা সব করেছেন তা আমার বোধগম্য হলেও গ্রহণযোগ্য হয়নি কোনদিনও। কাউকে বলতে পারিনি সেই সব কথা, আজও পারবনা। মেয়েদের মায়ের সাথে বন্ডিং হয়। আমার কি তা হয়েছিল? মা আমার কাছে স্বচ্ছ ছিলেননা। এমনকি আমার বেড়ে ওঠার বয়সেও নয়। আজতো নয়ই। তাই আমার মা আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর কেন আমার খোঁজ করবেন না বা আমার বিয়েতে বাবাকে আসতে দেবেন না। এটা বোঝা আমার কাছে খুব সহজ ছিল। কিন্তু বাবা? বাবা কি করে পারলেন? আমার বাবার কি ব্যক্তিত্বের সমস্যা ছিল? বাবা কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করতেন। বাবা একজন ডাকসাইটে দুঁদে ব্যারিস্টার হিসেবে পরিচিত ছিলেন সেই সময়। সেই সুঠাম ব্যক্তিত্ববান পুরুষ, আমার বাবাকে মা কি করে নিয়ন্ত্রণ করেছেন সারা জীবন সেটা আমার কাছে এক বিরাট ধন্ধ হয়ে আছে আজও। বাবা কি আসলে...? আমি আমার নিজের মা বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অভিপ্রায়ে এই সব লিখছিনা। আমার ভেতরের জ্বালা এই কাগজের ওপর উগড়ে একটু ভাল থাকতে চাইছি। আমি আজ সতের বছর ধরে ভাল নেই। আমার আরাধ্য একজন আছেন যিনিই পারেন আমাকে মুক্তি দিতে এই অন্তরের জ্বালামুখীকে নির্বাপিত করে।

বিক্রম আমার থেকে ১৪ বছরের বড়। বিক্রম ছিল আমার বাবার মর্নিং ওয়াকের সহপথচারী। সেই থেকে বন্ধুত্ব। রোজ সকালে রবীন্দ্র সরোবর লেকের ধারে হাটঁতে যেতেন বাবা। আর সেখানেই বিক্রমের সাথে বাবার আলাপ হয়। বিক্রমের একটা আলাদা চার্ম ছিল। ছ'ফুটের ওপর লম্বা। আজকাল যে সিক্স প্যাক ঠ্যাক কিসব বলে বিক্রমের সেই রকম পেটা চেহারা ছিল। রোমান্টিক গ্রুভি ভয়েস। সেই ছোটবেলায় রেডিওতে শোনা রোমান্টিসিজমের চুড়ান্ত প্রকাশ বিরল কুমারের গলার মতন, যে গলা শুনলে নব্য যুবতীর মনে ও শরীরে এক রিনরিনে অনুভূতি হয়। যে গলা একান্তে বা নিভৃতে শুনলে কখনও বা সারা শরীরে নাড়া পড়ে, ঝড়ও ওঠে। প্রবীণাদেরও বোধ হয়। সেই রকম।
 
আমার মা সুকন্ঠস্বরের পূজারী ছিলেন। আজও কি আছেন? জানিনা। বিক্রমের ব্যক্তিত্বের আবেদন যে কোনও মেয়ের নজর কেড়ে নিত। বাবার সাথে আমার মাও মাঝে সাঝে যোগ দিতেন সেই মর্নিং ওয়াকে। বিক্রমের ব্যক্তিত্ব আমার মাকেও প্রভাবিত করেছিল। মা বিক্রমকে একদিন মর্নিং ওয়াকের পরে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের হাতে চা করে খাওয়ান যা আমি কোনওদিন দেখিনি আগে। কাজের মহিলা চা করে দিতেন। আমার মায়ের সকালের চা খাওয়ার সাথী ছিলেন আমার বাবা। তা বদলে গিয়েছিল সেদিন থেকে। বিক্রম ছাড়া মায়ের সকালের চা খাওয়া হতনা। তার পর বাবা মাঝে মাঝে যোগ দিলেও নীরবে খবরের কাগজের আড়ালেই মুখ রাখতেন সেই সকালের চায়ের বাসরে। আমি ছোট হলেও সব বুঝতাম। দূর থেকে সব দেখতাম। আমার বয়স তখন পনের। মা যেন বিক্রমকে একটু বেশীই আস্কারা দিচ্ছিলেন প্রথম থেকেই। পরে আরও দিতেন। কথা নেই বার্তা নেই হঠাত দুপুর বেলা বিক্রম চলে আসত। আমি কলেজ থেকে এসে দেখি দুজনে মশগুল হয়ে একান্তে গল্প করছেন। বাবা তখন কোর্টে। সারা দুপুর বিক্রম থাকত আমাদের বাড়িতে কিছুটা আমার মায়ের সোহাগী হুকুম মেনেই অনেক বছর ধরে চলেছে এই পর্ব। আমি বড় হয়েছি এই সব দেখতে দেখতেই।
 
মা মাঝে মাঝে বিক্রমের সাথে সিনেমা দেখতে যেত নুন শো’তে। কখনও ঘরে দরজা বন্ধ করে দুজনের গানের রেওয়াজ চলত আর আমি একা একা গান গেয়ে সারা বাড়ী ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ঐ বন্ধ ঘরের দরজায় নক করার করার সাহস আমার ছিলনা। আমার গানও আমার মায়ের দান। বিক্রম ছিল আমার মায়ের গানের অন্ধ ফ্যান। আমার মায়েরও। আমি ১৯৮৫'র মিস কলকাতা হবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েও যাইনি কারণ আমার মা চাননি তাই। আমার মা আমার থেকে শতগুণ বেশী রূপসী ছিলেন। আমি কেমন অবাক হয়েই সব দেখতাম। মায়ের মুখের ওপর কিছু বলার সাহস বা ব্যক্তিত্ব কোনটাই আমার ছিলনা। আমার মা আমাকে প্রায়ই বলত বিক্রমের প্রতি যেন আমি কোনও ভাবেই কোনও আকৃষ্ট না হই। ও ভাল কিন্তু আমার স্বামী হবার যোগ্য নয়। এসব কথা মা আমাকে কেন বলতেন সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছিলাম। বিক্রম কিন্তু আমার কাছে আসার জন্য হাঁকপাঁক করত। মা ওকে চোখের আড়াল করতেন না। কখনও সুযোগ পেলেই বিক্রম কিছু বলার চেষ্টা করত। আমি কি অগোছালো কথা লিখছি? হয়ত। আমি এর থেকে বেশী গুছিয়ে এই সব কথা লিখতে পারবনা। পাঠক আমাকে মাফ করবেন।
 
আমার বাবা নাটকের লোক। প্রবাদ প্রতীম ধীরেন্দ্র গুপ্তের শিষ্য আর নটসম্রাট নীলোতপল দত্তের সাথে 'মানবমন গণনাট্য' গ্রুপের নিয়মিত সভ্য ছিলেন। আর বিক্রম তো ফিল্মের লোক। তাই অভিনয় জগতের। বাবাও বিক্রমকে পছন্দ করতেন কিন্তু সেটা গৃহ শান্তি বজায় রাখতে কি না জানিনা। আমি আজও জানিনা বিক্রম কেন আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল সেই সন্ধ্যায়! কেনই বা সে আমাকে আঁড় চোখে দেখত আর মায়ের সাথেই কাটাত সারাক্ষণ। আবার আমি আজও ভাবি কেন ওর চোখ চোখ পড়লেই আমার ভেতরে তোলপাড় হয়ে যেত! কেউ জানতনা। বিক্রম ও কি বুঝত সেটা? জানিনা।

আমি তখন কুড়ির উঠোনে যৌবনের ওম নিয়ে একান্তে ব্যস্ত। মাঝে সাঝে বিক্রমের সাথে তার আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়ার পথে দেখা হত তখন কেমন যেন একটা শিরশিরে রিনরিনে চমক অনুভব করতাম। ওই পর্যন্তই ছিল সেই সব অনুভূতি কারণ আমার মায়ের শাসনের বেড়াজাল ছিল সর্বদা আমার চারপাশে। এমনি করে দিন চলছিল। আমি কলেজ শেষ করে হাজরা ল' কলেজে এল এল এম কোর্সে ভর্তি হলাম। তখন থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে একদিন আমি বাড়ী দেখি কেউ নেই বাড়ীতে। কাজের মেয়েটি রান্নাঘরে সাধুমামা বাড়ি চলে গেছেন দারওয়ান গেটে। হঠাতই বিক্রম এসে হাজির সন্ধে বেলা। মা বাবা কেউই বাড়িতে নেই। নতুন চীফ জাস্টিসের সন্মানে ডিনারে গেছেন আমি একা। হঠাত ও খুব কাছে এসে বলল, একটু ছাদে আসবে? কথা আছে। আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মত ত্বরিতে ছাদে উঠে গেলাম। আমার মত ডানপিটে মেয়ে কি করে সেই দিন সন্ধ্যায় বশ হয়ে গেল আমি তা আজও বুঝিনি।


সেই সন্ধ্যায় বিক্রম আমাকে এক লহমায় বুকের মধ্যে চেপে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'আমি তোমার মায়ের সব কথা শুনি কেন জান? আমি তোমাকে চাই অধরা। তুমি আমার সাথী। তুমি কি আমার জীবন সংগীনি হবে? আমি তোমার জন্যই, শুধুই তোমার জন্য, আমি তোমার জন্যই এই বাড়িতে আসি।'

 

কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলেছিল বিক্রম। সেই কথা গুলো আজও কানে বাজে। এর থেকে বেশী কিছুই হয়নি সেই সন্ধ্যায় কিন্তু গত সতের বছর ধরে মনে হয় আমি সেদিন ভেসে গিয়েছিলাম। আমি সেদিন একটু শক্তহাতে নিজেকে চালিত করতে পারিনি। আমার জীবনে প্রথম পুরুষ বিক্রম কিন্তু সে কি আমাকে মন থেকে চেয়েছিল? সেকি আমাকে দেখে আমাদের বাড়িতে এসেছিল? সেতো আমাকে দেখেছে অনেক পরে! বিক্রম চৌধুরী। সেতো আমার মায়ের বন্ধু। হয়ত আমার বাবারও বন্ধু ছিল সে। সেকি আমাকে ভালবেসেছিল? এই প্রশ্ন আমি কাকে করব? নাকি সেই দিনগুলোর অসহ্য পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য সে আমাকে তার সাথী করে নিতে আকুল হয়ে সেই সন্ধ্যায়...।


সাথী আমার আরেক নাম। বিক্রমের দেওয়া। বিয়ের পর থেকেই সে যেন আমার গার্ডিয়ান – প্রতি পদে পদে সে আমাকে একটা ছোট্ট মেয়ের মত ‘ট্রিট’ করে এসছে। আজও তাই করে। সে আমার বন্ধু হতে পারেনি। অথচ আমি কি স্বাধীনচেতা মেয়ে ছিলাম। পশুদা থাকলে বোধ হয় এর একটা প্রতিকার করতেন। তিনি ঠিক বুঝতেন। আমি কি ঠিক ভাবছি? পশুদা কোথায়? সে কেন একবারও আমার খোঁজ নেয়নি এত বছর ধরে? সেকি আমাকে ভালবেসেছিল? জানিনা।
 
আমি কিছুই বুঝতাম না। যেদিন বিক্রম আমায় ছাদে ডেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঐ আকুতি জানিয়েছিল সেদিন সাঁঝে আমি বুঝেছিলাম বিক্রম কি বলতে চায়। সে আমার মায়ের হাত থেকে বাঁচতেই আমাকে অবলম্বন করেছিল। সে বুঝিয়েছিল যে আমিই পারি ওকে এই জীবনে এক আশ্রয় দিতে। আমি তা দিয়েছিলাম। ততদিনে বিক্রম আমার মায়ের এত কাছে এসে পড়েছিল যে তা সামলাবার ক্ষমতা না মায়ের না বিক্রমের আয়ত্ত্বে ছিল। বিক্রম আমার বাবারও খুব বিশ্বাস ভাজন ছিল, সে কথা ঠিক। ততদিনে বাবা কি কিছুই বোঝেননি? আমি বিক্রমের বাঁচার আকুতি শুনতাম শয়নে স্বপনে জাগরণে। আমি ক্রমশঃ এক আবেশজালের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার কি করা উচিত ছিল? মাকে সব বলা? না কি আমার মা তখন বিক্রমকে দূরে সরাবার চেষ্টায় পারঙ্গম হতে চাইছিলেন? আমার মা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন বিক্রম আমার যোগ্য নয়। আমি কি করে সেই মাকড়শার জাল কেটে বেরিয়ে আসব তা আমি জানতাম না।
 
এল এল এম পড়ার সময় আমি প্রায়ই বিক্রমের বাড়ি যেতাম কলেজ থেকে। ওর মা, বাবা, দিদিরা সবাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ওর দিদিদের অবশ্য একমাত্র ভাইয়ের সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা ছিলনা। তারা আমাকে ফাঁকে পেলেই বলত, ‘দেখিস লালু (বিক্রমের ডাকনাম) লালু তোকে ছেড়ে আরেক সুন্দরীর সাথে ভিড়ল বলে, তখন কিন্তু চোখের জলের খরচ অনেক। আমরা তো আমাদের ভাইকে চিনি। সে একটি উঁচুদরের রোমিও।’
 
আমি বালিগঞ্জ ল'কলেজের পাঠ শেষ করেছি। ফাইন্যাল একজাম হয়ে গেছে। কিছু স্পেশ্যাল ক্লাস ছিল। প্র্যাক্টিস ওরিয়েন্টেড ক্লাস। সেদিন ক্লাস হলনা। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে দেখি মা বসে বসে টিভি দেখছেন। যেন আমারই অপেক্ষায়ই বসে আছেন। ঘরে ঢুকতেই মা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তোমাকে এই শেষবার বলে দিচ্ছি বিক্রম খুব বাজে টাইপের লোক। বিক্রমের মত পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বন্ধ কর নয়ত এই বাড়ী ছাড়।' কেমন ত্বরিতে বিদ্যুত খেলে গেল সারা শরীরে। আমি মাকে প্রায় প্রশ্ন করে বসেছিলাম, সেটা তুমি এত ভাল করে জান কি করে মা? কিন্তু পারিনি। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে বসে কাঁদলাম। অনেক ভাবলাম। স্নান করলাম। পোষাক বদলে বেরোতে যাব দেখি মা দাঁড়িয়ে নিচে ড্রয়িংরুমের দরজায়।

‘কোথায় যাচ্ছ?’

নিচু গলায় উত্তর দিলাম, ‘বিক্রমের কাছে।’

 

মা কিছুটা ড়িতাহতের মত দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন আর আমি বেরিয়ে এলাম। সেই দুপুরে আমি বিক্রমের টালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তারপর আর আমি বাড়ি ফিরিনি...
 

* পর্ব-৫-৮*